ইস্তাম্বুলের বসফরাস ক্রুইজ, আমস্টারডামের ক্যানাল রাইডের সমান জনপ্রিয়। ইস্তাম্বুল নগরীকে দেখার সবচে’ ভাল উপায় হল বসফরাস প্রনালী থেকে। সকাল বেলায় ট্যুর কোম্পানীর গাড়ী যখন হোটেল থেকে তুলে নিল ইস্তাম্বুল নগরীর নৈমিত্তিক ট্রাফিক জ্যাম তখনো শুরু হয় নি। গোল্ডেন হর্ন হিসেবে পরিচিত এ নগরীর পুরোন অংশ ত্রিভুজাকৃতির। ত্রিভুজের ডানদিকের বাহু মারমারা সাগর আর বাম দিকে এ সাগরেরই অংশ সাত কিলোমিটার ঢুকে গেছে ইউরোপীয় ভুখন্ডের মধ্যে। ইউরোপীয় অংশকে দুভাগে ভাগ করা সাত কিলোমিটার সাগরের উপর দুটো সেতু- ১)গালাটা এবং ২) কামাল আতা তূর্ক সেতু।
গালাটা সেতু।
দুই সেতুর মাঝমাঝি জায়গায় ইস্তাম্বুল কাদিরহাস ইউনিভার্সিটির উলটো দিকের ঘাটে আমাদের এনে হাজির করল ট্যুর কোম্পানীর বাস।
কাদিরহাস ইউনিভার্সিটি।
লঞ্চের যাত্রা শুরু হওয়ার আগে আশে পাশের দর্শনীয় স্থাপনাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন গত দিনের একই শেতাঙ্গীনি ট্যুর গাইড । লঞ্চ ঘাট থেকে ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং এর উপর দিয়ে চোখে পড়ে পাহাড়ের উপরের সুলাইমানিয়া মসজিদ এবং তার একটু বামে ফায়ার ওয়াচ টাওয়ার। লঞ্চের দোতলার উপরকার খোলা ছাদে চেয়ার টেবিলে বসার ব্যাবস্থা থাকলেও অধিকাংশ পর্য্যটকেরাই কখনো বামে কখনো ডাইনে , সামনে বা পেছনে ঘুরে আশপাশের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন, ছবি তুলছিলেন। সেতুর আশে পাশের দুই কুল এবং সেতুর উপর ছিপ ফেলে বসে থাকা অসংখ্য মৎস শিকারীর ভীড়। গতদিনের সহযাত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভুত দুইজন কেনিয়ান ভদ্রমহিলা আজও আমার সঙ্গী। কুশলাদি বিনিময় শেষে অল্প কিছুদিন আগে কেনিয়ার শপিং মলে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী আক্রমন নিয়ে দু’ চারটে কথা হল তাদের সাথে। বসফরাস প্রনালীর ইউরোপয়ীয় তীর ঘেষে এগিয়ে চলল আমাদের নৌযান। বসফরাস প্রনালীর মারামারা সাগর প্রান্ত থেকে কৃষ্ণ সাগরের দিকে শুরু হল আমাদের যাত্রা। ট্যুর গাইড দর্শনীয় স্থান বা স্থাপনা সমুহের গুরুত্ব, ইতিহাস, এবং উল্লেখযোগ্য দিকগুলো বর্ননা করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। বসফরাস প্রনালীর মারমারা সাগরের প্রবেশমুখ থেকে ইউরোপীয় ইস্তাম্বুলের তীর ঘেষে নৌযান এগিয়ে গেল দ্বিতীয় বসফরাস সেতু অবধি এবং ফিরে এল এশীয় কুল বেয়ে। মোট তিন ঘন্টার বসফরাস ক্রুইজে দেখা উল্লেখযোগ্য স্থান বা স্থাপনা গুলো হলঃ-
১) নিউ মস্ক বা নতুন মসজিদঃ- লঞ্চ গালাটা সেতু পেরুতেই প্রথম চোখে পড়ে নিউ মস্ক বা নতুন মসজিদ। অটোম্যান সুলতানদের মা, রানীমাকে বলা হত ভ্যালিড সুলতান। ১৫৯৭ খৃস্টাব্দে এ মসজিদের নির্মান কাজ শুরু করেন সম্রাট তৃতীয় মুরাদের স্ত্রী এবং তৃতীয় মেহমুদের মা । এই মসজিদের নির্মান কাজ শুরু করলেও তা অসম্পূর্ন থেকে যায়। ১৬৬০ খৃস্টাব্দে অসম্পূর্ন এ মসজিদ আগুনে পুড়ে গেলে নতুন ভ্যালিড সুলতান তা পুনরায় নির্মান করা শুরু করেন ১৬৬৩ সালে এবং ১৬৬৫ সালে শেষ হয় এর নির্মান কাজ। রানীমার নাম অবুসারে নাম রাখা হয় নতুন ভ্যালিড সুলতান মসজিদ, যা পরে নতুন মসজিদ নামেই পরিচিতি লাভ করে।
নিউ মস্ক ।
২) গালাটা টাওয়ারঃ- বসফোরাস প্রনালী তীরে পাথরের এ স্তম্ভ নির্মান করা হয় ১৩৪৮ সালে। পঞ্চাশ ফুট ব্যাস এবং ২২০ ফুট উচু এ স্তম্ভ নির্মান করা হয় বসফোরাস প্রনালীর উপর নজর রাখার জন্য। অটোম্যান সুলতানদের আমলে এটি ব্যাবহার করা হয় নগরীর আগুন পর্যবেক্ষনের স্তম্ভ হিসেবে। গালাটা টাওয়ারের সাথেই ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ “ ক্যাপ্টেনের চা বাগান” আরো একটু এগিয়ে গেলেই পড়বে-
বিল্ডিং য়ের পেছনে গালাটা টাওয়ারের উপরের অংশ।
৩) ডোলমাবাচী মসজিদঃ- ১৮৫৫ সালে ডোলমাবাচী প্রাসাদের লাগোয়া বসফরাস তীরে এ মসজিদ নির্মান করেন রানীমা ভ্যালিড সুলতান বেজমী আলেমা ।
ডোলমাবাচী মসজিদ।
৪) ডোলমা বাচী ঘড়ি টাওয়ারঃ- ১৮৯৫ সালে ডোলমাবাচী প্রাসাদ গেটের ঠিক বাইরে এ স্তম্ভ নির্মান করেন সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল মজিদ। চারতলা বিশিষ্ট এ স্তভ প্রায় ৯০ ফুট উচু । ১৯৯০ সালে পুরোন ঘড়ি সরিয়ে ইলেকট্রিক ঘড়ি স্থাপন করা হয় এ স্তম্ভের মাথার দিকে।
৫) ডোলমাবাচী প্রাসাদঃ- বসফোরাস প্রনালীর পাড়ে ইউরোপীয় ধাঁচে এ প্রাসাদ নির্মান করেন অটোমান সুলতান আব্দুল মেজিদ। ১৮৫৬ সালে তোপকাপি প্রাসাদ ছেড়ে এখানে বসবাস শুরু করেন অটোম্যান সুলতান। সেই থেকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের শেষদিন ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এ বিলাসবহুল প্রাসাদ ছিল সুলতানদের দরবার এবং বাসস্থান।
ডোলমাবাচী রাজ প্রাসাদ , পেছনের উচু বিল্ডিং এমবাসাডর হোটেল এবন্র তার পাশেই হল তাকসিম স্কোয়ার।
৬)সিরাগান প্রাসাদঃ- অটোমান সুলতান আব্দুল আজিজ ১৮৬৭ সালে এ প্রাসাদ নির্মান করেন। বর্তমানে এ প্রাসাদ হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ হোটেলের “সুলতান স্যুট” এর ভাড়া প্রতিরাতের জন্য প্রায় পনের হাজার ডলার। সি এন এন পরিচালিত এক জরিপে বিশ্বের ১৫টি ব্যায়বহুল হোটেলের মধ্যে এর অবস্থান চতুর্দশ।
৭) গালাটাসারে বিশ্ববিদ্যালয়ঃ- এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯২ সালে । তুরস্কে ফরাসী ভাষায় পরিচালিত একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়এটি ।
৮) ওরটাকয় মসজিদঃ- প্রথম বসফরাস সেতু সংলগ্ন এ মসজিদ নির্মান করেন সুলতান আব্দুল মেজিদ । ১৮৫৬ সালে এ মসজিদের নির্মান কাজ শেষ হয়।
সংস্কারাধীন ওরটাকয় মসজিদ।
৯) মারমারা এসমা সুলতানঃ-ওরটাকয় মসজিদের পাশে ১৮৭৫ সালে নির্মিত এ বাসভবন সুলতান আব্দুল মজিদ কন্যা এসমাকে তার বিয়ের সময় উপহার দেন। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর এর বাইরের দেওয়াল এখনো ইটের তৈরী অবস্থাতেই রাখা আছে।
মারমারা এসমা সুলতান এবং ওরটাকয় মসজিদ।
১০) প্রথম বসফরাস সেতুঃ- বসফপ্রাস প্রনালীর উপর দেড় কিলোমিতার লম্বা এ সেতু নির্মিত হয় ১৯৭৩ সালে। ইউরোপের ওরটাকয় এবং এশিয়ার বেলেরবি সংযোগকারী এই সাসপেনশান সেতু ছিল নির্মানের সময় পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম।
১১) আতা তুর্কের প্রমোদ তরীঃ- মোস্তফা কামাল আতা তুর্ককে এ প্রমোদ তরী উপহার দেন জার্মান প্রবাসী জনৈক তুর্কী মহিলা। কামাল আতা তূর্ক এই নৌযান খুব বেশী দিন ব্যবহার করেন নি।
আতা তুর্কের প্রমোদতরী পাশে প্রথম বসফরাস সেতু।
১২) গালাটাসারে রেস্তোরাঁ- ক্ষুদ্র দ্বীপের উপর গড়ে ওঠা এ রেস্তোরা ইস্তাম্বুলের অরনাভুতকয় এলাকায় অবস্থিত।
১৩) মিশরীয় কন্স্যুলেটঃ- সুন্দর স্থাপত্যের এ কন্স্যুলেট বিল্ডিং সহজেই সবার নজর কাড়ে।
১৪) রুমেলিয়ার দুর্গঃ- তুর্কীভাষায় এ দুর্গের নাম রুমেলিহিসারী। ইস্তাম্বুল জয়ের অল্প কিছুদিন আগে ১৪৫২ সালে এ দুর্গ নির্মান করেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদ। এ দুর্গের তিন প্রধান টাওয়ার। বসফরাস প্রনালীর উপর নজরদারীর জন্য এ দুর্গ নির্মিত হয়।
১৫) দ্বিতীয় বসফরাস সেতুঃ- রুমেলিয়ার দুর্গের পাশে এই সাসপেনশান সেতু নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে। ইস্তাম্বুল বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মেহমুতের নামে এ সেতুর নাম করন করা হয় ফাতিহ মেহমুত সেতু।
১৬) কুসুকসু প্রাসাদঃ- সুলতান দ্বিতীয় মেজিদ ১৮৫৭ সালে নির্মান করেন ছোট এ প্রাসাদ। দ্বিতীয় বসফোরাস সেতুর এশীয় প্রান্তে অবস্থিত এ প্রাসাদ সুলতানেরা স্বল্পকালীন সময়ে বা আমোদ প্রমোদের সময় ব্যবহার করতেন।
১৭) কুলেইলি সামরিক কলেজঃ- এটি তুরস্কের প্রথম সামরিক স্কুল। অটোম্যান সুলতান তৃতীয় সেলিম ১৮৪৫ সালে এ সামরিক স্কুল নির্মান করেন। তুরস্ক এবং রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের সময় এটি সামরিক হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৮) বেইলেরবি প্রাসাদঃ- প্রথম বসফরাস সেতুর এশীয় অংশের পাশের গ্রীস্মকালীন এ প্রাসাদ নির্মান করেন সুলতান আব্দুল আজিজ। ১৮৬৭ সালে নির্মিত এ প্রাসাদে বিদেশী অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান হত। ফ্রান্সের সাম্রাজ্ঞী ইউজেনী সুয়েজখাল উদ্বোধনের সময় ১৮৬৯ সালে এখানে অবস্থান করেন। মাতাল অবস্থায় সুলতানের বাহুতে আবদ্ধ সম্রাজ্ঞীকে চপেটাঘাত করেন সুলতানের মা। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১৮ সালের মৃত্যু পর্যন্ত সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে এই প্রাসাদে অন্তরীন করে রাখা হয়।
১৯) মিহিরিমাহ সুলতান মসজিদঃ- এশীয় অংশে অবস্থিত এ মসজিদ নির্মান করেন অটোমান সুলতান প্রথম সুলেইমান কন্যা মিহিরিমাহ।
২০) মেইডেন টাওয়ারঃ- বসফরাস প্রনালীর দক্ষিন প্রবেশ মুখে ক্ষুদ্র দ্বীপের উপর ডাঙ্গা থেকে দুইশ মিটার দূরে এ স্তম্ভ নির্মান করেন বাইজেন্টাইন সম্রাট আলিক্সিয়াস কোমনেনাস ১১১০ সালে।