সন্ধ্যা নদীর ঠিক পাড়েই আমাদের বসত ভিটা।
ছোটবেলা জ্ঞান হবার পর থেকেই নদীর সাথে যেন আত্নার সম্পর্ক। বাবা ইলিশের ব্যবসা করতেন। আমাদের বড় নৌকা নিয়ে তিনি ভোর হতেই চলে যেতেন আড়তে। তার আরও দুটি নৌকা ছিল। সেগুলোতে জেলেরা কামলা হিসেবে মাছ ধরার কাজ করতো। দিন হিসেবে মজুরি। আমাদের বাড়ির মেয়ে-ঝিয়েরা রান্নাবান্না ও দৈনন্দিন ঘর গৃহষ্থালীর সব কাজেই ছিল সন্ধ্যা নদীর ওপর নির্ভরশীল। ছোট বাচ্চাদের নোংরা করা কাঁথা, হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, রান্নার পানি আনা আর গোসল-সেতো আছেই। আমার ৬ বছর বয়স থেকেই ভর দুপুরে পাড়ার সব ছেলেদের সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার মতো শান্তি এ ধরায় আর খুঁজে পেতাম না। দিনভর সন্ধ্যা নদীর পাড় দিয়ে হাঁটাহাটি, নদীর বুক চিরে চলা ছোট-বড় নানা ঢংয়ের নৌকায় মানুষের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতেই যেন এক সময় বড় হয়ে উঠি। নদীর ওই পারে কুসুমপুর গ্রামে আমাদের স্কুল। ক্ষুদে পানসী নৌকায় ৫-৭জনের বাখকের দল আমরা বুকে বইখাতা চেপে ধরে স্কুলে যাই। আবার ছুটি শেষে পানসীতে চড়েই ঘরে ফেরা। মাঝে মাঝে ফেরার পথেই নদীতে ঝাপিয়ে পড়তাম। চলতো সাঁতার কাটার পাল্লা।
বর্ষাকালে সন্ধ্যা নদীর রাক্ষসীনি রুপ। জোয়ারের পানিতে চলিয়ে যায় আমাদের বাড়ি। ঘরের বিছানার উপরে আমাদের তখন অবস্থান। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, নদী যেন বেড়াতে এসেছে আমাদের ঘরে।
কালের আসা-যাওয়া আর সন্ধ্যা নদীর বুকে চলা অবিরাম জোয়ার-ভাটার টানে সময়ের ঘড়ি ঠিকই টিক টিক করে পার হয়ে যায় ২১টি বছর। আজ আমি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বরিশাল বিএম কলেজে, এরপর কলেজের গন্ডি পার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঈদের ছুটিতে এসেছি বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রাণদায়িনী ভালোবাসার প্রিয় মানুষ অতন্দ্রিলার বাড়ি নাটোরে। সে গেছে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে। নদীর পাড়ে বসে ভাবছি অতন্দ্রিলার কথা। আজ তীব্র জোছনা। জোছনার তীব্রতায় ভেসে যাচ্ছে সন্ধ্যা নদীর দু'কুল। রাত এখন প্রায় একটা বাজছে। আমার মনে পড়ছে কবি অমিয় চক্রবর্তীর রাত্রি' কবিতাটি।
অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা ছাওয়া এই বিছানায়
-সুক্ষ জাল রাত্রির মশারি-
কতো দীর্ঘ দু'জনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে-
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা-
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জোৎস্না
দেখি তুমি নেই।
জানি না ঠিক এ মুর্হর্তে কী করছে আমার অতন্দ্রিলা। সে কী ঘুমিয়ে পড়েছে? নাহ, কুয়েত-মৈত্রী হলের ৫ তলার ৫০৬ নম্বর রুমে থাকে অতন্দ্রিলা। রাত ২টা, ৩টা এমনকি মাঝে মাঝে ভোর ৪টা পর্যন্তও জেড়ে তাকে সে। আমাকে ফোন করে তাড়িত মনের চাপে। কথা হয় টুকটাক, এরপর খুনসুটি, মাঝে মাঝে ঝগড়াও। ঠিকই সকালে আবার সব ভুলে যায় সে। আমি এ ধরণের ঝগড়ার নাম দিয়েছি নিশিথ বিতর্ক পর্ব। এমনিদনের ঘটনা। দুপুর ১টা বাজে। আকাশ কালো করে নেমেছে মুষলধারে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে চমসকে উঠছে পৃথিবী। নীলক্ষেতের তেহারী দোকানে দুপুরে আজ আমার আর অতন্দ্রিলার একসঙ্গে খাওয়ার কথা। অথচ, বৃষ্টির রুমঝুম শব্দে মাতোয়ারা আমি ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেঠি অঘোরে।