বাংলা ভাষার বাগধারাগুলোর প্রতিটাই আমার কাছে বিস্ময়। কে, কবে এই ধরনের কথাগুলো বলেছিলো জানিনা, কিন্তু যেই বলে থাকুক, এগুলো একেকটা ক্লাসিক। লা-জওয়াব। আমি অবাক হয়ে ভাবি, কোনো কোনো মানুষের জীবন দর্শন, উপলব্ধি, পর্যবেক্ষণ এবং সেইসব পর্যবেক্ষণের বহিঃপ্রকাশ এতোটা নিখুত হয় কিভাবে? কিভাবে তারা এমন কিছু কথা বলেন যা অতীত থেকে শুরু করে মানব সভ্যতা যতোদিন টিকে থাকবে, ততোদিনের জন্যই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে? হাউ?
''কুকুরের লেজ কোনোদিনও সোজা হয় না''; পলিটিকাল স্পেকট্রামের দিক দিয়ে এই বাগধারাটার কাছাকাছি আরো দু'টা বাগধারা এই মূহুর্তে মনে পড়ছে..........''রসুনের সব কোয়ার গোয়া এক জায়গাতে'' এবং ''সব শেয়ালের এক রা''!! আপনাদের যাদের চিন্তাভাবনা বক্র, তারা এতোক্ষণ কি ভেবেছেন জানিনা, তবে আমি কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে কথা বলছি!!!
পতিতা হাসিনা...........হে হে হে, দুষ্ট প্রকৃতির মনোভাবসম্পন্নরা নিশ্চয়ই ভাবছেন এটা আমি কি বলছি! হাজার হলেও হাসিনা একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী; তার চরিত্রে তো আমি এমন কলঙ্ক লেপন করতে পারি না, নয় কি? তাহলে আরেকটা বাগধারা বলি, ''যার মনে যা, ফাল দিয়া উঠে তা''। আমি 'পতিত' এর স্ত্রী-লিঙ্গ হিসাবে পতিতা বলেছি। এরশাদকে বলা হতো পতিত স্বৈরাচার, তার ফিমেইল রুপ হলো পতিতা স্বৈরাচার, আপনারা যা ভাবছেন তা না। কথা কি কিলিয়ার, নাকি ভেজাল আছে?
তো যা বলছিলাম, খাসলতের দিক দিয়ে আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রচন্ড মিল আছে। এই দুইদলই ক্ষমতায় থাকলে মাত্রাছাড়া দুর্নীতি করে, জন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর দলের মধ্যে কোন গণতন্ত্রের চর্চা করে না। পারিবারিক রাজনীতিই দল দু'টার শেষ কথা। এরা ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না। কিন্তু ক্ষমতার যেই কেন্দ্রবিন্দু, অর্থাৎ জনগণ; তার বিন্দু মাত্র মুল্যই নাই এদের কাছে। একটা রিসেন্ট উদাহরন দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে।
ড. ইউনুস প্যারিস থেকে ফিরে সেইদিনই সন্ধ্যায় শপথ গ্রহনের পর কোন প্রকার বিশ্রাম নেওয়া ছাড়াই সোজা চলে যান হাসপাতালে আন্দোলনের আহতদেরকে দেখতে। অন্যদিকে হাসিনা যখন গণভবন থেকে বের হওয়ার ফুরসত পেল, হাসপাতালে না গিয়ে গেল বিধ্বস্ত মেট্রোরেইল আর বিটিভি ভবন দেখতে। মানুষের জীবন নাকি সম্পদ, কোনটা দামী? এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন বস্তির সেই ছোট্ট মেয়ের কাছে। বস্তিতে লাগা আগুনে যার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিন্তু আগুনে আটকা পড়া মা'কে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সাংবাদিকদের বলছিল.........ঘর পুরুকগ্গা, মা'রে তো ফিরা পাইছি!!! মা কে সে ফিরে পেয়েছে। তার ঘর পুড়ে গেছে তাতে কোন আফসোস ছিল না কিন্তু মা কে ফিরে পেয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। সেই ছোট্ট মেয়ের কাছ থেকে হাসিনার অনেক শেখার আছে।
অন্যদিকে, পতিতা হাসিনার পতনের পর বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রথম সুযোগেই হাসপাতালে না গিয়ে গেল পল্টনে সমাবেশ করতে। শুরুতে যেই তিনটা বাগধারা বলেছিলাম, তার মাজেজা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? এই দুই দলের নেতৃবৃন্দের মাথায় যদি বিন্দুমাত্র ঘিলু থাকতো, তাহলে লোক দেখানোর জন্য হলেও তাদের উচিত ছিল প্রথম সুযোগেই হাসপাতালে যাওয়া।
লেন্দুপ দর্জির মাসতুতো বোন হাসিনা দর্জি যা করার তো করেছেই, সেসব নিয়ে বলার কিছুই নাই। কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই আশ্চর্য হয়েছি বিএনপির নির্বুদ্ধিতায়। চোখের সামনে জনবিচ্ছিন্ন হাসিনার এমন চরম পরিণতি দেখেও এদের হুশ হলো না। এদের অথর্ব নেতা-কর্মীরা দেড়যুগেও একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নাই; সব সময়ে ধান্ধায় থেকেছে অন্যের কাধে ভর করে ক্ষমতায় যেতে। কখনও বিদেশীদের উপর, কখনও ছাত্র-জনতার উপর। এবার ছাত্র-জনতার সফল আন্দোলনের ফল-স্বরুপ যখন তারা ক্ষমতার সুগন্ধ পাওয়া শুরু করেছে, সাথে সাথেই তারা তাদের নোংরা চেহারা দেখিয়ে দিল!!! এরা এতো নির্লজ্জ কেন? এদের এতো এতো নেতার এক জনের মাথায়ও এই বোধের উদয় হলো না যে, আওয়ামী লীগের এই চরম পতনের পূর্ণ সুযোগ তাদের নেয়া উচিত!!! জনগনের সাথে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ কি বার বার আসে? এদের হুশ কবে হবে? আদৌ কি হবে?
পতিতা হাসিনার পতনের পর বিএনপি'র প্রায়োরিটি কি হওয়া উচিত ছিল? দেশে সাংবিধানিক সরকার বা প্রশাসন না থাকায় একটা বিরাট শুন্যতা দেখা দিয়েছিল। এটার সমাধানে ছাত্ররা স্বতস্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমেছে। তারা পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন স্থাপনাসহ এলাকা পরিস্কার করেছে, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে, রাত জেগে এলাকা পাহারা দিচ্ছে, এলাকায় কমিউনিটি পুলিশিং করছে......... আরো কতো কি!!! যে যেভাবে পারছে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এই কাজগুলোতে ছাত্রদের সহযোগিতা করার জন্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ তাদের বিশাল কর্মীবাহিনীকে নির্দেশনা দিতে পারতো। তাদের উচিত ছিল পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে ছাত্র-জনতার সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া। বিএনপি ঘোষণা দিতে পারতো, তারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা-ঘাট পরিস্কার করা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, প্রতিটা পাড়া-মহল্লায় আইন-শৃংখলা রক্ষাসহ ইত্যোকার যতো কাজ ছাত্র-জনতা করছে তাতে অংশগ্রহন করবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান করবে। পথে-ঘাটে কর্মরত ছাত্র-জনতাকে পানি, খাবার, ছাতা ইত্যাদি লজিস্টিক সাপোর্ট দিবে। জামায়াত এই কাজ অনেকটাই করেছে। কিন্তু বিএনপি? তারা তাদের অর্থ আর শ্রম ব্যয় করলো সমাবেশের পিছনে। বাংলাদেশের মানুষ সহজেই সব কিছু ভুলে যায়। দীর্ঘ আওয়ামী অত্যাচারে তারা বিএনপি'র অপশাসনও ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই সমাবেশের আয়োজন পুরানো স্মৃতি অনেকটাই জাগিয়ে তুলেছে। সাধারন জনগন তাদের এই সমাবেশ নিয়ে কি বলছে, তা কি বিএনপি'র ক্ষমতালোভী নেতাদের কান দিয়ে ঢুকে মগজ পর্যন্ত গিয়েছে?
বরং বিভিন্ন স্থান থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে বিএনপি'র লোকজনের চাদাবাজি, এলাকা দখল, মাস্তানী ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়ার। এমনকি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অভিযোগ করে বলেছেন, ''তারেক ভাই আসবে'' এই কথা বলে তার রিসিপশানের জন্য চাদা উঠানো হচ্ছে। এটা সত্যি যে, তাদের হাইকমান্ড কিছু কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে; বহিস্কারের খবর আসছে। ড.ইউনুসের সাথে আলোচনায় তারা তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য কোন চাপও দেয় নাই। কিন্তু এসবই তো যথেষ্ট না। তাদের উচিত নেতা-কর্মীদের সাবধান করে একটা প্রেস রিলিজ প্রকাশ করা। প্রতিটা অপকর্মের কারনে তারা কি কি ইনডিভিজ্যুয়াল পদক্ষেপ নিলো, তা সবিস্তারে তুলে ধরা। নয়তো সাধারন জনগন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে কোন সময়ক্ষেপণ করবে না। যারা জনগনের পালসই বোঝে না, তারা জনগনের সেবা কি করবে?
এবার আওয়ামী লীগের লোকজনকে কিছু কথা বলি। আপনারা আপাততঃ শেষ। আপনাদের ইমেইজ বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। জনগন এখন আপনাদেরকে সামনে পেলে খুবলে খুবলে খাবে। কাজেই কিছুদিন বোরখা পড়ে ঘোরাঘুরি করেন, জাইঙ্গা কিন্তু মাস্ট!!! চিল করেন আর পারিবারিক নেতৃত্বের অবসান করে দলে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করেন। এই যে সব কিছুর জন্য হাসিনা, হাসুবু'র কাছে যাওয়া.........এই কালচার বদলান। স্বামী-স্ত্রী একসাথে ঘুমাইতে পারে না, এটার সমাধানেও হাসিনাকে লাগে। মন্ত্রীরা সব ডামি। শো কেসের পুতুল। পুতুলের কথায় মনে পড়লো, হাসুবুর মেয়ে, মানে আমাদের ভাগ্নীর নাম পুতুল। তার স্বশুর একজন রাজাকার। আওয়ামী সরকারের বাংলাদেশের ফ্ল্যাগওয়ালা গাড়িতে চড়া একজন মন্ত্রী। লজ্জা করে না আপনাদের!!!!!
আমি কোন রাজনৈতিক দলকে সুলেমানী ব্যান করার পক্ষে না। তাই যদি হই তাহলে আপনারা যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেন, তার থেকে আলাদা আর কি হলো? সেই সিদ্ধান্ত জনগনের উপরেই থাকা উচিত। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা যদি দেশে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, দুষ্ট দল এমনিতেই ভাগাড়ে চলে যাবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মতো করেই বলতে চাই, ''পলিটিক্স করতে হলে পলিটিক্যাল পার্টি এ্যাক্ট এর মধ্যে থেকে করতে হবে''। ব্যক্তি বা পরিবার থেকে দলকে পৃথক করার সময় এখন। আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, ৯৬ নির্বাচনের আগে হিজাব পড়া হাসিনার হাতে তসবি নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার ছবি? আর এখন জয়ের সকাল-বিকাল ভিন্ন ভিন্ন বয়ান? '৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর আপনাদের ক্ষমতায় ফিরে আসার কোন রাস্তা ছিলনা। কিন্তু এসেছেন। কোন ফাক দিয়ে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধোয়া তুলে আর বিএনপির অপশাসনের সুযোগ নিয়ে। অতীত থেকে যদি পারেন, কিছুটা হলেও শিখেন। কাজে দিবে। জামায়াতের ঘাড়ে পা রেখে ক্ষমতায় এসেছিলেন একবার; এবার জয় চেষ্টা করছে বিএনপি'র ঘাড়ে পা রাখার। বিএনপি ক্ষমতার লোভে কি সেই ফাদে পা দেবে?
আবার দানব তৈরী করলে শহীদের রক্ত বৃথা যাবে। আমাদের আবার দেখতে হবে রংপুরের আবু সাইদের পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাড়ানো, ঢাকার মুগ্ধর ''পানি লাগবে, পানি?'' কথাগুলো অথবা সাভারে সাজোয়া যান থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে দেয়া ইয়ামীন, কার্নিশে ঝুলে থাকা নাম না জানা ছেলেটা যাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করা হয় সেই ধরনের অবস্থা। এই ভিডিওগুলো যখনই দেখি, চোখের পানি আটকাতে পারি না। এমন হাজারো শহীদের গল্প আছে যেগুলো আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে দেখেছি, কিংবা হয়তো দেখি নাই; কিন্তু প্রতিটা মৃত্যুর ক্ষণ বা প্রেক্ষিত আন্দাজ করতে পারি।
যাকগে, অনেক আবেগের কথা বললাম। শুরুর কথাকে টেনে এনে শেষ কথা বলি। আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের এসব কীর্তি-কলাপ দেখে-শুনে আমার উপলব্ধি হলো, কুত্তার লেজ মাঝে মাঝে খানিকটা সোজা হয় বটে; তবে বেশীরভাগ সময়েই সেটা ক্ষণস্থায়ী। এর স্থায়িত্ব আসলে নির্ভর করে লেজের মালিকের মেজাজ-মর্জি অথবা লিম্বার টেইল সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়া..........না হওয়ার উপর!!!
ছবিসূত্রঃ পুলিশের সাথে ওরা কারা?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১:২৫