হাসুনির মার শরীরটা ভাল নেই।তবুও নিয়ম মতই তার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ আগে।দূরে হাল চাষে রাখালের ডান-বাম নিশানার মৃদু কন্ঠ ভোরের কুয়াশা ভেদ করে কানে বাঁজছে। কোন এক বাড়ীর বউঝির ঢেঁকির শব্দও কানে আসছে অবিরত। কিন্তু শরীরের দূর্বলতায় শীতের আয়েশি ভাবটা যেন তাকে বিছানায় আঁকড়ে বেঁধে রেখেছে। কেউ টেনে তুলতে চাইলেও উঠতে ইচ্ছে করছে না।শরীরের এ কেমন বিদ্রোহ! মেয়ে হাসুনি মায়ের বুকের মধ্যে যতটুকু পারে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে। দু’চালা খড়ের ঘরে পাশের রুমে সবুজ উচ্চ কন্ঠে কোন একটি পড়া ঠোঁটস্থ করে যাচ্ছে,রোজই করে। শেষ রাতের পড়াটা ওর মনে ধরে বেশি। সারা দিনের হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পর রাতের পড়ায় ইচ্ছে থাকলেও বেশিক্ষণ চোখের পাতার সায় থাকে না। তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে শেষ রাতে উঠবে বলে।উঠেও তাই। আলো ফুটলেই ছুটতে হবে জীবিকার খোঁজে। আবার সকাল দশটার মধ্যে ক্লাসেও হাজিরা দিতে হবে।রেজিষ্টেশনের টাকাটা দুঃখিনী মায়ের ছেঁড়া পুঁটলি আঁচড়িয়ে জুটেছিল।কিন্তু ফরম পূরণেরে এতগুলো টাকা কিভাবে যুটবে? তার উপর মায়ের শরীরটাও আর আগের মত যাচ্ছে না।প্রায়ই স্কুল থেকে ফিরে দেখে মা’য় কাজ থেকে ফিরে অসুখ নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।হয় জ্বর নয়ত মাথা ব্যথা।
বাবা গত হয়েছেন প্রায় ছ’বছর।তখন হাসুনি পৃথিবীর আলোই দেখেনি।সবুজ লেখাপড়াতে উঁচুমানের নয় আবার নিম্নেও নয়।কোন বিষয়ে খুব বেশি নম্বর পেয়ে কাউকে চমকে দেয়নি। আবার কোন বিষয়ে ফেল করে ক্লাসে হাসির পাত্রও হয়নি।গরিব পিতার রেখে যাওয়া এক চিলতে ভিটে।তারই বৃহদাংশ জুড়ে খড়ের ঘরটি।পিছন ঘেঁষেই পাশ আঙিনার গোয়াল ঘর।গরুগুলোর হাকডাক আর বাছুরগুলোর আর্তচিৎকারের নিত্যকার আবহে সবুজের হুঁশ হল ভোর হয়েছে।
-ওমা,মা।উঠবা না?
-উঠছি তো বাবা।আয় দরজা ভেজানো দেখ।
সবুজ ঘরে ঢুকে দেখে মা তখনও মোটা কাঁথার মধ্যে লুকিয়ে।ভর শীতেও লেপের ভাগ্য হয় না।মোটা কাঁথাটিই পুরোনো শাড়ীর কভারে পেঁচিয়ে লেপের জৌলুস মেটানো আরকি।
-মা, তোমার জ্বরডা কি আবার আইছে? বলেই কপালে হাত বুলায় সবুজ।
-নারে বাপ,তয় শরীরডা ক্যামন যেন ম্যাজম্যাজ করতাছে।
-আজও তোমার কাজে যাওনের কাজ নাই।
-তুইকি এহন ভাটায় যাবি?
-হঁ মা,ওরা বারোটা তুরিক খাটতে কয়। নতুন ম্যানেজার অনেক ভালা মানুষ। আমার ক্লাসের কথা হুনে কয় “তুই যখন ক্লাস ধরতে পারবি বলে মনে করস তখনই চলে যাস।”তয় আসার আগে তারে কয়ে আইতে হইব।আর কইছে আমারে সবার থেইক্যা বিশ টাকা করে কম দিব।
-সে দিক তবু কাজটা থাউক।
-তয় কয়ডা কড়কড়া ভাত খাইয়া যা।
-খামু,চিংড়ি বাটা দাও।
-লয়ে খা। বাত্তিটা আনে ল’,ঘরে তো আঁধার।
-নিভাই দিছি।
-ক্যান ত্যাল নাই?
-রাইতে লাগব না?
বলেই সবুজ দরজাটা খুলে দেয়। বাইরের হালকা আলোয় ঘরটা কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠে।
-ভাই,শীত আহে তো। মাথা উঁচু করে বলে হাসুনি।
-এ বুড়ি খাঁড়া। ভাত কয়ডা লয়ে লই।
সবুজ সানকিতে কয়টা ভাত নিয়ে দরজা মিলিয়ে দিয়ে চৌকাঠের ওপারে খেতে বসে।কি মনে করে উঠে গিয়ে টেবিল থেকে উপুড় করা বইটি এনে দু’পলক দেখে আবার বন্ধ করে পাশে রেখে দেয়।
-কিরে বাপ,খাওনের সময় মানুষ বই পড়ে? সবুজের মা কাছে বসতে বসতে বলে।
-না মা,মাঝখানের লাইনডা ভূলে গেছিলাম। তয় এই শরীরে তুমি উডে এলে ক্যান?
-বাপরে,তোর ফরম পূরণের লাইগা কত টাহা লাগব কইছিলি?
-তের’শ পঞ্চাশ টাহা।
-এত টাহা?
-পাঁচ মাসের বেতন বাহি আছে না!
-রে-বাপ, কিছু মাফ করান যায় না?
-গফুর স্যার ঢাকায় গ্যাছে। থাকলে কইতাম। কিন্তু মাফ করার পর বাকীটা তো দিতে অইব,সে টাহা কই?
-সামনের হপ্তায় বিল পাবি না?
-তোমার সংসারে খরচ আছে না?
-গেল হপ্তার গোছানো টাহাও তো নিলি।
-ক্যান তোমার ওষুধ আনলাম না।
-আনতে গেলি ক্যান? কইলাম না আমার অসুখ এমনিতেই ভালো অইব।
-ওষুধ খাইয়ে ভাল করতে পারি নে,এমনিতেই ভালো অইব! হাসি পায়
-তয় এত টাহা পাবি কই?
- আগে তুমি সুস্থ হও মা তোমাকে বিছনায় শুয়ে রেখে পরীক্ষার হলে ঢুকতে চাইনে। ওই সাট্টিফিকেট আমার দরকার নাই।
ছেলের কথা শুনে হাসুনির মা ঝর্ঝর্ করে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে এগালে ওগালে কপালে চুমু খেতে থাকে। মায়ের কান্দনে সবুজও চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। নিজেকে মুক্ত করে হাত ধুয়ে মাকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
ততক্ষণে হাসুনি উঠে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। হরিণের চাহনীতে একবার মা আরেকবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মা-ভাই কারও ভাষাই সে বুঝতে পারে না।
-আমি যাই মা। রাতে বলছিলে মরিচ লাগব,পেঁয়াজ আছে তো? মা কোন কথা বলে না কেবলি ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক এমন সময় দরজায় একটা ছায়া মূর্তি দেখে সবাই তাকায়।
-দেখ,দেখ সাত সকালেই তোর মামা আইছে। বইতে দে।
-না হাসুনির মা, বইব না। ক্ষেতে যাচ্ছিলাম।ভাবলাম নিজ হাতে দিয়ে যাই। গত রাইতে কয়খান কাপড় আইছে। অনেক ভাগ হইছে। কিন্তু তোমাদেরটা ঠিকই আছে। আপন বলতে তো তোমরাই আছো, নাকি? বলতে বলতে রেকেন মেম্বার ঘরে ঢুকে যায়। হাতে পলিথিনে মোড়ানো তিনখানা কাপড়।
-কিরে সবুজ, তোর টুলখানা আইনা দে। ভাইজান বসুক। সবুজ দৌড়ে টুল এনে দেয়।
-না রে পাগলি সবাই দেখে ফেললে ঘিরে ধরবে। একটা তুই নিয়ে বেলীর মা আর কুদ্দুসের বউকে বাকী দুইটা দিয়ে দিস। বলে নিজেই পলিথিনের পুটলিটা চৌকির নিচে আঁধারে ঢিল মারে।
-ভাইজান,বাসি মুখে একখান কথা কমু। কিচ্ছু মনে লয়েন না।
-শাড়ীর কথা কিন্তু বলবিনে। চাইছিলি, দিলাম।
-শাড়ী পারলে আর কাউকে দ্যান। এর থেইকাও বেশি দরকার আমার। বিপদটা আপনাকে দেখতেই অইব। আমার শরীরডা ভাল না। হপ্তা হ’ল কাজে যাইতে পারি না। আমার পোলাডার ফরম পূরণের ডেট অইছে। আমি গরিব মানুষ অত টাহা কই পামু? আপনার পোলারও তো অইব। ওর বাপ বাইচে থাকলে তো আপনাকেই কইতো। আপনার জমির কাইজ্জেয়ইতো লোকটা খুঁড়া অইছিলো।
-শোন পাগলি তোর শাড়ী তোরই থাউক। কইছি না। তোরা ছাড়া আমার আপন আর কে আছে, বল? যা পাই তাতো তোদেরকেই দিই। আমিতো আর খাই না। ডেট আসুক তোর ছেলেরও ফরম পূরণ হইব। তুই কইছস,আমি দেখব খন চিন্তা করিস না। কিরে সবুজ,মন দিয়ে পড়ালেখা কর,কেমন। সবুজের মাথায় হাত বুলিয়ে মেম্বার বের হয়ে যায়।
-দেখছোস বাবা, আজ কি দেখে যে ঘূমটা ভেঙ্গেছিল! সকাল বেলায়ই সাক্ষাৎ ফেরেস্তা আইসা হাজির। ভোটটা নিজে দিই আর দশজনকে দেওয়াই কি এমনেই?
-হ,একেবারে ফেরেস্তা।কি সুন্দর মিডা ভরা কথা। উনার মতন মেম্বার কয়জন হয় কও? মা আমি গেলাম। বলেই ইট টানার পিঁড়িটা নিয়ে সবুজ বের হয়ে যায়।
দিনটি বৃহস্পতিবার,সপ্তাহের শেষ দিন। সেই সাথে স্কুলে ফরম পূরণেরও শেষ দিন। মেম্বার সাহায্য করবে সেই ভরসায় গত দু’সপ্তাহের বিল থেকে জমানো টাকার কিছু অংশ দিয়ে সবুজ মাকে সদরের ডাক্টার দেখিয়ে ওষুধপত্র কিনে দিয়েছে। সকালে গিয়ে মেম্বারকে বাড়ী পায়নি। কিন্তু সাড়ে নয়টায় আবার যখন যাওয়া তখন দেখে মেম্বার ভাত খাচ্ছে। সবুজকে দেখে বসার ঘরে বসতে বলে। কিছুক্ষণ পর হাত মুছতে মুছতে মেম্বার প্রবেশ করে।
-হুঁ বেটা বল।
-মামা, আজকে স্কুলে ফরম পূরণের শেষ দিন।
-হ্যাঁ, মনে আছে। তয় তোমার বাকী কত?
-পাঁচ মাসের বেতনসহ তের’শ পঞ্চাশ টাহা।
-কয় টাকা গোছাইছো?
-ছ’শ পঞ্চাশ টাহা।
-সেকি? অর্ধেকটাও পারোনি?
-হতো, কিন্তু মা’র কিছু দিন থেকে খুব অসুখ যাচ্ছে।
-তয় জীবন আগে না পরীক্ষা আগে? বাপটা নাই,মা মরে গেলে সাট্টিফিকেট কি ধূয়ে মুছে খাবা?
-সদরের ডাক্টার দেখিয়েছি। বলেছে ভয়ের কিছু নেই। ওষুধগুলো নিয়ম মত খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
-আচ্ছা দাও দেখি,আর বাড়ীতে গিয়ে দেখ আর কিছু হয় নাকি। এত অল্প টাকায় ফরম পূরণ হবে? আমার হাতের অবস্থাটাও খুব ভাল নেই। কাগজপত্র নিয়ে স্কুলে যাও আমি আসছি।
সবুজ অপরাধীর মত টাকাগুলো মেম্বারের হাতে দিয়ে বের হয়ে যায়।বেড়ুনোর সময় মনে হ’ল কে যেন দরজার ওপাশ থেকে সরে গেল।
সাড়ে এগারটা বেজে যায় মেম্বারের দেখা নেই। বারোটার সময় মেম্বার যখন রোড থেকে স্কুলের গড়ান নামে পিছনে পিছনে মেম্বারের ছেলে ও ভাগনে। দু’জনেই এবার সবুজের সাথে এস এস সি দিবে। মেম্বারকে দেখে সবুজ যেন প্রাণ ফিরে পায়। দৌড়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
-ওঁ তুমি এসেছো?
-জি মামা, ছবি, কাগজপত্র সবই এনেছি।
-আচ্ছা তুমি ওখানটাতে বসো। একটা একটা করে শেষ করে আসি।
শেষ দিন হওয়ায় আজ ছাত্রছাত্রীর চাপটা বেশি। সাথে কারও কারও অবিভাবকও এসেছেন। আর শেষ দিনটাতেই আবেদন আবদার মেটানো হয় বেশি। সবুজ মেম্বারের দেখানো পুকুরপাড়ের বটগাছটার বাঁধানো বেদীতে গিয়ে বসে। বেদী থেকে অফিস রুমটা স্পষ্ট দেখা যায়। আজও সবুজ ভোর বেলায় ভাটায় গিয়ে ইট টেনেছে। ঘামের গন্ধটা এখনও আছে। ক্লান্ত শরীরটা পুকুরপাড়ের ঝিরিঝিরি বাতাসে কখন যে ঘুমের কোলে নেতিয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি। যখন চেতন হ’ল দেখে স্কুলটা অনেকটাই ফাঁকা। অফিস রুমটাতেও আগের মত ভীড় নেই। কিন্তু ভেতরে জনাকয়েকের মধ্যে উচ্চ স্বরে কথা কাটকাটি হচ্ছে।
-ছেলেটার বাপ নেই, এতিম। মা টাও অসুস্থ। মাষ্টার সাহেব ওকে আপনাদের দেখতেই হবে। বলছে মেম্বার।
-সে তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু আপনার ছেলে আর ভাগনে তো এতিম নয়। তাদের কাজটাই তো আগে করে নিলেন। যে আসলেই পাওয়ার যোগ্য তারটা আনছেন শেষে। বলেন হেড মাষ্টার।
-আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।
-মান থাকলে না হয় তাকে অপমান করা যায়।
-ওইতো সবুজ এসেছে। দেখ বাবা উনারা কি রকম কথা বলছে। বলতে বলতে মেম্বার সবুজকে ঠেলে অফিস রুম থেকে বের করে নিয়ে যায়।
-মামা কি হয়েছে?
-তোর বাবা বেঁচে থাকলে এই অপমান কি সহ্য করতো? তুই তার ছেলে যার বীরত্বের কথা দুই চার গ্রামের সবাই জানে। চল তোর ফরম আমি পরিষদে বসে পূরণ করব। মাষ্টারকে ওখানেই যেতে হবে।বললুম, বলতে বলতে মেম্বার সবুজকে রোডের গড়ান অবধি ঠেলে নিয়ে যায়।
-আস্সালামু আলাইকুম স্যার। সবুজ সালাম দিয়েই থমকে দাঁড়ায়। ডান হাতে একটা ব্যাগ ধরে গফুর স্যার গড়ান বেয়ে নামছেন।
-কি সবুজ, শরীর ভালো? নাও ব্যাগটা ধর।সবুজ ব্যাগটা নিয়ে স্যারের পিছু পিছু হাটতে থাকে।ঘটনার আকস্মিকতায় মেম্বার কেবল পিছন ফিরে চেয়ে চেয়ে দেখে।
স্কুলের পুকুর পাড়ের পশ্চিম পাশটা ঘেঁষে গফুর স্যারের ভাড়া বাড়ী। ঘরে ঢুকে জামা কাপড় সবে ছেড়েছেন। এমনি সময় পিয়নটা বোরকা পরিহিত একজন মহিলা সমেত হাজির।
-আস্সালামু আলাইকুম স্যার।
-হ্যাঁ, বরকত এসো। সালামের উত্তর দিয়ে বলে গফুর স্যার।
-(সবুজকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে) আপা এই ছেলেটা না? সবুজ তখনও মুখটা ভাড় করে সোফার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
-মামী, আপনী এখানে? চিনতে পেরে বলে সবুজ।
-আচ্ছা ভাই আপনী যান। বরকতকে বলে আগন্তুক মহিলা।
-আচ্ছা, বলে বরকত চলে যায়।
-স্যার, গঁয়েস পাড়া গ্রামের রেকেন মেম্বার আমার স্বামী। আমি সবুজের ফরম পূরণের টাকাটা দিতে এসেছিলাম। বলেই দু’খানা পাঁচ’শ টাকা ও চারখানা এক’শ টাকার নোট সবুজের হাতে গুণে দেয়।
-কি সবুজ,তোমার ফরম এখনো পূরণ হয়নি? সাড়ে তিনটা তো বাজতে চলল! একরাশ আশ্চর্য নিয়ে তাকায় গফুর স্যার।
-চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো। আপা আপনী একটু বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি।
-না স্যার, আমার একটু অসুবিধা আছে। শুধু অনুরোধ টাকাটা আমি দিয়েছি কাউকে বলবেন না। সবুজ,আমি আসছি।
গফুর স্যার অফিসে পৌছে সবুজের ফরম পূরণের উদ্যোগ নিতেই প্রধান শিক্ষক মহোদয় ঘটনাটা ভেঙ্গে বললেন।
-স্যার উনার মাথায় কিছু সমস্যা আছে। এর আগেই একবার বুঝেছি। কথাটা বলে গফুর স্যার বিষয়টি হালকা করে দিতে চাইলেন।
-সবুজ তোমার কাজ শেষ। এবার নিশ্চিন্তে বাড়ী যাও। আর মেম্বারের স্ত্রীর কথাটা মনে রেখ। গফুর স্যার পাঁচশ টাকার একটা নোট সবুজকে ফেরত দিতে দিতে বলেন।
সহজ সরল সাদাসিদে গোছের ছেলে সবুজ। ঠিক বাবার মত। অল্প বলতেই যা-তা,যাকে-তাকে বিশ্বাস করে ফেলা। তফাৎটা কেবল মেজাজে। বাপটা অন্যায়ে মেজাজটা ধরে রাখতে পারত না। ছেলেটা তা নয়।
সবুজ ইতিমধ্যেই দু দু’বার পাঁচ’শ টাকার নোটটা পকেট থেকে বের করে দেখে নিয়েছে। যার টাকা তার হাতে ফেরত দিয়ে সে বাড়ী ফিরবে মনে এটাই সংকল্প। সেই সকালে মায়ের হাতে কয়েক মুঠো ভাত খেয়েছে। স্কুলের বট বেদীতে ঘুমের ভাবটা কেটে গেলে ক্ষুধাটা একবার জেগেছিল। এরপর যা ঘটেছে তা দেখে হয়ত ক্ষুধাটাও লজ্জায় পালিয়েছে। রেমেন মেম্বারের বাড়ীটার সামনে দিয়ে গ্রামের একমাত্র মেঠো সড়ক গিয়ে পাকা সড়কে মিশেছে। ডানপাশটা ঘেঁষে অপেক্ষাকৃত নীচু ভূমি। পিছনে একটা মাঝারি গোছের ডোবা। বাড়ীর লোকেদের এখানটাতেই চলে গোছল আত্তি। পিছন দিকটা দিয়েও বাড়ীতে ঢোকার রাস্তা আছে। সবুজের বেশ চেনা। মেম্বার বাড়ীতে আছে এই ধারণায় সবুজ পিছন দিকটা দিয়েই বাড়ীতে ঢুকতে চায়। তাছাড়া বাড়ীর মহিলাদের পেছনের আঙ্গিনার সাথেই বেশি সখ্যতা থাকে। ওখানেই মামানীকে পাওয়া যাবে।
-মামী! পিছনের রান্না ঘরটা ভেঙ্গে নতুন করা হচ্ছে। এর কালি ঝুলির মধ্যেই সবুজ মেম্বারের স্ত্রীকে পেয়ে গেল।
-কিরে,কাজ হয়েছে? আর পিছন দিয়ে আসছিস কেন,মামার ভয়ে?
-মামানী সব টাকা লাগেনী, নয়’শ টাকায়ই হয়ে গেছে। বলেই নোটটা বের করে এগিয়ে দেয়।
-কাছেই রাখ। পরীক্ষার হলে যেতে আসতে লাগবে। তোর টাকাটাও তো তোর মামা ফেরত দেয়নি না? (সবুজ মেম্বারের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়।) বাড়ী এসে আবার কোথায় যেন গেল, আদায় করে কাছে রাখবনে। লজ্জা করিস না,মনে করে পরে এসে নিয়ে যাস। তোর মুখ দেখেই মনে হচ্ছে এখনও কিছু খাসনি। যা দেখগা তোর মা’টাও এখনও মুখে কিছু দেয়নি। শোন তোকে একটা কথা কয়ে দিই। সমাজে এক ধরণের লোক আছে যারা সাহায্যের নামে মানুষকে আরও সাহায্য প্রত্যাশী করে রাখতে চায়। কিন্তু যে সাহায্যটা করলে মানুষের আর হাত বাড়ানোর দরকার হয় না সেই সাহায্যটা তারা করতে চায় না।(কথাটা শেষ হতেই সবুজ মেঝে মাড়িয়ে মেম্বারের স্ত্রীর পায়ে পরে ভক্তি ভরে সালাম করে। উঠতে গিয়ে বামপাশের থামটা ধরতেই তা মাঝ থেকে একদিকে বেঁকে ভেঙে পড়ে। অনেকগুলো ঘুণ পোকা মাটিতে পড়ে ছড়িয়ে পরে।) দেখছোস খামটা বাইর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল ভাল আছে। ঘুণ পোকা কিভাবে খামটাকে শেষ করে দিয়েছে। সমাজটাকেও এই ঘুণ পোকায় শেষ করে দিচ্ছে। মায়কে এক্ষুনি কিচ্ছু কোস না। কষ্ট পাইব। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে পরীক্ষাটা ভাল করে দে।তোরাই তো সাগর সেঁচা মুক্তা রে। যা বাড়ী যা। সবুজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কেঁদে ফেলেন মেম্বারের স্ত্রী। সবুজের চোখে তখন কেবল পানি আর পানি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৪ রাত ১১:০৪