ভ্রমনপিপাসুদের জন্য ইস্তাম্বুলে অন্যতম প্রধান আকর্ষন হল নীল মসজিদ বা Blue Mosque তূর্কী ভাষায় সুলতান আহমেত কামি।তোপ কাপি প্রাসাদ থেকে কয়েক মিনিটের রাস্তা হেটে গিয়ে পৌছলাম ব্লু মস্ক এ। ১৯৮৪ সালে প্রথম যখন দিল্লী জামে মসজিদ ঘুরে দেখছিলাম গাইডের মুখে শুনেছিলাম ইস্তাম্বুলের ব্লু মস্ক হল পৃথিবীর বৃহত্তম মসজিদ এবং তারপরেই দিল্লী জামে মসজিদ, যদিও তা ভুল।
১৬০৯ সাল থেকে শুরু করে ১৬১৬ সাল পর্য্যন্ত এই সাত বছর ধরে এই মসজিদ নির্মান করেন প্রথম সুলতান আহমেত । সময়টা ভাল যাচ্ছিলো না তুর্কী সুলতানের। একদিকে হাঙ্গেরীর হ্যাপ্সবুর্গ রাজাদের সাথে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হলেন, অপরদিকে পারস্য যুদ্ধে পরাজয় সুলতানকে চিন্তিত করে তুললো। আল্লাহকে সন্তুস্ট করতে মসজিদ নির্মানের সিদ্ধান্ত নিলেন সুলতান ।যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দিয়ে মসজিদ নির্মানের প্রথা ছিল তুর্কি সুলতানের, কিন্তু সুলতান আহমেতের পক্ষে তেমন কোন যুদ্ধজয় করা সম্ভব হয় নি। ফলে রাজকোষ থেকেই অর্থ ব্যায়ের সিদ্ধান্ত নিলেন সম্রাট। হিপ্পোড্রোমের পাশে হাজিয়া সোফিয়ার মুখোমুখি বাইজেন্টাইন গ্রেট প্যালেসকে ভেঙ্গে ফেলে মসজিদের নির্মান কাজ শুরু হল বিখ্যাত তূর্কী স্থপতি মোহাম্মদ আগার তত্বাবধানে। সৌন্দর্য্য এবং বিশালত্বে এ মসজিদ হাজিয়া সোফিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে এমন ইচ্ছে ছিল সুলতানের।
নীল মসজিদের ভিতরের দৃশ্য।
এ মসজিদে বিশাল প্রধান গম্বুজের পাশে আরো আটটা ছোট গম্বুজ এবং ছয়টি মিনার। মসজিদ বিল্ডিং এর চারদিকে চারটে মিনার গড়ার নিয়ম ছিল সে সময়ে। ছয়টি মিনারের কারন হল মসজিদের বাইরে বিশাল আঙ্গিনার বাইরের দিকে হিপ্পোড্রোমের পাশে তৈরী করা হয়েছিল আরো দুটি মিনার। স্থপতির কাছ থেকে মসজিদের নকশা পেয়ে বেকে বসলেন সুলতান। মুসলমানদের কাছে পবিত্রতম মক্কার মসজিদ-উল –হারা্মেও তখন ছয়টি মিনার । এ মসজিদ মিনারের সংখ্যায় কিছুতেই মসজিদুল হারামের সমান হতে পারে না। সিদ্ধান্ত হল মসজিদুল হারামে অতিরিক্ত আরো একটা মিনার নির্মানের পরই এখানে ছয় মিনারের মসজিদ নির্মান করা হবে। অনান্য মসজিদ কমপ্লেক্সের মত এ মসজিদে আছে সুলতান আহমেত এবং তার ছেলেদের সমাধি, মাদ্রাসা এবং দাতব্য চিকিৎসালয়। পশ্চিম দিকের হিপ্পোড্রোমের পাশের গেটে বিশাল লোহার শিকল ঝোলানো আছে। একমাত্র সুলতান ঘোড়ায় চড়ে এ মসজিদের আঙ্গিনায় আসতে পারতেন। ঢোকার পথে মাথা নীচু করে আল্লাহকে অভিবাদন জানাতে গেটে শিকল ঝোলানোর এই ব্যাবস্থা করা হয়েছিল যা আজও আছে।
হাজিয়া সোফিয়ার দিকের দূর থেকে নীল মসজিদ।
বেশ কয়েক ধাপ সিড়ি বেয়ে হাজিয়া সোফিয়ার দিকের গেট দিয়ে আমরা উঠলাম মসজিদের প্রধান আঙ্গিনায়। সিড়ির পাশে ডান দিকে ওজু করার যায়গা। নামাজের সময় ছাড়া অন্য সব সময় এ মসজিদ সবার জন্য উন্মুক্ত। মসজিদে ঢোকার সময় সবাইকে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। মেয়েদের মাথা ঢাকার জন্য হেড স্কার্ফ এবং জুতোর জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া যায় বিনা মূল্যে। এখানে ঢোকার জন্য কোন ফি নেই তবে প্রবেশ দ্বারের কাছে দান বাক্স রাখা আছে মসজিদের রক্ষনাবেক্ষন এবং অনান্য খরচের জন্য। সাধ্যমত সে বাক্সে দান করেন দর্শনার্থীরা। ১৬১৬ সালে নির্মান কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে আজও এ মসজিদ নামাজ পড়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদ শেষ হওয়ার এক বছর পরে নির্মাতা সুলতান আহমেত মৃত্যবরন করেন মাত্র ২৭ বছর বয়সে। মেয়েরাও এখানে নামাজ আদায় করতে পারে তবে তাদের ঢোকার পথ মসজিদের পেছন থেকে। প্রবেশদ্বারের সিড়ির পাশের বাক্সে রাখা প্লাস্টিক ব্যাগে জুতো পুরে নিয়ে মসজিদের ভেতরে ঢুকলাম আমরা ট্যুরিস্টরা। মেঝেতে কার্পেট বিছানো বিশাল নামাজের জায়গা।
নীল মসজিদ কিন্তু মোটেই নীল নয়। বিশ হাজার নীল ইজনিক টাইলস দিয়ে ভেতরের দেওয়াল, গম্বুজের ভিতরের দিক , এবং স্তম্ভ গুলো মোড়ানো। সেই থেকেই লোক মুখে এ মসজিদের নাম নীল মসজিদ। দু’শ’ ষাটটি জানালা আছে দোতলার গ্যালারীতে । রঙ্গীন কাঁচ দিয়ে ঢাকা সে জানালাগুলো। ঝাড়বাতি এবং অসংখ্য বাতির আলোতে মসজিদের ভিতর ভাগ অপূর্ব সুন্দর। পবিত্র কোরানের আয়াত এবং আরবী হস্তলিপিতে ভরপুর দেওয়াল , স্তম্ভ এবং গ্যালারী । সহযাত্রী ট্যুরিস্টদের কেউ কেউ দোয়া দরুদ পড়লেন। আধঘন্টা মত ভেতরে কাটিয়ে হাজিয়া সোফিয়ার দিকের বেরোনোর গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে প্লাস্টিক ব্যাগ ফেরত দিলাম। পায়ে জুতো গলিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলাম মসজিদ চত্বর থেকে। ট্যুরিস্ট গাইডের কথা মত মসজিদের ছবি তোলার জন্য সবাই গিয়ে হাজির হলাম হাজিয়া সোফিয়া এবং নীল মসজিদের মাঝামাঝি জায়গায়। অনেকটা তাজমহলের মত এ মসজিদ কাছে থেকে যতটা সুন্দর তার চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর দূর থেকে।
গ্রান্ড বাজারঃ- ইস্তাম্বুলে দুটো বাজার কেনাকাটা করার জন্য প্রসিদ্ধ ১) গ্রান্ড বাজার ২) স্পাইস মার্কেট বা মশলার বাজার । সময়ের অভাবে মশলা বাজার দেখার সৌভাগ্য হয় নি। গ্রান্ড বাজারের ১ নং গেট এর সামনে নামিয়ে দিয়ে ট্যুর গাইড জানালেন গিফট শপ বা স্যুভেনিরের জন্য এ বাজার হল সবচে’ ভাল। ইস্তাম্বুলে এসে কিছু স্যুভেনির না নিয়ে ফিরে যাব, তা কি করে হয়। বেশ বড় এবং প্রাচীন বাজার । ইস্তাম্বুল জয় করার অল্প কিছুদিন পরেই ১৪৫৬ সালে সুলতান আহমেত এখানে ব্যবসার জন্য এ বাজার গড়তে শুরু করেন। এখানে বড় বাজার গড়ে তোলার কারন হল ইস্তাম্বুল ছিল সে সময়ের সিল্ক রুটের উপর। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সংযোগস্থলে সমুদ্র বন্দর থাকায় ব্যাবসা বানিজ্যের প্রধান কেন্দ্রও ছিল ইস্তাম্বুল। বেশ কয়েকবার আগুনে পুড়ে যাওয়া এবং ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর আবার গড়ে তোলা হয়েছে এ বাজার।
বেশ বড় বাজার এটি। প্রায় পাঁচ হাজার দোকান আছে এখানে। বাজারের ভেতরে ৬১ টি রাস্তা এবং ১৮টি গেট আছে এ বাজারের। একঘন্টা মত সময় পেলাম এ বাজারে কেনা কাটা করার। দোকানদাররা সবাই ঠগ এবং কাউকে কাউকে জোচ্চোরও বলা যায়। বিস্তর দামে ফারাক এক দোকান থেকে আরেক দোকানে। ভাষা না জানার একটা অসুবিধে হল দোকানীদের সাথে দামাদামি করতে অসুবিধে হওয়া। এক দোকানে কিছু স্যুভেনিরের দাম অর্ধেকেরও কম দিতে চেয়েও কিনতে বাধ্য হলাম। কিছু কেনাকাটা করে বেরিয়ে এলাম।
আজকের পর্ব অধ্যাপক শাহ আব্দুর রহমান স্যারের গল্প দিয়ে শেষ করি। পিজিতে ফার্মাকোলজির অধ্যাপক আব্দুর রহমান স্যারের ছাত্র ছিলেন এখনকার অধিকাংশ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তার। স্যার ছিলেন খুবই রসিক। ক্লাসে পড়ানোর পাশাপাশি অনেক গল্প করতেন তিনি। একবার ব্যাংককে কোন এক ভারতীয় শিখ দোকানীর কাছ থেকে জুতো কিনেছিলেন। ঢাকার মাছ ব্যাবসায়ীদের মতই সে দোকানী স্যারকে জানাল এ জুতোর দাম এক হাজার থাই মুদ্রা বা বাহত(baht ) কিন্তু স্রেফ আপকে লিয়ে বা শুধুমাত্র আপনার জন্যে তিনশ’ স্যার সে জুতো কিনেছিলেন ৫০ বাহত দিয়ে। দেশে ফিরে এসে নতুন জুতা পায়ে দিয়ে স্যার ক্লাস নিতে যাচ্ছেন। চকচকে নতুন জুতোয় মন কিছুটা পুলকিতও বটে । হঠাৎ স্যারের মনে হল বাম পায়ের জুতো কিছুটা নীচু নীচু লাগছে। স্যারের পেছন পেছন আসা এক ছাত্র খুলে যাওয়া জুতার গোড়ালির অংশ স্যারের কাছে এনে অনেকটা কিছু ফেলে গেলেন কি এর মত করে জিজ্ঞেস করল “স্যার এটা কি আপনার? । স্যারের তুলনায় আমার ভাগ্য কিছুটা হলেও ভাল কারন ইস্তাম্বুলের গ্রান্ড বাজারে কোন শিখ দোকানদার ছিল না বা আমি কোন জুতো কিনিনি। (চলবে)