শিলিগুড়ি পর্ব-১
আগের পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
ভারতীয় ইমিগ্রেশন ও ডলার ভাঙ্গানো পর্ব শেষে পাশের অস্থায়ী দোকানে রুটি কলা খেতে বসতে যাচ্ছি এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল।বের করে দেখি বাড়ী থেকে ফোন।টাওয়ার স্ক্রিনে দেখি ফুল নেটওয়ার্ক।বাংলাদেশী হিসেবে আমার সার্বভৌমত্বটা বর্ডারের ওপারে রেখে আসলেও গ্রামীণের নেটওয়ার্কটা বর্ডারের চোখ এড়িয়ে তখনও আমার সাথেই আছে।
জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। নিজের মধ্যে তখন অন্যরকম অনুভূতি।ভারতে দাঁড়িয়ে আমার ফোনে কথা বলছি শুনে ওপাশে মনে হ’ল কৌতূহলী কন্ঠ বেড়ে গেল।একজন দুজন এভাবে কয়েকজনের সাথে কথা বলতে বলতে রুটি-কলার পর্বটাই ভূলে গেলাম।
তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে নিয়েছি অনেক আগেই। পাশেই সুমো টাটা বা জিপ জাতীয় ভাড়ায় চলা গাড়ীগুলি যাত্রী বোঝাই করে যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। একটাতে বাংলাদেশী ইমিগ্রেশন অফিসে দেখা কিছু লোককে একত্রে দেখতে পেলাম।কাছে গিয়ে শুনলাম কয়েকজন মিলে রিজার্ভ করে নিয়েছেন। ৮৩ কিলো পথ।এমনিতেই জনপ্রতি ভাড়া ভারতীয় টাকায় ১০০ থেকে ১১০ টাকা। কয়েকজন ড্রাইভারের ইশারাও পেলাম।কিন্তু আমি সময় নিচ্ছিলাম জায়গাটা একটু ঘুরে দেখার।
ভাড়ায় চলা সুমো টাটা বা জিপ
গুগল ম্যাপে দেখেছিলাম, বর্ডার থেকে সামান্য দূরেই কোথাও চেংড়াবান্ধা বাস স্ট্যান্ড এবং রেল স্টেশন আছে। সামনে দিয়ে সিলিগুড়ির শ্যামলী এসি বাসটি চলে গেল।বামের বর্ডার রোডটিতে বাঘা বাঘা সিকিউরিটি লাইটগুলি মাইকের মত হাঁ হয়ে আছে। বর্ডার রোড বাদ দিলে একটিই রোড সামনে চলে গেছে।সারি সারি মাল বোঝাই ট্রাক এবং গাড়ীর যাতায়াত এ কথাই জানান দিচ্ছে। পথব্রজে একাকী ছাতা মাথায় হাঁটা ধরলাম।
চেংড়াবান্ধা। নামটিতেই অ-বাঙ্গালী,অ-বাঙ্গালী ভাব। আসলেও তাই। চেংড়াবান্ধা ভারতের কুচবিহার জেলার মেখলিগন্জ ব্লকের মধ্যে পড়েছে।বাংলাদেশের ছিটমহল সমস্যার অন্তরালে কুচবিহারের নামটি জড়িয়ে আছে। নামটি অ-বাঙ্গালী হলেও দেখলাম এখানকার সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলছে।
বেশিক্ষণ হাঁটতে হ’ল না।সামান্য কিছু দূর গিয়েই হাতের বাম পার্শ্বে দেখা মিলল চেংড়াবান্ধা রেল স্টেশনের। একটি দেশের সীমান্তের এত কাছাকাছি এত বড় রেল ষ্টেশন না দেখলে বিশ্বাসই হবে না।
চেংড়াবান্ধা রেল স্টেশন
ডান পার্শ্ব থেকে সুতার মত কয়েকটি সরু রোড বেরিয়ে গেছে। একটি ধরে এগুতেই সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গার দুই ধারে অনেকগুলি দোকান চোখে পড়ল।জানতে পারলাম এটাই বাস স্ট্যান্ড। কিন্তু বাস নেই। একটি হোটেলে ঢুকে তাড়াতাড়ি পেটের শাসনটা করে নিলাম।এর মধ্যেই একটা বাস এসে দাঁড়াল। তবে তা জলপাইগুড়ি যাবে, শিলিগুড়ি নয়।শিলিগুড়ির বাস আসতে আরও দেরী হবে।
চেংড়াবান্ধা বাস স্ট্যান্ড
বাস আসতে দেরী হবে জেনে ব্যাগটা কাঁধে তুলে এগুতে থাকলাম। একটাই রোড,বাস আসলে সামনে থেকেও উঠা যাবে।বেশ খানিকটা এগুনোর পর সামনে পড়ল একটা তিন মাথার মোড়।নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু দাঁড়িয়ে পথ নির্দেশ করছেন।
নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন
এখানে দাঁড়ালে হলদিবাড়ী-কুঁচলিবাড়ী ছেড়ে আসা শিলিগুড়ির বাসও ধরা যাবে।তিনবিঘা করিডোর এ পথ দিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের পাটগ্রাম দিয়ে তিনবিঘা করিডোরে গিয়েছি।দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষজনের সাথে কথা বলে জেনেছি তিনবিঘা করিডোর নিয়ে তাদের উচ্চ্বসিত অভিব্যক্তি।
একটা গাড়ীর হর্ণে ফিরে তাকালাম।একটা জিপ গাড়ী পিছনে দাঁড়িয়ে হর্ণ দিচ্ছে।গাড়ীর গ্লাস খুলে একজন পৌঢ় গোছের লোক আমাকে ডাকছেন।
-হ্যালো ইয়ং ম্যান,কোন সাহায্য করতে পারি ? গাড়ীর গ্লাস নামিয়ে ভদ্রলোক ডাকছেন। কাছে গিয়ে চিনলাম।বুড়িমারী স্থল বন্দর প্রশাসনিক ভবনে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সাথে(পুলিশের কর্মকর্তা) কথা কাটাকাটির সময় ভদ্রলোক বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমর্থন জানিয়েছিলেন।পাশে বসা ভদ্র মহিলাও স্নেহের হাসিতে তাকিয়ে আছেন।শিলিগুড়ি যাব বলতেই ড্রাইভার বাম হাতে দরজা খুলে দিলেন।ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম।গাড়ীতে বসে জানলাম ভাড়া গাড়ী নয়।এক আত্বীয়ের পাঠানো ব্যক্তিগত গাড়ী। কার্শিয়ং যাবেন।ওখানে আদরের নাতনী কোন এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।তাকেই দেখতে যাচ্ছেন।
নতুন পিচঢালা কিন্তু অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তা পেয়েও দেখলাম গাড়ী একটা নির্দিষ্ট গতিতে চলছে।দুই ধারে বেশ ফাঁকা ফাঁকা বাড়ী ঘর।অনেকের বাড়ীর পাশের জমিগুলি এখনও অযত্ন অবহেলায় ছোট ছোট ঝোঁপ ঝারে ভরে আছে। আবার কেউ কেউ সখ করে তার কিছু অংশে চায়ের বাগানও গড়ে তুলেছেন। কিছু কিছু জমি পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নালার আর্শীবাদে ধানের চারা রোপনের জন্যে তৈরী করা হচ্ছে।
ঝোঁপ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়বে এরকম ছোট ছোট চা বাগান।
বেশ খানিকক্ষণ আসার পর একটা মোড় সামনে নিয়ে গাড়ীর গতি কমে গেল। কিন্তু থেমে গেল না।চার মাথার মোড়টির ওপাড়ের গাড়ীগুলি ময়নাগুরি শহর ছেড়ে আসছে।আমাদের গাড়ীটি বামে মোড় নিল।বাম রোড দিয়ে যে গাড়ীগুলি আসছে সেগুলি সোজা কোনটি আসাম,কোনটি মেঘালয় আবার কোনটি ত্রিপুরা,মণিপুর,মিজোরাম যাচ্ছে।লোকাল,ডিস্ট্রিক,আন্তঃদেশীয় সব ধরণের গাড়ীই এ রোডে চলছে। অতএব রাস্তাটি অসম্ভব ব্যস্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাঝে মাঝে পেছনে বসা মহৎ ব্যক্তিটির সাথে ব্যক্তিগত,দেশীয় অনেক বিষয়েই আলাপচারিতা চলছে।লোকটি একদিকে স্বজ্জন,অন্যদিকে শিক্ষিত। ছিটমহল,তিনবিঘা এসব অনেক কথায় নিজস্ব মতামত অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তুলে ধরছেন। তিস্তার কথা উঠতেই ড্রাইভার গাড়ীর গতি একেবারে কমিয়ে দিলেন।গাড়ীটি তখন একটা ব্রীজ পাড় হচ্ছে। ড্রাইভার বললেন এটাই তিস্তা ব্রীজ। তাকিয়ে দেখি নীচ দিয়ে প্রবাহমান কালের সাক্ষী এই ভরা বর্ষায়ও শুষ্ক প্রায় তিস্তা নদী।
ব্রীজের নীচে এ্রই ভরা বর্ষায়ও শুষ্ক প্রায় তিস্তা নদী।অদূরেই আরেকটা রেল সেতু।
ব্রীজ থেকে কাছেই একটা রেল সেতু। এর অল্প কিছু সামনেই গজল ডোবায় তিস্তা ব্যারেজ।যেখানে তিস্তার প্রবাহ আটকিয়ে দিয়ে অসংখ্য ক্যানেলের মাধ্যমে তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কৃষি ক্ষেত্রে,চা বাগানে, আম-লিচু-কমলার বাগান পরিচর্যায়,শিল্প কারখানার বর্জ্য ধৌতকরণ কার্যে।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই বাম পাশে একটা শহর দৃশ্যমান হ’ল। ড্রাইভার বলল এটাই জলপাইগুড়ি শহর।হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম।শ্যামলী গাড়ী সেই বর্ডারে থাকতেই আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে আগেই বলেছি। এখন সেই শ্যামলী গাড়ীটিই আমাদের সামনে। ব্যাখ্যা এটাই, সেদিন ছিল শিবের মাথায় জল ঢালার অনুষ্ঠান।রাস্তায় প্রচুর পূণ্যার্থী।চলছিল তিস্তায় স্নান পর্ব।সে জন্য ঐ অংশে জ্যামও লাগতে পারে।সুখের বিষয় আমরা পাইনি।
হঠাৎ রাস্তায় জায়গায় জায়গায় চেকপোষ্টের মত মনে হ’ল। সাভারের মত রাস্তার ধারে নিরাপত্তা বাহিনীর আবাসিক ক্যাম্প চোখে পড়ল।ড্রাইভার বলল রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয় বাংলাদেশের বর্ডার।চেংড়াবান্ধার মত বাংলাদেশে প্রবেশের আরেকটা স্থল বন্দর সামনে। নাম ফুলবাড়ী। বন্দরটি দেখার জন্য সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লাম।
উপরের ছবিতে মোটর সাইকেলটি বাংলাদেশ বর্ডারের দিকে যাচ্ছে। আর গরুটি যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে চেংড়াবান্ধা থেকে আসলাম।
ফুলবাড়ী থেকে শিলিগুড়ি শহরের জিরো পয়েন্ট মাত্র ১৩ কিলোমিটার।অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে শিলিগুড়ি শহরের জিরো পয়েন্ট মাত্র ১৩+১=১৪ কিলোমিটার।বাংলাদেশ থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরের শিলিগুড়ি শহর যেতে চেংড়াবান্ধা থেকে প্রায় ৭০-৭২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেড় ঘন্টা লাগল ফুলবাড়ী আসতে।
বাংলাদেশ বর্ডার যাব বলতেই রিক্সাওয়ালা ১৫ টাকা ভাড়া চাইল। উঠে বসলাম।
(চলবে)