১.
মানুষের জীবন বলতে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাম হাতের কর্ম সম্পাদন করা থেকে প্রাত্যহিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দিনপাত করে রাতে কাত হয়ে শুতে যাওয়া বিষয়টাকে বুঝায় না। বরং মানুষের জীবনের রয়েছে কতগুলো স্বতন্ত্র দিক। এর মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক দিকগুলো— বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে হয়তো একটির সাথে অন্যটির কাছাকাছি সম্পর্ক আছে। এমনকি দুইটি বিষয়কে হয়তো একটিতে মার্জ করা যাবে। আবার অন্যভাবে বিবেচনা করলে হয়তো একটি বিষয়ের আরো শাখা-প্রশাখা বের করা যাবে। ভাগ-বিভাগ এখানে বিবেচ্য নয়, বরং প্রতিটি মানুষের জীবনেই এই বিষয়গুলোর প্রত্যক্ষ প্রয়োগ আছে। ব্যক্তি হয়তো জানে না তবুও সে বিশেষ বিবেচনায় বিশেষ শ্রেণিতে বিবেচিত। এই বিবেচনাবোধের একটি তাত্ত্বিক কাঠামো আছে। নাম প্রাচ্যবাদ। ওরিয়েন্টালিজম। ডব্লিউ সাঈদ এর প্রবক্তা। আন্তর্জাতিক বা রাষ্ট্রীয় পরিসর বাদ দিলেও এর স্বয়ংক্রিয় প্রয়োগ দেখা যায় সমাজ জীবনে, ব্যক্তিজীবনে। আমরা আজকে মানবজীবনে বিশেষায়িত হওয়ার রূপ দেখতে চেষ্টা করবো।
২.
প্রাচ্যবাদ কি
অ্যাকাডেমিতে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদের তিনটা সংজ্ঞা ব্যাপকভাবে পরিচিত। এর মধ্যে একটি সংজ্ঞাকে অ্যাকাডেমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় মেইনলি। পরবর্তী গবেষণার মধ্য দিয়ে বাকি দুইটি সংজ্ঞা বের হয়ে আসে। এবং এখানে আরো একটি কথা উল্লেখ্য যে, এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম এবং পাশ্চাত্যের ওরিয়েন্টালিজম এক জিনিশ নয়। বরং সাঈদ দেখলেন পাশ্চাত্য মনীষীরা যাকে প্রাচ্যবাদ বলছে মূলত প্রাচ্যবাদ তা নয়, এর মধ্যে আরো কিছু বিষয় আছে। যাহোক। পাশ্চাত্য পন্ডিতদের মতে ওরিযময়েন্টালিজম হচ্ছে "প্রাচ্যের অথবা এর কোন অংশ বিশেষ অথবা এর কোন অঞ্চল সম্পর্কে অথবা এর (প্রাচ্যের) কোন বিদ্যা (ডিসিপ্লিন, যেমন- নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ইত্যাদি) সম্পর্কে যে আলোচনা বা চিন্তাভাবনা প্রকাশ করা হয় তা-ই ওরিয়েন্টালিজম"। অর্থাৎ ওরিয়েন্টালিজম হচ্ছে ওরিয়রন্ট (প্রাচ্য) দেশীয় মানুষ সম্পর্কে চর্চা করা। তাত্ত্বিকভাবে এই সংজ্ঞাটি পাশ্চাত্যবাদী পন্ডিতদের কাছে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং এখনো (অ্যাকাডেমিতে) প্রতিষ্ঠিত আছে।
৩.
ডব্লিউ এডওয়ার্ড সাঈদ দেখলেন এই অ্যাকাডেমিক সংজ্ঞাটি ওরিয়েন্টালিজমকে ভালোভাবে প্রকাশ করে না। বরং এর ভেতরে আরো কিছু বিষয় আছে। তখন এডওয়ার্ড সাঈদ ওরিয়েন্টালিজমের সংজ্ঞা দিলেন এভাবে "ওরিয়েন্টালিজম হচ্ছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে ক্ষমতা, আধিপত্য এবং কর্তৃত্বের একটা জটিল সম্পর্ক। যে সম্পর্ক নিয়ত বদল হয় এবং যে সম্পর্কের বিন্যাস পরবর্তিত হয়"। সুতরাং এই বিষয়টি পরিস্কার যে, ওরিয়েন্টালিজম থিয়োরি বলে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সম্পর্ককে যেভাবে "চর্চা"র বন্ধনে আবদ্ধ করা হচ্ছে মূলত বিষয়টি সেখানে নয়। বরং প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সম্পর্ক হচ্ছে ক্ষমতা, আধিপত্য ও কর্তৃত্বের। এডওয়ার্ড সাঈদ মনে করেন এই সম্পর্ক গড়ে উঠার কারণ আদার (Other) এবং সেল্ফ (Self) এর ধারণা। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন পরবর্তীতে The Clash of Civilizations প্রবন্ধে এই আদার এবং সেল্ফ- এর কথা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রবন্ধের সম্প্রসারিত রূপ পরবর্তীকালে The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয় এবং তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। যদিও হান্টিংটন এর ব্যাখ্যার উদ্দেশ্য ছিল সাঈদের ব্যাখ্যাকে ভুল প্রমাণ করা বা বিরোধীতা করা। তথাপি তিনি দু'টি বিষয়কে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। সাঈদ বলেছেন পাশ্চাত্য মনে করে আমি মানে আমি, আর প্রাচ্য হচ্ছে আলাদা একটা জগৎ। অবশ্য হান্টিংটন এখানে পাশ্চাত্য কে আলাদা না করে সমগ্র বিশ্বের সভ্যতাসমূহকে হেনরি কিসিঞ্জার এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন এভাবে- ".....কমপক্ষে প্রধান ছয়টি শক্তি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, জাপান রাশিয়া এবং সম্ভবত ভারত এবং সেসঙ্গে কিছু মধ্যম আকৃতির রাষ্ট্র হবে অনাগত ভবিষ্যতের মূল নিয়ন্তা।" হেনরি কথা হান্টিংটন উল্লেখ করলেও তাঁর মতামত হচ্ছে, "........বিশ্ব হলো সংক্ষেপে দুইভাগে বিভক্ত- এর একদিকে থাকে পাশ্চাত্য বিশ্ব, আর অন্যদিকে অবশিষ্ট, যার ভেতরে লুক্কায়িত থাকে নানাপ্রকার সভ্যতা।"
৪.
ফিরে আসা যাক এডওয়ার্ড সাঈদের কাছে। তিনি ওরিয়েন্টালিজম চর্চায় যে তিনটি বিষয়ের কথা বলেছেন সেগুলো (ক্ষমতা, আধিপত্য ও কর্তৃত্ব) কিভাবে অনুশীলিত হয় তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চর্চার রূপ এমন যে, প্রাচ্যবিদগণ মনে করেন পাশ্চাত্যের মানুষ উন্নত এবং প্রাচ্যের মানুষ ভিন্ন। এখানে ভিন্ন বলতে ছোট অর্থে ভিন্ন, তুচ্ছার্থে ভিন্ন, নীচ অর্থে ভিন্ন, কথা বলার ক্ষেত্রে ভিন্ন, চিন্তার ক্ষেত্রে ভিন্ন। এরকম ভিন্ন ভাবতে ভাবতে প্রাচ্যবিদগণ বা পাশ্চাত্যের লোকজন প্রাচ্যকে একটা ভিন্ন জগৎ মনে করতে থাকে। তখন তারা চিন্তা করে এই ভিন্ন জগৎ সম্পর্কে আমদের জানতে হবে এবং তাদেরকে বুঝতে হবে। তখন প্রাচ্যকে বুঝতে গিয়ে তুলনা করার বিষয়টি চলে আসে যেহেতু প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য একরকম নয়। তুলনা চলতে থাকে প্রাচ্যের ভাষা ও পাশ্চাত্যের ভাষার মধ্যে, প্রাচ্যের কালচার ও পাশ্চাত্যের কালচারের মধ্যে, প্রাচ্যের সংগীত ও পাশ্চাত্যের সংগীতের মধ্যে, প্রাচ্যের স্থাপত্য ও পাশ্চাত্যের স্থাপত্যের মধ্যে, প্রাচ্যের মানুষের চিন্তা ও পাশ্চাত্যের মানুষের চিন্তার মধ্যে— এভাবে সব কিছুর মধ্যে। মানুষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হলে কিংবা পার্থক্য আছে মনে হলে সে তুলনা করতে শুরু করে। তাই এসব চিন্তার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যের লোকেরা বা প্রাচ্যবিদগণ কিছু তুলনামূলক সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এবং তাদের সকল তুলনার ফল এই যে— সকল ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্য নিকৃষ্ট। সাঈদ প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—
১. প্রাচ্যের মানুষ আনুমানিক কথা বলে, আমরা (পাশ্চাত্যের মানুষ) নিখুঁত কথা বলি।
২. প্রাচ্যের মানুষ দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনখারাবি তে লিপ্ত থাকে, আমরা (পাশ্চাত্যের মানুষ) অনেক বেশি সুশৃঙ্খল।
৩. প্রাচ্যের মানুষ অলস, আমরা (পাশ্চাত্যের মানুষ) কর্মঠ।
৪. প্রাচ্যের মানুষ কালো, আমরা (পাশ্চাত্যের মানুষ) শাদা। সুতরাং শাদা হচ্ছে ভালো এবং কালো হচ্ছে খারাপ।
৫. প্রাচ্যের সংগীত দুর্বল, আমাদের (পাশ্চাত্যের) সংগীত জীবনমুখী।
এসব বিষয় আমলে নিয়ে সাঈদ বলেছেন, "প্রাচ্যকে জানা, প্রাচ্যকে হীন হিসেবে উপস্থাপন করা, সেই হীনকে কব্জা করা, তাকে দখল করা এবং তাকে শাসন করার একটি সাংস্কৃতিক প্রণোদনা হচ্ছে প্রাচ্যতত্ত্ব।" এডওয়ার্ড সাঈদ যে তিন সংজ্ঞার কথা বলেছেন, এটি তার তৃতীয় সংজ্ঞা। এবং তিনি যোগ করেছেন যে, পাশ্চাত্যে জন্ম নেয়া একটি শিশু প্রাচ্য সম্পর্কে জানতে শুরু করে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু বিরাট একটি অঞ্চল নিয়ে জানতে গিয়ে পূর্ব-কাঠামোবদ্ধ একটি নিকৃষ্ট অঞ্চলকে উকৃষ্ট করার মনোবাসনা থেকেই জন্ম নেয় কর্তৃত্বের প্রবণতা, দখলের প্রবণতা, ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা প্রভৃতি।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্ব আরো বড় পরিসরের বিষয়। তিনি শেষে একথা বলেছেন যে, ওরিয়েন্ট থিয়োরির বিপরীতে একটি অক্সিডেন্ট থিয়োরি দাঁড় করানো আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধু প্রাচ্যতত্ত্ব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ছোট এই লেখায় তার পুরোটা তুলে ধরা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের কর্মে এবং চিন্তায় প্রাচ্যতত্ত্বের মতো একটি তুলনামূলক প্রবণতা কিভাবে এবং কতটুকু কাজ করে তা দেখার চেষ্টা করবো।
৩.
আন্তর্জাতিক পরিসর
প্রাচ্যতত্ত্ব মানুষের মনে যে তুলনাগত পার্থক্যের প্রবণতা সৃষ্টি করে তার বৃহত্তর রূপ দেখা যায় আন্তর্জাতিক পরিসরে। পশ্চিমাবিশ্ব পৃথিবীর পূর্বভাগকে যেসব অভিযোগে অভিযুক্ত করে সেগুলোই এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। বর্তমান আলোচনায় আমাদের 'মনোবৃত্তি ও প্রয়োগ' কথাটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাচ্যতত্ত্বের ভিত্তি থেকে পশ্চিমাগণ আমাদেরকে ছোটজ্ঞান করে সত্য, তবে আমাদেরও বৈশ্বিক মানদন্ডে কিছু সরল অনুমান আছে। যেমন আমরা অ্যামাজনের আদিবাসীদের নিম্নশ্রেণীয় ভাবি। এখানে আমরা বলতে সাধারণ জনগণ। আবার আফ্রিকার মানুষদের আমরা কমশিক্ষিত, উগ্র এবং কর্মঠ ভাবি। কর্মঠ বিষয়টিকে অনেকে গুণ হিসেবে বিবেচনা করেন, যদিও কর্মঠ হওয়া বা না-হওয়ার সাথে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতার সম্পর্ক রয়েছে। মূল কথা হচ্ছে পাশ্চাত্যের লোকজনের মতো আমরাও সবকিছুর একটি বা অনেকগুলো টাইপ নির্ধারণ বা নির্ণয় করি। হতে পারে কোন কোন ক্ষেত্রে এই টাইপগুলো বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে খুবই ইতিবাচক, তথাপি আমরা পাশ্চাত্যের টাইপোলজিক্যাল ঘরানার তত্ত্বের অনুকরণের বাইরে পদার্পণ করতে পারিনি বলেই প্রমাণিত হয়। সুতরাং বলা চলে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রাচ্যতত্ত্বের ন্যায় একটি সমান্তরাল মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আমাদের মনোজগতে সক্রিয় রয়েছে ; যদিও একে অক্সিডেন্টাল পর্যায়ের কোন তত্ত্ব বলে প্রমাণ করার সুযোগ নেই।
৪.
রাষ্ট্রীয় পরিসর
তাত্ত্বিকভাবে প্রাচ্যতত্ত্ব পৃথিবীর পশ্চিম এবং পূর্ব ভাগ সম্পর্কিত একটি অ্যাকাডেমিক তত্ত্ব। এই থিয়োরির মূল বিষয়টি পৃথিবীর মনস্তত্ত্ব মূলত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বেশি কাজ করে। এখানে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের তুলনা করা হয় হরহামেশাই। আমাদের মনস্তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম আচরণ করে। প্রাচ্যতত্ত্ব যেখানে সামগ্রিকভাবে পূর্বকে ছোটজ্ঞান করে সেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের লোকজন সব রাষ্ট্রকে ছোটজ্ঞান করে না। আবার বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। চিত্রটি এমন যে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে যে দেশকে অপছন্দ করা হয় তার সম্পূর্ণ দিককেই অপছন্দ করা হয়। আরো উল্লেখ্য যে এই পছন্দ অপছন্দের বিষয়টি পশ্চিমাদের মতো ঢালাও নয়, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদর্শগত দিক বিবেচনায় এবং কিছু ক্ষেত্রে নির্মোহ। উদাহরণ হিসেবে আদর্শগত দিক বিবেচনার উদাহরণ হতে পারে ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, সৌদি আরব প্রভৃতি রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে (বাংলাদেশের নাগরিকের জন্য) ভারত স্বাধীনতার পক্ষের নাগরিকের কাছে সর্বদিক থেকে ভালো এবং অনুসরণীয়, পাকিস্তান অপরাধী রাষ্ট্র। আবার পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির কাছে ভারত আমাদের দুশমন রাষ্ট্র এবং পাকিস্তান মুসলমানদের রাষ্ট্র, আর সকল মুসলমান ভাই ভাই। সুতরাং তারা অনুকরণীয়। তেমনি সাম্যবাদীদের কাছে চীন, রাশিয়া (এক্ষেত্রেও মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী নামে বিভাজন রয়েছে), পুঁজিবাদীদের কাছে মার্কিন দেশ, বামপন্থী বিদ্রোহী বিপ্লবীদের কাছে কিউবা উত্তম এবং সেসব নির্দিষ্ট চরিত্রের বিপরীত দেশগুলো নিকৃষ্ট। নির্মোহভাবে বিবেচনায় থাকে অন্যান্য সাধারণ দেশগুলো। তবে এক্ষেত্রেও জেনারালাইজড করে বিভিন্ন দেশের ব্যবচ্ছেদ করা হয় অযৌক্তিকভাবে।
৫.
অন্তর্দেশীয় পরিসর
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের বিবেচনাবোধের মানসিকতার ভাবগত ও আদর্শগত চেহারা শুধু ভয়েরই না বরং লজ্জারও। পাশ্চাত্যে প্রাচ্য সম্পর্কে একটি ধারণা হলো প্রাচ্যের লোক বিশৃঙ্খল। অর্থাৎ অন্যকে ছোট জ্ঞান করাই এর উদ্দেশ্য। আমাদের মাঝেও সেই প্রবণতা দেখা যায় ব্যাপকহারে। এখানে ভালো উদাহরণ হিসেবে সম্ভবত "নোয়াখালীর মানুষ" বিশেষ উল্লেখযোগ্য হতে পারে। নোয়াখালীর মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করার মধ্য দিয়ে মূলত একটি অঞ্চলকে, এমনকি নির্দিষ্ট ঐ অঞ্চলের সকল মানুষকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা হয়। ঠিক একইভাবে এখানে বরিশাল নামটি আসতে পারে। এটি প্রাচ্যতত্ত্বের ভিত্তিতে যতটা না আলোচনা করা যায় তারচে' বেশি আলোচিত হতে পারে স্ট্রাকচারালিজমের ভিত্তিতে। এরকম হাজার উদাহরণ আসতে পারে যেমন- উত্তরবঙ্গের মানুষ একগুঁয়ে, কুমিল্লার মানুষ অন্যকে পাত্তা দেয় না, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ উশৃঙ্খল, খুলনার মানুষ আত্মকেন্দ্রিক ইত্যাদি। এই টাইপের বাইরে আমাদের দেশীয় লোকজনকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার ক্ষেত্রে নিজ অঞ্চলের বা জেলার একাংশ বা উপজেলাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে দেখা যায়। আরো ছোট পরিসরে দেখা যায় ইউনিয়ন অন্য ইউনিয়নকে, গ্রাম অন্য গ্রামকে এবং গ্রামের একাংশ অন্য অংশকে ছোটজ্ঞান করে থাকে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় অন্য জেলার চেয়ে নিজ জেলাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে মরিয়া লোকই আবার পাশের উপজেলা, পাশের ইউনিয়ন, পাশের গ্রাম প্রভৃতিকে ছোটজ্ঞান করে। এসব মেনে নিলে মনে হবে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা ব্যক্তি যেন নিজের ভালোত্ব দিয়ে অন্যকে হেয় করেছে। এ কাজ প্রাচ্যতত্ত্বের নামান্তর!
৬.
পেশাগত পরিসর
পেশাগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই ছোট-বড়'র মানসিকতা আরো প্রখর। এক পেশার মানুষ পেশায় থাকা মানুষকে ছোট করতেই পছন্দ করে, তবে একই সাথে প্রত্যেকেই তার নিজের পেশাকে বড় মনে করেন। যারা বড় মনে করতে পারেন না তিনি নিদেনপক্ষে তার পেশাকে অধিকতর হালাল মনে করেন। এই হালাল মনে করার মধ্য দিয়ে অন্যের পেশাকে কম-হালাল মনে করেন। একই মুদ্রার উল্টা পিঠ! আমাদের চারপাশে পেশা সংক্রান্ত যে ছোট-বড় করার ঘটনাগুলো চলমান তার মধ্যে হোমিওপ্যাথিক ও অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের পেশা নিয়ে যে রসিকতা চালু আছে তা সবচে' বড় উদাহরণ হতে পারে। আবাল্য কাল থেকে আমরা এ বিদ্রূপাত্মক কথাটি শুনে আসছি। সিভিল সার্ভিসের চাকরি সব দেশেই বড় বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে "বিসিএস" নামে একটি ঘটনা আছে। সরকারি কর্মকমিশনের অধীনে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যদি কেউ হয়েই যান তবে তার কাছে অন্যান্য চাকরি নস্যি। একেবারে বড় চাকরি থেকে ছোট চাকুরি সবাই নিজের পরিসরে একই কাজ করছে পাশাপাশি থাকা অন্যের সাথে। আমাদের দেশে কোম্পানির চাকরি, সরকারি চাকরি, ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের চাকরি, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি ইত্যাদি বিষয় আছে। এবং হলফ করেই বলা যায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তুলনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৪৭