আগের পর্বগুলো:
মিউনিখের কড়চা.....প্রথম পর্বঃ হোম অফ দ্য মঙ্কস
মিউনিখের কড়চা.....দ্বিতীয় পর্বঃ মানবতার নির্বাসন-কাল – ১
বহুদিন হলো কোন পোষ্ট দেয়া হয় না। কয়দিন ব্যস্ততা একটু কম, তো ভাবলাম একটা পোষ্টানো যাক। মিউনিখের ২য় বিশ্বযুদ্ধের কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের একটা পোষ্ট বেশ আগে প্রায়-রেডি করে রেখেছিলাম। ভাবলাম, একটু ঠিকঠাক করে ওটাই ঝেড়ে দেই। কিন্তু গত শনিবার সকালে ল্যাপটপের কোনাকাঞ্চি খুজেও হদিস বের করতে পারছিলাম না। ওদিকে রান্নাঘর থেকে হাড়ি-পাতিল পেটানোর জোরদার আওয়াজ ভেসে আসছিল। ''জোরদার'' কারন আমার বিবি সাহেবা গতকাল বলেছিল ফেরার সময় ডিম নিয়ে আসতে, স্টক খালি। আমি গিয়েছি ভুলে। এদিকে সকালে ডিম না খেলে ওনার নাস্তা ইনকমপ্লিট থেকে যায়। ফলে, ''ঝিকে মেরে বউকে শেখানো''র স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে।
ইজ্জতের উপর আসন্ন হামলা আচ করতে পেরে আমিই আগে আক্রমণ শানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। উঠে গিয়ে বললাম, একদিন ডিম না খেলে কি হয়? ধরো এখন মুরগীরা সবাই হঠাৎ ডিম পারা বন্ধ করলো…...কি করবা? আর হাড়ি-পাতিলের উপর এতো অত্যাচারেরই বা মানে কি? ২য় বিশ্বযুদ্ধের একটা পোষ্ট খুজছি, তোমার শব্দের ঠ্যালায় তো মনোযোগই দিতে পারছি না!!
আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বললো, এখ্খনই যদি ডিম না পাই তাহলে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ কেউ ঠেকাতে পারবে না।
ওর খুণে দৃষ্টি দেখে আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বের হলাম। ছুটির দিনে সকাল সকাল ৩য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার কোন মানেই নাই। যেই যুদ্ধে জিততেই পারবো না, সেই যুদ্ধে নামে কোন বেকুব?
ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আগেই ওয়াকিবহাল ছিলাম। এবার অন্যরকমের গুণেরও প্রমাণ পেলাম। ডিম দিয়ে নাশতা করে ল্যাপটপে বসতে না বসতেই পোষ্টটা খুজে পাওয়া গেল!!!
চলেন তাহলে, মিউনিখের দাহাউ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। আগের পর্বে ক্যাম্প সম্পর্কে বেশ খানিকটা ইন্ট্রো দিয়েছিলাম, তাই আর বিস্তারিত বিশেষ কিছু বলছি না।
সেই ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ৪২তম রেইনবো ডিভিশনের সৈন্যরা যখন এই ক্যাম্পে পৌছায়, তখন পর্যন্ত তাদের পরিস্কার কোন ধারনাই ছিল না, কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প জিনিসটা আসলে কি! কিন্তু ক্যাম্পের জায়গায় জায়গায় ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহের স্তুপ, ডজন ডজন ট্রেনের বগি ভর্তি গলিত, কাদা হয়ে যাওয়া মানবদেহের অবশিষ্টাংশ আর হাজারো দন্ডায়মান কঙ্কালসার আদমসন্তানকে তারা যখন সামনে দেখতে পেল; তখন তারা আক্ষরিক অর্থেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এটা ভাষায় বর্ণনাতীত…….বলেছেন সেই সময়ের সাক্ষী এক আমেরিকান আর্মি অফিসার।
২৯শে এপ্রিল, ১৯৪৫ সাল। হিটলারের আত্মহত্যার ঠিক আগের দিন দাহাউ ক্যাম্পের পতন ঘটে। তখন পর্যন্ত এই ক্যাম্পের রেজিস্টার্ড বন্দীসংখ্যা ছিল ৬৭,৬৬৫ যার তিনভাগের একভাগই ছিল ইহুদি। আর মুক্তির দিন জীবিত বন্দী পাওয়া যায় ৩২,০০০।
নিরাপত্তা পরিখা পার হয়ে একটা গেইট। এটা হলো, ''নরকের প্রবেশদ্বার''।
এই সেই গেইট, যেটা দিয়ে সেই সময়ে একবার যেই বন্দী গিয়েছে, সে আর কখনও ফিরে আসেনি। ঢোকার সময়ে ভাবছিলাম, আমি ঢুকছি……..ফিরেও আসবো; কিন্তু কতো হাজার হাজার আদম সন্তান আর কোনদিন পৃথিবীর আলো দেখে নাই। কেমন ছিল তাদের সেই অন্তিম যাত্রা? ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, তারা জানতোও না যে, এটাই তাদের অন্তিম যাত্রা। খুশীমনেই তারা এই গেইট পার হতো। বুঝেন নাই? বলছি; চলেন, ভিতরে ঢুকি আগে।
এই গেইট দিয়ে একটা পাথরের খোয়া বিছানো রাস্তা চলে গিয়েছে। সেটা ধরে একটু আগালেই এই বিল্ডিংটা নজরে আসবে। এটাই সেই গ্যাস চেম্বার আর ক্রিমেটোরিয়াম ভবন। তাহলে এবার চলেন, আপনাদেরকে হিটলারের কুখ্যাত গ্যাস চেম্বার আর ক্রিমেটোরিয়াম ঘুরিয়ে দেখাই। এটার কথা এতো শুনেছি যে, এই গ্যাস চেম্বারের দিকে যাওয়ার সময় আমি ভীষণ রকমের উত্তেজিত আর একই সঙ্গে নার্ভাস ছিলাম।
ভবনের প্রথম ঘরটা ছিল ওয়েটিং রুম। একেবারেই সাদা-মাটা একটা ঘর। সেটার ছবি তোলা হয় নাই। কয়েদিরা সেখানে খুশীমনেই অপেক্ষা করতো। তখন একেকটা রুমে কয়েদিদেরকে গাদাগাদি করে বছরের পর বছর রাখা হতো। গোসল না করা পুষ্টিহীনতায় কাতর শরীরগুলো ছিল খোস-পাচড়ায় ভরা। মাথা ভর্তি থাকতো উকুন। যাদেরকে মেরে ফেলা হবে, তাদেরকে বলা হতো একটা বিশেষ গোসলের মাধ্যমে তাদের শরীর জীবাণুমুক্ত করা হবে, ফলে তারা আরাম পাবে। এই মিথ্যা আশ্বাসে তারা খুশীমনে এখানে চলে আসতো।
এটা হলো, তাদের কাপড়-চোপড় খুলে উলঙ্গ করার ঘর। গোসলের পূর্ব-প্রস্তুতি হিসাবে এখানে তাদের সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে স্তূপ করে রাখা হতো। খেয়াল করে দেখেন, পরের ঘরের দরজার উপরে জার্মান ভাষায় লেখা আছে BRAUSEBAD, অর্থাৎ Shower বা Bath। এটাই আসলে গ্যাস চেম্বারে ঢোকার দরজা। কি নিদারুণ রসিকতা……...কি বলেন!!!
গ্যাস চেম্বার। দেয়ালের আর ছাদের ঝাঝরিগুলো দিয়ে জাইক্লন বি নামের মারণ গ্যাস ছেড়ে দেয়া হতো। চেম্বারের জানালাগুলো ছিল বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য।
গ্যাসের প্রভাবে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর বন্দীরা পেশাব-পায়খানা করে দিতো। অনেকে রক্তবমিও করতো। সেসব ধুয়ে ফেলার জন্য মেঝের এই ড্রেইনেজের ব্যবস্থা ছিল।
ডেথ চেম্বার ১। গ্যাস চেম্বার থেকে মৃতদেহগুলো পোড়ানোর জন্য এখানে এনে রাখা হতো।
ক্রিমেটোরিয়াম। এখানে সর্বমোট চারটা চুল্লী মৃতদেহ পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। আড়কাঠ মানে যে কপিকল দেখছেন, সেগুলো দিয়ে মৃতদেহ ঝোলানো হতো। কেন ঝোলানো হতো, আল্লাহ মালুম। নাৎসীদের কাজ-কারবারই ছিল অন্য মাত্রার। সাক্ষাৎ শয়তানের দোসর ছিল একেকটা!!!
ডেথ চেম্বার ২। বাইরের অন্যান্য জায়গা থেকে পোড়ানোর জন্য মৃতদেহ এনে এখানে রাখা হতো।
এই কম্পাউন্ডের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো গণসমাধিক্ষেত্র আর সৌধ আছে। কয়েকটা দেখেন।
ইংরেজি আর জার্মান ভাষায় লেখা….....…GRAVE OF THOUSANDS UNKNOWN.
ASH GRAVE…………..এখানে শুধু ছাই কবর দেয়া হয়েছিল।
PISTOL RANGE FOR EXECUTION…………….পিছনে যেই সাদা দেয়ালটা দেখছেন, সেখানে বন্দীদেরকে দাড় করিয়ে শুধু পিস্তল দিয়ে গুলি করে মারা হতো। জংলা অবস্থার জন্য দেয়ালের কাছে যাওয়া যায় না। শুনেছি, দেয়ালে কিছু বুলেটের চিহ্ন এখনও রেখে দেয়া হয়েছে।
EXECUTION RANGE WITH BLOOD DITCH……………...বাকীগুলোতে কি এই সুবিধা ছিল না? বিষয়টা ঠিক পরিস্কার না।
GRAVE OF MANY THOUSANDS UNKNOWN…………..সারা কম্পাউন্ডে এই একটাই খৃষ্টানদের গণকবর দেখেছি। বাকী সব সৌধ/কবর ইহুদীদের।
ASHES WERE STORED HERE………...আরেকটা ছাইয়ের গণকবর।
মোটামুটি এই হলো আজকের আয়োজন।
পুরো কম্পাউন্ডটা ঘুরে দেখতে দেখতে যে কারো বুক চিরে অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসবে। আশ্চর্য লাগে, যে ইহুদীরা একসময়ে এতো নির্যাতন, নিপীড়ন আর গণহত্যার শিকার হয়েছিল, আজ সেটাই তারা চালিয়ে যাচ্ছে প্যালেস্টাইনে। এই ক্যাম্প, এই গণকবরগুলো দেখেও কি তাদের বুক কাপে না? নেতানিয়াহু আর হিটলারে কি আদৌ কোন পার্থক্য আছে? হিটলার আর তার সাধের জার্মানীর যেভাবে পতন হয়েছিল, নেতানিয়াহু আর তার ইজরায়েলের নিশ্চিত পতনও একদিন সেভাবেই হবে। মাঝখান দিয়ে লক্ষ লক্ষ আদম সন্তান বেহুদা জীবন হারালো। অত্যাচারীর পতন অবশ্যম্ভাবী, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এই শিক্ষাটাই কেউ নেয় না। ফলে, পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
এই ভিশাস সার্কেল থেকে মুক্তির কোন উপায় কি আদৌ আছে? আমার তো মনে হয় না।
শিরোনামের ছবিটা নিয়েছি উইকিপিডিয়া থেকে। আমেরিকান সৈন্যদের হাতে ক্যাম্পের পতন।
বাকী ছবিসূত্রঃ আমার কমদামী মোবাইল।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন ট্যুরিষ্ট গাইডবুক আর লোকেশানের ইনফরমেশান বোর্ড।