১.
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ। তখন আমার পরিচিত একজন নারী ছিল, যে আমার "অর্ধেক প্রেমিকা অর্ধেক বান্ধবী"— গোছের ভূমিকায় নাযেল হয়েছিল। তবে ২০১৬/১৭ খ্রিষ্টাব্দেও সে আমার "কম কম প্রেমিকা বেশি বেশি বান্ধবী" গোত্রের ছিল। পরে আস্তে আস্তে আন্তরিকতা বাড়লেও অন্তরঙ্গতা বাড়ে নি—, ফলে সে অর্ধেক পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিল। তো যাহোক। তখন আমি ফেসবুকে "গায়ে মানে না আপনি মোড়ল" টাইপের সেলিব্রেটি (সঠিক বানান ছেলিব্রেটি হওয়া উচিৎ), কেউ তেমন লাইক কমেন্ট না করলেও সমানে পোস্ট করে যেতাম। কেউ রিপ্লে না দিলেও আমি মানুষের পোস্টে সমানে কমেন্ট করে যেতাম। সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকতাম আর মোবাইলের স্ক্রিনে আঙুলি খেলতাম। খাওয়া-নাওয়ার খোঁজ ছিল না। দুপুরে এসে যদি মা বলতেন- “ফেসবুকের বাইরেও একটা বাস্তব জীবন আছে। ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?” আমি তখন বলতাম- “কই, জানি না তো! বাস্তব জীবনের লিংকটা একটু কষ্ট করে সেন্ড করো তো। এদের কি পৃষ্ঠা (পেজ) আছে? নাকি শুধু গোষ্ঠী (গ্রুপ)?” এই ছিল অবস্থা। তো এমনি একদিন দুপুরে "মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন হামলার পর তেলের মালিকানা ও বাজারদর" , "শিল্পবিপ্লবের ফলে গণচীনের উন্নতি ও আগামীর বিশ্বনেতৃত্ব" , "ফিরে দেখা সোভিয়েত ইউনিয়ন : ব্যর্থতার কারণ ও নব্য পুঁজিবাদ" ইত্যাদি শিরোনামে কিছু ফেসবুক বিজ্ঞানীর সাড়ে দশ লাইনের স্ট্যাটাস পড়ছি এবং একইসাথে উঠতি বয়সের আরো কিছু ফেসবুক বিজ্ঞানীর মন্তব্য (কমেন্ট) পড়ছি। এদের মধ্যে কয়েকজন বয়ঃসন্ধিকালের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত বিজ্ঞানীও রয়েছেন। এমন সময় আমার "হাফ ফ্রেন্ড হাফ গার্লফ্রেন্ড" টাইপের মহিলা একটা মেসেজ পাঠালো। অন্যের লেখা কপি করে অবশ্যই, তবে তার লিংকসহ। লেখাটা পড়ার আগে লিংকে প্রবেশ করলাম। লোডিং দেখাচ্ছে যতক্ষণ, ততক্ষণ আমি খালি রুমে একটু নেচে নিলাম। লিংক পাঠাইছে! খেলা হবে! লিংকে ঢুকে উত্তেজনা কমে গেল। বুঝলাম। লেখাটার কার্টেসি হিসেবে লিংকটা পাঠিয়েছে। আশাহত হলাম। খুবই আশাহত হলাম।
২.
আরেকজনের লেখা কপি করে পাঠিয়ে থাকুক আর যেভাবেই পাঠিয়ে থাকুক— তার পাঠানো লেখায় আমি নতুন কিছু জানতে পারছি এইটা সত্য কথা। বিষয়টা ছিল মুড সুইং। মনের অবস্থার পরিবর্তন। ধরুন রিপন বিডিয়ো'র মতো করে বললে হবে ব্যবহারের পরিবর্তন। আপনি কিছু বললেন আর আপনার গার্লফ্রেন্ড ছ্যাৎ করে উঠবে, শেষে বলবে এটা মুড সুইং। সে কথা দিবে লিটনের ফ্ল্যাটে যাবে অথচ যাওয়ার দিন ফোন দিয়ে বলবে- “বাবুসোনা, আজকে আমার শরীর ভালো না। বিকালে জ্বর আসতে পারে। সো আজকে আমরা "ওইখানে" যাবো না।” এইটা হইলো মুড সুইং। চ্যাট করতেসেন ফেসবুকে, গার্লফ্রেন্ড হঠাৎ করে চেইত্তা গেলো— এটাই মুড সোইং।
৩.
খেয়াল করে দেইখেন, একটা সময় পর্যন্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা বিষয় বই না পড়লে জানা যাইতো না। বই পুস্তকের বাইরে একমাত্র অবলম্বন ছিল খবরের কাগজ। স্থানীয় ও জাতীয়— উভয় ক্যাটাগরির কাগজেই নিত্যদিনের ঘটনার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ইতিহাসের নানা কথা উল্লেখ থাকতো। তখন বই ও খবরের কাগজের বাইরের লোকেরা এসব জ্ঞানের কথা নিত্যবেলা ব্যবহার তো দূরের কথা, বরং জানতেই পারতো না। কিন্তু বর্তমানে ফেসবুক ও ইউটিউব— এই দুই জিনিশের কল্যাণে আম-পাব্লিকের কোন কিছুই আর অজানা থাকে না। সেলুন দোকানের কার্তিক থেকে শুরু করে আদার ব্যাপারী শাহআলম— সবাই আজকাল ইরানের জাহাজ দুর্ঘটনার কথা জানে। মুদি দোকানি রফিক থেকে মাছ ব্যাপারী রঞ্জিত— সবাই জানে হুমায়ূন আহমেদ কম বয়সী মেয়েদের প্রেমের বিষয়ে কী বলেছেন।
৪.
কথা হচ্ছে মুড সুইং নিয়ে। পরবর্তী সময়ে এই মুড সুইং নিয়ে কিছু স্ট্যাটাস ঘুরে বেড়াতে লাগল ফেসবুকের দেয়ালে। আমিও দেখে যেতে লাগলাম। পোস্ট করতেছে একজন অথচ এই পোস্টের নিচে বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিনের মুরিদগণ গণহারে কমেন্ট করতেছে— "আমারও মুড সুইং এর প্রবলেম আছে" , "অথচ সবাই বলে আমি নাকি ভাব নিই" , "মুড সুইং ফ্যাক্ট" , "দেখো বাবু, দেখো" , "(বয়ফ্রেন্ডের আইডি ম্যানশন দিয়ে) তুমি কখ্খনো আমাকে বুঝো না বাবু" , "পুরুষশাসিত সমাজে এসব কেউ বুঝবে না" ইত্যাদি। এসব কমেন্ট দেখতে দেখতে কখনো কখনো বিরক্ত হয়ে যাই। আবার কখনো কখনো মন হালকা করার জন্য এসব রসিকতা গুরুত্ব সহকারে পড়ি, বিশেষ করে কমেন্ট সেকশন। যেসব লুতুপুতু গার্লফ্রেন্ড তার বফ কে ম্যানশন করে আমি সেই আ-বাল বফের আইডিতে গিয়ে তার ওজন চেক করি। তোর গার্লফ্রেন্ডের মুড যদি সুইং করে তবে তাকে ছেড়ে দেস না কেন? জাস্ট ছেড়ে দে। দেখবি সুইং করা জিনিশ যখন রিজেক্টেড হবে তখন এই জিনিশ কেউ আর নিবে না। তখন ছোটবেলার পড়াশোনা মনে পড়বে "মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একা বাস করতে পারে না ইত্যাদি।" তখন সুইংয়ের কথা বলে যে আলগা সুবিধা ভোগ করতো তা নিমিষেই ধুলায় মিলিয়ে যাবে। ন্যাকামি করে বলবে না "বাবু আমারও তো মুড সুইং হয়।"
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:১৮