এক রাজা তার রাজ্যে পাগলের সংখ্যা ও তাদের অবস্থা বুঝার জন্য একজন সাইক্রিয়াটিস্ট নিয়োগ করলেন। সাইক্রিয়াটিস্ট রাজ্য ঘুরে দেখলেন, তারপর আবার রাজ-দরবারে ফিরে আসলেন।
রাজা সাইক্রিয়াটিস্টকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমার রাজ্যে কি কোন পাগল খুঁজে পেলেন?"
সাইক্রিয়াটিস্ট বললেন, "মহারাজ, আমার তো মনে হয়ে আপনার রাজ্যে সবাই পাগল!"
রাজা বললেন, "সে কী? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমিও পাগল?"
সাইক্রিয়াটিস্ট বললেন, "যার রাজ্যের সকল প্রজা পাগল, তাদের রাজা কি আর পাগল না হয়ে পারে?"
রাজা সব শুনে বললেন, "আমার মনে হচ্ছে আপনিও পাগল!"
গল্পের মত বাস্তবেও প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর পাগল। যার মধ্যে কম বেশি অস্বাভাবিকতা বিরাজ করে সেই পাগল। আর মনোবিজ্ঞান বলছে সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি অস্থিরতা তথা অস্বাভাবিকতা কাজ করে। ফলে একটা পজিটিভ অর্থে সবাই পাগল। তবে পাগলামির পরিমানের উপর ভিত্তি করে তার প্রকারভেদ নির্ণয় করা যায়। পাগল নিয়ে সবচে' বেশি পঠিত বইয়ের নাম History of madness এবং তার লেখক Michel Foucault (মিশেল ফুঁকো) এবং সহলেখক ছিলেন Jean Khalfa ও Jonathan Murphy নামের আরো দু'জন ভদ্রলোক।
এই পাগলামি তত্ত্ব নিয়ে আরো বহু পন্ডিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও গবেষণা করেছেন। উনিশ-বিশ পার্থক্য সত্ত্বেও সবার বক্তব্যের সারকথা এক। তবে পাগল নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে Jacques Lacan (জ্যাক লাঁকা) 'র নাম সবার প্রথমে থাকবে। মিশেল ফুঁকো— যদিও লাঁকার নাম তার লেখায় নিয়ে আসেন নি তবুও লাঁকার নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। জ্যাক লাঁকা প্রথমে সকল মানুষকে তার পাগলামির পরিমান ও ধরণ দেখে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন।
লাঁকাই প্রথম তত্ত্ব দিয়ে দেখালেন যে, সকল মানুষকে নিম্নোক্ত চারটি শ্রেণিতে পাগল হিশেবে চিহ্নিত করা যায়—
i. Psychotic (সাইকোটিক)
ii. Neurotic (নিউরেটিক)
iii. Hysterical (হিস্টেরিক)
iv. Perverse (পারভার্স)
চলুন এদের সম্পর্কে অল্পস্বল্প কিছু জেনে নেয়ার পাশাপাশি আমরা আজকে পাগলামির ধরণ ও পরিমান অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান ঠিক করি।
i. Psychotic:
এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা খুব কম। সাধারণত লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেইন্টার, কবি, সমাজসংস্কারক, রাজনীতিবিদ প্রভৃতি পেশার লোকদের একাংশ এই Psychotic শ্রেণির পাগল। তারা মনে করেন, সমাজের-রাষ্ট্রের সবকিছু বেঠিকভাবে চলছে। প্রতিটি বিষয়কে ঠিক করা তাদের দায়িত্ব। তারা সে মোতাবেক চেষ্টা করেও থাকেন। সমাজকে পাল্টে দেয়ার যে প্রবণতা, তা তাদের মধ্যে সারাক্ষণ কাজ করে এবং তাদের অস্থির করে তোলে। এরকম লোকেরা সমাজের জন্য অনেক কাজ করেন। এই শ্রেণির লোকের উদাহরণ হবে— কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
ii. Neurotic:
এই শ্রেণির লোকের সংখ্যা সবচে' বেশি। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা প্রায় সবসময় সিদ্ধান্তহীনতায় (Indecision) ভোগে। কোন বিষয়েই এরা সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে না। এই অবস্থায় একটি কাজ সম্পাদন করে তার ফলাফল নিয়ে আবার এরা অসন্তুষ্ট থাকে। সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যেও এদের সংখ্যা অনেক। এর উদারহন হিশেবে আমরা জীবনানন্দের নাম বলতে পারি।
iii.Hysterical:
নারীবাদীরা হয়তো রেগে যেতে পারেন তবুও বলতে হচ্ছে বাচ্চা বয়সী মহিলাগণ, যারা ৪০ বছরের কম বয়সী- তারা, এই শ্রেণিভুক্ত। বায়োলজিক্যাল কারণে তারা মাসের একটা সময় নির্দিষ্ট কিছু অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। ফলে তাদের আচরণে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন- হঠাৎ করে মেজাজ বা ধৈর্য হারিয়ে ফেলা, কোন কিছুর প্রতি অনেক বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়া বা আকর্ষণবোধ করা, কোন কিছুকে অপ্রয়োজনে এক্সট্রিম লেভেলে অপছন্দ (Neglect) করা। মূলত নারীরা মেজাজ হারিয়ে হিস্টোরিয়া (Hysteria) রোগীর মত আচরণ করেন বিধায় এমন নামকরণ (Hysteric) করা হয়েছে।
iv. Perverse:
এটা হচ্ছে যৌন বিকারগ্রস্ত লোকদের বিশেষ শ্রেণি। মনঃসমীক্ষক সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) এদেরকে আলাদা করে দিতে চেয়েছেন। ফ্রয়েড এদের জন্য Pervert শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু জ্যাক লাঁকা তাদেরকে আলাদা না করে বলেছেন এদের একটা ওরিয়েন্টেশান আছে। তিনি Perverse বুঝাতে Periverse শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এরা মূলত নারীদের মাঝে Motherer কে খুঁজে। লাঁকা Motherer শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই শব্দটি দ্বারা বুঝায়— ছোট বাচ্চা তার মায়ের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। তেমনি যৌন বিকারগ্রস্ত লোক বিভিন্ন নারীর কাছে সুখ খুঁজে বেড়ায়। সে নিজেও হয়তো জানে না যে সে নারীর কাছে মাতৃ-নিরাপত্তার ন্যায় নিশ্চিত সুখ খুঁজছে। লাঁকা Motherer শব্দটির পাশাপাশি Fatherer শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। বিশদ আলোচনা অন্যদিন হবে।
আমার মনে হচ্ছে, আমি চিন্তায় সাইকোটিক কিন্তু কাজে নিউরোটিক প্রকৃতির পাগল। পাঠক, আপনি কোন ক্যাটাগরির পাগল?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৩৮