এই মাসের ১ তারিখ, শুক্রবার।
অফিসে গিয়েছি সকাল ১০টায়। ডেস্কে স্টিকি প্যাডের পাতায় বসের একটা নোট সাটানো; তার মানে সে এসে একবার ঘুরে গিয়েছে। লেখা, ''দেখা করো, যখন তোমার সময় হয়!'' নোটের ভাষায় একটু খোচার আভাস আছে, তবে আমি ভড়কালাম না। আমাদের অফিস শুরু হয় সকাল ৯টায়, শেষ হয় বিকাল ৫টায়। আগেরদিন কিছু জরুরী কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হয়েছি বিকাল ৮টায়। এ'রকমটা ইদানিং প্রায়ই হয়, কাজেই এক ঘন্টা দেরীতে আসার রাইট আমার আছে। এটা আমার বসও জানে! তারপরেও টিপিক্যাল বস মেন্টালিটি; খুব একটা পছন্দ না হওয়ারই কথা। হু কেয়ার্স!!!
তৎক্ষনাৎ গেলাম বসের রুমে। জানলাম যে, আগামী মঙ্গলবার আমাকে জার্মানীর মিউনিখ যেতে হবে। এইচআরডি'র সারাহও যাবে। আমার চোখে-মুখে প্রতিবাদের ছায়া দেখে বস জানালো, আমি জানি, তোমরা অনেকেই ওকে পছন্দ করো না। তবে তুমি তো আর ওর সাথে হানিমুনে যাচ্ছো না, অফিসের কামে যাচ্ছো। কাম সেরে পরদিন চলে আসবা। কিচ্ছা খতম!! বলে চশমার উপর দিয়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকালো, ঠিক যেভাবে বুড়া রাহাত খান মাসুদ রানার দিকে তাকাতো! ফলে, প্রতিবাদকে বাক্যে পরিণত করার শক্তি আর সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না। বললাম, পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে!! তুমি যখন ইনসিস্ট করছো, কি আর করা! তবে, তুমি তো জানো, আমার কিঞ্চিৎ বেড়ানোর অভ্যাস আছে। বৃহসপতি আর শুক্রবারটা আমাকে ছুটি দাও। কোভিডের কারনে বসে থেকে থেকে শরীরে যে জং ধরেছে, সেটা খানিকটা ছুটায়ে আসি।
আমি জানতাম, তুমি এই প্রোপোজাল দিবা। ওকে যাও, ডান। তবে, মোগল নিয়া কি জানি বললা, বুঝি নাই। বুঝায়ে বলো! সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বসের আব্দার।
আমি চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললাম, এর মানে হলো, হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও……….বাদ দাও। এইসব কথার কথা! তোমার প্রেশার বাড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।
ডেস্কে এসে দেখি সন্দেহজনক একটা হাসি ঠোটের কোণে ঝুলিয়ে অনেকটা রিসিপশান কমিটির ভঙ্গিমায় ক্রিস দাড়িয়ে। ব্যাটা খবর আগেই পেয়েছে! ওকে দেখে মনে পড়লো, প্রতিদিন সকালের কফির মগ হাতে বিড়ি টানার গুরুত্বপূর্ণ কাজটা এখনও বাকী! বাইরে এসে ক্রিস বললো, দেইখো, সারাহ'র লগে আবার কাইজ্জা লাগায়ে দিও না। বস কিন্তু হ্যারে আইজকাল খুব ভালা পায়। তয় বস তোমাগো দুইজনরে একলগে ক্যান পাঠাইতাছে, এইটা বুঝলাম না।
আমি বললাম, সেইটা তোর বুঝনের কাম নাই। বসে কইছে, মফিজ……..তুমি আর সারাহ, দুইজনে মিলমিশ কইরা কাম সাইরা আসবা। আমি কোন ঝামেলা শুনতে চাই না। মনে করো, তোমরা দুইজন হানিমুনে যাইতাছো!!!
ক্রিস একটা মাঝারী স্পন্জের রসগোল্লা সাইজের হা করে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তোৎলাতে তোৎলাতে বললো, কও কি! বসে কইছে এই কথা!! আমি কথার উত্তর না দিয়ে একটা রহস্যময় হাসি ছুড়ে দিলাম ওর মুখের উপরে!!!
বৃটিশ এয়ারওয়েজের বিমানের চাকাগুলো যখন মিউনিখ এয়ারপোর্টের টারমাক স্পর্শ করলো, তখন ঘড়িতে মিউনিখ সময় বিকাল ৫:২০। বিমান থেকে নেমে সারাহকে আমি পিঙ্কি অর্থাৎ কেনে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, তুমি এগোও, আমি কাজ-কাম সেরে আসি। ওয়াশ রুমে ইচ্ছা করেই একটু সময় নিলাম। উদ্দেশ্য, পাথর-মুখের একজনের পাশাপাশি হেটে ইমিগ্রেশানের দিকের দীর্ঘ পথ যেন পাড়ি না দিতে হয়! কিন্তু হা হতোস্মি! বের হয়ে দেখি সে বিরক্তমুখে ওখানেই দাড়িয়ে। আমি বললাম, ঘটনা কি? তোমাকে না বললাম এগুতে? সে ততোধিক বিরক্তমুখে ঘোষণা দিল, একসাথেই যাই!!
হোটেলে এসে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে ভাবছি, আশাপাশের কোন টার্কিশ রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাবাব মেরে দিয়ে আসবো কিনা! পৌনে সাতটার দিকে হঠাৎ হোটেলের ফোন বেজে উঠলো। চমকে উঠে ভাবলাম, কি ব্যাপার? মিউনিখে তো আমার কেউ থাকে না। এরই মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লো নাকি যে, ব্লগার ভুয়া মফিজ এখন মিউনিখে? সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে রিসিভার তুললাম।
সারাহ ফোন করেছে। বললো, আমার ডিনারের টাইম পার হয়ে যাচ্ছে। চলো, হোটেলের রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার সেরে আসি। মনে মনে বললাম, তুমি তো খাইবা ঘাস-লতা-পাতা। তোমার সাথে গিয়া আমার পোষাবে না। মুখে বললাম, আমি ভাবছি, কাবাব খাবো। তুমি তো এসব খাও না। এড়ানোর শেষ চেষ্টা হিসাবে বললাম, বরং তুমি নীচে গিয়ে ডিনার সেরে আসো। আমি বাইরে কাবাব খেতে যাবো।
তুমি যেখানে কাবাব খাবা, সেখানে নিশ্চয়ই স্যালাড-ট্যালাডও পাওয়া যাবে, তাই না!
এতো দেখি নাছোড়বান্দা!! বললাম, যাওয়া তো উচিত, কিন্তু ইন কেইস যদি না পাওয়া যায়?
চেষ্টা করতে তো কোন ক্ষতি নাই!!
অগত্যা কি আর করা। ঘাস-পাতা সব রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায়; কাজেই এড়ানোর খুব একটা উপায়ও নাই। কাছের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বললাম, একবার কাবাব ট্রাই করে দেখবে নাকি? পাল্টা ত্যাড়া প্রশ্ন ধেয়ে এলো, তুমি কি আমার মতো করে একবার খেয়ে দেখবে নাকি?
হাসতে হাসতে বললাম, আমি কি পাগল? মুখ ফস্কে বলেই ভাবলাম মহিলা আবার চেইতা যায় কিনা! আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, না আমার কথা নিয়ে কোন হেলদোল নাই। সে মনোযোগ দিয়ে রেস্টেুরেন্টের টার্কিশ ইন্টেরিয়র দেখছে। যাক বাবা! নিজেকে নিজেই বললাম, ভুয়া মফিজ…….সাবধান! কথাবার্তা বুঝে-সুঝে বলো! তুমি কিন্তু সত্যিকারের হানিমুনে নাই!!!
জার্মান ভাষার মেন্যু ঠিকমতো বুঝি নাই। রুটি দিয়ে মোড়ানো ডোনার কাবাবের বিশাল সাইজ দেখে ঢোক গিললাম…...ভয়ে। দেখে সারাহ'র চোখ কপালে উঠলো। বললো, এটা পুরাটাই তুমি এখন খাবে? আমি একটু ভাব দেখিয়ে বললাম, এতো কিছুই না। এ'রকম দুইটা খাওয়া আমার কাছে ডাল-ভাত।
যার যার মতো খাওয়া শুরু করলাম।
একজন ভদ্রমহিলা, বিশেষ করে সারাহ'র মতো প্রচন্ড রকমের ফর্মাল একজনের সামনে বসে বোয়াল মাছের মতো বিশাল হা করে খাওয়াটা একটা বিশাল দিগদারী ব্যাপার। কিন্তু কিছুই করার নাই। কায়দা-কানুন করে সাইডে কামড় দিয়ে খাচ্ছি। কিন্তু একি সেই জিনিস? এতো সাবধানতার পরেও ঠোটের এদিক-ওদিক সস লেগে যাচ্ছে। মহা ঝামেলা। এক পর্যায়ে দেখলাম, সারাহ তার খাবার স্রেফ নাড়াচাড়া করছে। তেমন একটা খাচ্ছে না। আমি বললাম, কি ব্যাপার খাচ্ছো না যে! টেস্ট ভালো না? অবশ্য এই চীজের টেস্ট ভালো হওয়ার কোন কারনও নাই।
সারাহ আমার কথার জবাব না দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে বললো, আমি জানি, তোমরা অফিসে কেউ আমাকে বিশেষ পছন্দ করো না। অনেকে তো আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করে। কেউ কেউ এমনকি লেসবি-ও বলে। তোমরা সবাই মিলে অনেক মজা করো, কাজের ফাকে ফাকে আড্ডা দাও। একসাথে চা-বিড়ি খাও। আমি পার্টিসিপেইট করি না। আসলে করতে পারি না, আমারই সীমাবদ্ধতা। এটা ভালো কিছু না। কলিগদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা, ভালো কাজের পরিবেশের জন্য খুবই দরকারী। এটা সবচেয়ে বেশী আমারই বোঝার কথা। এই ব্যাপারে উপর লেভেল থেকে আমার উপর চাপও আছে। কিন্তু জানো, আমার আজকের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী না।
আমি মুখভর্তি কাবাব চিবাতে চিবাতে কোন রকমে বললাম, আই এ্যাম লিসনিং!
এরপরে সারাহ তার জীবনের গল্প বলা শুরু করলো। আমি কিছুটা সংক্ষেপে বলি।
আমার ১৬ বছর বয়সে বাবা-মা'র মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। কিছুদিন পরেই মা আরেকটা বিয়ে করে। আমি মা'র সাথে থাকতাম। প্রথম থেকেই আমার নতুন বাবার ভাবসাব আমার কাছে ভালো ঠেকতো না। কেমন করে জানি তাকাতো। একদিন আমি বাসায়, মা তখনও কাজ থেকে ফিরে নাই। বাবাও বাসায় ছিল। হঠাৎ করে সে আমার রুমে ঢুকে পড়ে। আমার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। আমি কোন রকমে বাসা থেকে বের হয়ে এক নেইবারের বাসায় চলে যাই। পরে মা সবকিছু শুনে আমাকে এক খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকেই আমি পড়ালেখা শেষ করি। ওই ঘটনা এরপরে সারা জীবন আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। আমি প্রচন্ড রকমের ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের হয়ে যাই। কারো সাথেই, বিশেষ করে ছেলেদের সাথে মিশতে পারতাম না। এখনও, এই পরিণত বয়সেও সবাইকে আমার একই রকমের মনে হয়। সেই থেকে আমি একা। বাসায় বিড়াল-কুকুর আছে। ওদেরকেই আমি একমাত্র বিশ্বাস করি। ওদের সাথেই কথা বলি, আড্ডা দেই, সময় কাটাই। আমি জানি, পৃথিবীর সব পুরুষ এক রকমের না। কিন্তু কে কেমন, আমি বুঝবো কিভাবে? তাই সবাইকেই এড়িয়ে চলি। এই বিষয়ে অফিসে আমি কাউকে কখনও কিছু বলি নাই। তোমাকেই প্রথম বললাম। কেন বললাম, জানি না। আশা করি, তুমি এটা কারো সাথে শেয়ার করবে না।
সবটা শুনে আমি বাকরুদ্ধ! খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেল আমার। এই ধরনের ঘটনা পত্রিকাতে পড়েছি; টিভিতে, সিনেমায় দেখেছি। কিন্তু চোখের সামনে এমন ঘটনার একজন ভিক্টিমকে এই প্রথম দেখলাম। কিছু হারামজাদার জন্য গোটা পুরুষ জাতিকেই অনেকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দেয়, আর সেজন্যে তাদেরকে দোষও দেয়া যায় না। পুরুষ জাতির একজন প্রতিনিধি হিসাবে আমার কি সারাহ'র কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া উচিত? বললাম, এটা নিয়ে তুমি একেবারেই চিন্তা কোরো না। আমার পেটে বোমা মারলেও কেউ জানবে না; অন্ততঃ যারা তোমাকে চিনে।
সারাহ মুখ তুলে একটা বিষন্ন হাসি দিল। দেখি, ওর চোখের কোন চিক চিক করছে। বললো, আমি জানি। এ'টুকু বিশ্বাস তো তোমাকে আমি করতেই পারি!
কোন সুন্দরী মেয়ের চোখের জল আমি আবার সহ্য করতে পারি না। দেখলে মুছে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ওরটা মোছা কি সঠিক সিদ্ধান্ত হবে? সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে টিস্যুর বক্সটা এগিয়ে দিলাম।
বেয়ারাকে বিলের জন্য ইশারা করতেই এসে বললো, আমাদের রেস্টুরেন্টের বাকলাভা আর আইসক্রিমের কম্বিনেশানের সুনাম সারা মিউনিখ জুড়ে। দিব?
মনে মনে বললাম, ভাগ ব্যাটা। আমাকে জ্যান্ত বাসায় ফিরতে হবে তো, নাকি?
পুনশ্চঃ এটা একজন বিলাতি সারাহ'র জীবনের অপ্রকাশিত গল্প। এই অপ্রকাশিত গল্প সে কেন আমার কাছেই প্রকাশ করলো, সেটা আমি অনুমান করতে পারি। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে নাই। সেটা ঠিকও হতো না। আমি জানি, বিলাতি কিংবা অ-বিলাতি, এমন সারাহ পৃথিবীব্যাপী অনেক আছে। তাদের প্রত্যেকেরই এমন অপ্রকাশিত গল্পও আছে। তারা তাদের জীবনের কোন একটা সময়ে কিছু বিকৃতমনস্ক ''পুরুষ'' নামক কামুক পশুর সংস্পর্শে এসেছে, জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়েছে আর এর ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে; তাদের সকলের প্রতি একজন মানুষ হিসাবে আমার সহমর্মিতা। এর বাইরে একজন সাধারনের আর কিছুই করার নাই।
ছবি সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৪:৫০