খুলনার খালিশপুরের রোটারী স্কুল' খুবই নাম করা বিদ্যাপীঠ। ১৯৯৩সাল, আমি এ স্কুলের তখন নবম শ্রেনীর ছাত্র। সুমী আমার ক্লাসমেট। ডাগর ডাগর চোখ। সদ্য স্ফীত যৌবনের উন্মাদনায় কিছুটা বিপর্যস্ত যেনো। সুবিন্যস্ত তার কাপড়-চোপড়ের ভেতর থেকে উঠে আসতো নানা উন্মাদনা।
মেয়েরা এ স্কুলের সুবিশাল মাঠের দক্ষিণ অংশের ক্লাস রুমগুলোতে ক্লাস করতো। আর আমরা ছেলেরা উত্তর অংশে। স্কুলের একমাত্র টিউবওয়লেটি ছিল দক্ষিণ অংশে খুবই প্রাচীন এক তেঁতুল গাছের নিচে। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার একমাত্র ছুঁতো ছিল পানি খেতে কলতলায় যাওয়া। তাই ক্লাসে আমাদরে বন্ধু রাব্বী, জাহেদিয়া, আমি, সুমন, রনি.শাকিল আর নাহিনের একমাত্র কাজ ছিল একটু পর পর পানি খেতে যাওয়া। কল চেপে মেয়েদের গায়ে পানি ছিটিয়ে দেওয়া আর ওদের ক্লাসে সুযোগমতো উঁকিঝুঁকি দেওয়া। এভাবেই সুমীর সাথে আমার, নীলার সঙ্গে রাব্বীর, সুফিয়ার সঙ্গে জাহেদিয়ার, শাকিলের সঙ্গে শানুর একটু ভাব হয়ে উঠলো। আমাদের গ্রুপটি পানি খেতে কলতলায় গেলেই সুমীদের গ্রুপের সবাই হাজির হতো। এভাবে আস্তে-ধীরে ফুল বিনিময়, গিফট বিনিময় হয়ে গেলা।
কথায় বলে, একজনের সুখ নাকি অপরের সহ্য হয় না। ক্লাসের ক্লাসের কিছু দুষ্ঠু ছেলে ভীষণ বদরাগী অধ্যক্ষ আবু মোহাম্মদ আল ফারুকের কাছে নালিম করে দিলো। স্যারও একদিন সকাল থেকে বিষয়টি খেয়াল করলেন। তিনি টিফিনের পর চতুর্থ পিরিয়ডে কলতলায় এনে আমাদের সবাইকে একেবারে হাতেনাতে ধরলেন। সবাই প্রথমেই ছিলাম আমি। আর যাবো কোথায়? সুমীর সামনেই প্রথমে আমাকে ধরে জোড়া বেতের সপাসপ বাড়ি। তীব্র জ্বলুনি করে উঠলো সারা গা। স্যার একনাগাড়ে আমাকে পিটিয়ে তার রাগের ঝাল মেটালেন। আমাকে মারতে দেখেই বাকি সবাই দৌড়ে স্কুল থেকে পগার পার।
গায়ের তীব্র ব্যাথায় বাসায় ফিরে আসলাম। বিকেল না হতেই সারাগায়ে কাঁপুনি দিয়ে আসলো জ্বর। খুলনা মেডিকেল কলেজর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো আমাক। প্রথম দুদিন প্রায় অজ্ঞান অবস্থায়ই কাটলো। তৃতীয় দিনে কোছ মেলে দেখি চিন্তিত মুখে আমার মা পাশে বসে আছনে। চেয়ে আছেন আমার দিকে। দুপুরে দুধ দিয়ে জ্বাল দেওয়া সাগু খেতে দেওয়া হলো আমাকে। হাসপাতালে মা আর আমি। বেলা তিনটার দিকে সুমী এলো হাসপাতাল। সঙ্গে তার মা। সুমীর হাতে ফুলের ঝুড়ি। আমার মা তাদেরকে চিনলেন না। আমি পরিচয় দিলাম। মা বসতে দিলেন তাদের। সুমীর মা ঘটনার জণ্য দুঃখ প্রকাশ করলনে। আমার মা বললনে, যা হবার হয়ে গেছে। আমাকে আর সুমীকে বললেন, যা হবার তা হয়েছে। কিন্তু তোমরা দুইজন আর কলতলায় যাবে না। কোনো প্রয়োজন হলে বাসায় এসে কথা বলবে। নোট বিনিময় করবে। তবে বাইরে কথা বললে মানুষ ভালোভাবে নেয় না। এটা আর করবে না। বন্ধ হয়ে গেলা আমাদের তেতুল তলায় যাওয়া।
দিন সাতেক হাসপাতালে থেকে বাসায় ফিরলাম। স্কুল তখন রোজার বন্ধ। সুমী একদিন বন্ধু রাব্বীকে দিয়ে চিরকুট পাঠালো (তখন মোবাইল ফোন ছিল না) সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। দেখা হলো জাহানাবাদ সেনানিবাসের চিড়িয়াখানায়। আমার হাত ধরে ঘুরলো সে সারাদিন। বিকেলে ফিরে আসার একটু আগে সুমী আমাকে বললো, খালেদ, আমি তোমাকে সরাসরি কিছু কথা বলতে চাই। তুমি মন দিয়ে শোনো। তবে কথাগুলো আমি তোমাকে কবি বুদ্ধদেব বসুর 'শ্বাশ্বতী' কবিতার ভাষায় বলছি। এটি আমার খুব প্রিয় কবিতা। তুমি আমার মনের কথা বুঝে নিও।
সুমীর শোনানো কবিতাটি পরে মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। আজ ১৮ বছর পরও তা মনে মনে আওড়াই। যখন থাকি একা, মনে পড়ে যায় এ কবিতা। সুমী আমাকে বলেছিল-
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে
মনে হয় যেন শত জনমের আগে
সে এসে, সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগল্ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রবতারকারে ধ’রে;
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ রাত ৮:৩২