আপনার কাছে পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী ?
নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার পরই মা,যিনি আমাদের জন্মের পর থেকে আগলে রাখেন সকল প্রতিকূলতা থেকে।মায়ের মত সুন্দরবন বছর বছর বাংলাদেশকে সিডর আইলার মত মহাদূর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে।সেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।সুন্দরবনের পরিবেশ,নদী,বাঘ-কুমিরের বাসস্থান বিপন্ন করে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছে গত ২০এপ্রিল ২০১৩ তে।সুন্দরবন থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট জেলার রামপালে ইতিমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে মাইদারা খালে মাটি ভরাট করা হচ্ছে।মংলা বন্দরের নিকটবর্তী রামপালে কয়লা পরিবহন সুবিধাজনক শুধুমাত্র এ বিবেচনায় পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের পাশে এই প্রকল্পের স্থান নির্ধারণ করা হয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন চাই নাঃকয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দূষণের মাত্রা সর্বাধিক।কয়লা পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ছাই,কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস সুন্দরবনের মাটি-পানি স্থায়ীভাবে দূষিত করবে।বনের ভেতর দিয়ে কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশে নষ্ট হবে,এসিড বৃষ্টির সম্ভাব্যতা বাড়বে।বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মিঠা পানির পরিমাণ মেটাতে গিয়ে মরে যাবে পশুর নদী,বাড়বে খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা।বাঘ-কুমির-পৃথিবী বিরল ইরাবতী ডলফিন হারিয়ে যাবে,বাদাবন ধ্বংসের ফলে দূর্বল হয়ে পরবে উপকূলীয় দুর্যোগের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন ।
অসম চুক্তি এবং প্রকল্পে অস্বচ্ছতাঃপ্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগ ১৫% হলেও লাভের ৫০% কিন্তু ঠিকই তারা লুফে নিয়ে যাবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে কৃষি ও পরিবেশের উপর প্রভাব: কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ৬৬০ মেগাওয়াটের দুইটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট থাকবে। প্রথম ইউনিটটি নির্মাণের জন্য ৪৮ মাস বা চার বছর এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি শেষ হতে আরো ৬ মাস বাড়তি অর্থাৎ মোট সাড়ে ৪ বছর সময় লাগবে। এই সাড়ে চার বছর সময় জুড়ে গোটা এলাকার পরিবেশ, কৃষি, মৎস ও পানি সম্পদের উপর নিম্ন লিখিত প্রভাব সমূহ পড়বে: ১) রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৮৩৪ একর কৃষি, মৎস চাষ ও আবাসিক এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে যদিও ভারতে একই আকারের একটি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৭৯২ একর যার বেশির ভাগটাই এক ফসলি কিংবা অনুর্বর পতিত জমি।(রায়গড় ইআইএ, এক্সিকিউটিভ সামারি, পৃষ্ঠা ১)। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার(১৮৩৪ একর) ৯৫ শতাংশই কৃষি জমি ও চারপাশের ১০ কিমি ব্যাসার্ধের এলাকার(স্টাডি এলাকা) ৭৫ শতাংশ কৃষি জমি যেখানে নিম্নোক্ত হারে চিংড়ি অথবা ধান সহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা হয় (পৃষ্ঠা ১৩৫, ১৯৪, ১৯৭, ১৯৮, ২০৪) :
ক) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ ব্যাসার্ধের মধ্যে বছরে ৬২,৩৫৩ টন এবং প্রকল্প এলাকায় ১২৮৫ টন ধান উৎপাদিত হয়;
খ) ধান ছাড়াও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ ব্যাসার্ধের মধ্যে বছরে ১,৪০,৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়;
গ) প্রতি বাড়িতে গড়ে ৩/৪টি গরু, ২/৩টি মহিষ, ৪টি ছাগল, ১টি ভেড়া, ৫টি হাস, ৬/৭টি করে মুরগী পালন করা হয়;
ঘ) ম্যানগ্রোভ বনের সাথে এলাকার নদী ও খালের সংযোগ থাকায় এলাকাটি স্বাদু ও লোনা পানির মাছের সমৃদ্ধ ভান্ডার। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খাল ও নদীর নেটওয়ার্ক জৈব বৈচিত্র ও ভারসাম্য রক্ষা করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে বছরে ৫২১৮.৬৬ মেট্রিক টন এবং প্রকল্প এলাকায় (১৮৩৪ একর) ৫৬৯.৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়।
ইআইএ রিপোর্টে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প এলাকায় (১৮৩৪ একর) ধান, মাছ, গৃহপালিত পশুপাখি ইত্যাদির উৎপাদন ধ্বংস হবে স্বীকার করে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, সঠিক পরিবেশ ব্যবাস্থাপনা অনুসরণ করা হলে এর বাইরের ১০ কিমি এলাকার মধ্যে কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না(!)। যদিও বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজ, ড্রেজিং, বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক ও তৈল নি:সরণ ইত্যাদির ফলে পশুর ও মাইদারা নদী, সংযোগ খাল, জোয়ার-ভাটার প্লাবণ ভূমি ইত্যাদি এলাকার মৎস আবাস, মৎস চলাচল ও বৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বলে আশংকাও প্রকাশ করা হয়েছে।(পৃষ্ঠা ২৬৬, ২৬৭)
২) বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করা হবে। এর ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নি:সরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নি:সরণ ইত্যাদি পরিবেশ আইন অনুসারে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে ইআইএ রিপোর্টে আশংকা করা হয়েছে।(পৃষ্ঠা ২৬৮)
৩) প্রকল্পের জন্য ব্যবহ্রত যন্ত্রপাতি, যানবাহন, জেনারেটর, বার্জ ইত্যাদি থেকে তেল পুড়িয়ে ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। এই কার্বন ও নাইট্রোজের পরিমাণ কি হবে ও ক্ষীতকর প্রভাবই বা ৪/৫ বছরের নির্মাণ পর্যায়ে কিরুপ হবে তার কোন পর্যালোচনা ইআইএ রিপোর্টে করা হয় নি।
৪) নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি ও যানবাহন ব্যাবহারের ফলে শব্দ দূষণ হবে। এক্ষেত্রেও নির্মাণ পর্যায়ে শব্দ দূষণের মাত্রা এবং সুন্দরবন ও প্রকল্পের চারপাশের পরিবেশের উপর কি প্রভাব পড়বে তা যাচাই করা হয় নি ইআইএ রিপোর্টে।
৫) নির্মাণ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরণের কঠিন বর্জ্য তৈরী হবে যা সঠিক পরিবেশ ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিবেশ এর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে আশংকা করা হয়েছে;
৬) নির্মাণ স্থলের নিকটবর্তি নদী-খালের পানিতে নির্মাণ যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের তেল নি:সরিত হয়ে পানি দূষণ ঘটাতে পারে।
৭) ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হবে। ড্রেজিং সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তেল গ্রীজ ইত্যাদি নি:সৃত হয়ে নদীর পানির দূষিত হবে।
৮) পশুর নদীর তীরে যে ম্যানগ্রোভ বনের সারি আছে তা নির্মাণ পর্যায়ে জেটি নির্মান সহ বিভিন্ন কারণে কাটা পড়তে পরবে। নদী তীরের ঝোপঝাড় কেটে ফেলার কারণে ঝোপ ঝারের বিভিন্ন পাখি বিশেষ করে সারস ও বক জাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে।
(সূত্র: রামপাল ইআইএ, Impacts: pre-construction and construction stages , পৃষ্ঠা ২৬৩-২৬৮)
যখন সুন্দরবনের শেষ গাছটা মরে যাবে,পশুর নদীর শেষ বিন্দু জল বিষাক্ত হয়ে যাবে,শেষ মাছটা নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মরে ভেসে উঠবে,তখন আমরা বুঝতে পারবো আমরা শুধু টাকা খেয়ে বাঁচতে পারিনা,শুধুমাত্র বিদ্যুৎ দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারিনা।কিন্তু একবার সুন্দরবন মরে গেলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ যে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না,দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষ খাবার পানি পাবেনা,ঢুকবে ধানের জমিতে লবণ পানি,বছর বছর গড়ে যে ১৫-২০টা ঘুর্ণিঝড় উঠে সেটা আর মিয়ানমার বা উড়িষ্যার উপর দিয়ে যাবেনা,সব বাংলাদেশের বুক চিড়ে বেড়িয়ে যাবে।এতকাল কাঁদত ভোলা,মনপুরা,হাতিয়া,সন্দীপ,বরিশাল,উড়িরচর,বরগুনার মানুষ।কিন্তু সুন্দরবনের কিছু হলে ঘুর্ণিঝড়ের ছোবল ধ্বংসস্তুপ রেখে যাবে সারা বাংলাদেশ জুড়ে।আজ এক সাভারে যখন সমগ্র দেশ টালমাতাল,তখন লক্ষ সাভারে এই দেশের কি হবে একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখেছেন কি?আপনি কী এখনও চুপ করে বসে থাকবেন?এখনও কি রামপালের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন,আর দুইহাত পায়ে তালি দিয়ে,শিস বাজিয়ে বলবেন বাহ দেশ তো আমার বেশ এগিয়ে যাচ্ছে!তাইলে তালি দেয়ার ওই দুইহাত পা,আর শিস দেয়ার ওই কালো ঠোঁটদুটি ভবিষ্যতের জন্য বাঁচিয়ে রাখুন।কোন এক রোদজ্বলা দুপুরে,নিজবাড়ি অথবা নিজ কর্মক্ষেত্রের নিরাপদ দালানের অন্ধকার কোন প্রকোষ্ঠে,ইট-বালি-সিমেন্টের নিচে যখন দুমড়ে মুচড়ে পরে থাকবেন,তখন প্রতিবন্ধী ওই হাত পা এবং জমাট বাঁধা রক্তাক্ত ওই ঠোঁটদুটোই যা একটু প্রতিরোধের ভরসা দিবে।
বিঃদ্রঃ “পৃথিবী খারাপ মানুষের কাজের জন্য ধ্বংস হবে না, ধ্বংস হবে তাদের জন্য যারা খারাপ মানুষের কাজ দেখে কিন্তু কিছু করে না” - আলবার্ট আইনস্টাইন
তাই প্রিয় দেশবাসী, আসুন আমরা সবাই একসাথে আমাদের গর্ব,বিশ্ববাসীর গর্ব,বাংলাদেশের উপকূল ও উপকূলবাসী লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ষ্যাকবচ পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে ধংসের এই চক্রান্তকে রুখে দেই যেকোন মুল্যে।রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন শুনুক সারা বিশ্ব আর লেজ গুটিয়ে পালাবে তখন বিদেশী রাষ্ট্র ও তার তাঁবেদার চক্রান্তকারীরা ।