গত ১৭ তারিখ শুক্রবার সকালে অফিসে গিয়েই একাধারে দুঃসংবাদ এবং সুসংবাদ শুনলাম। আগে সুসংবাদটা বলি। সেটা হলো, সোমবার সকালে তিনদিনের জন্য আমাকে ওয়েলস যেতে হবে। আর দুঃসংবাদটা এক কথায় বলা যাবে না। বিস্তারিত বলছি, আপনারা নিজ নিজ গুণে বুঝে নিবেন।
ওয়েলসে আমাদের আরেকটা নতুন অফিস চালু হয়েছে, সেজন্যে সেখানকার নতুন আর পুরাতন স্টাফদের জন্য একটা কম্বাইন্ড ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়েছে। এইচআরডি থেকে সারাহ, আইসিটি থেকে হ্যারি আর এফএন্ডপি থেকে ভুয়া মফিজকে সেখানে রিসোর্স পারসন হিসাবে হাজির থাকতে হবে। বসের কাছে গিয়ে তেব্র পরতিবাদ জানিয়েও পাত্তা পেলাম না। প্রতিবাদের কারন প্রথমতঃ, এমনি যেতে আমার কোন আপত্তি নাই, কিন্তু রিসোর্স পারসন হিসাবে যেতে আমার তুমুল আপত্তি…...আপত্তির কারনটা হাটু-কাপা সংক্রান্ত! দ্বিতীয়তঃ আমার সফরসঙ্গীরা; দুইটার একটাও সুবিধার না। কারন বর্ণনা করি।
প্রথমেই হ্যারি। এই হ্যারি কিন্তু প্রিন্স হ্যারি না। বৃটিশ রাজ পরিবারের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নাই। কিন্তু ভাবসাবে ষোল আনার উপর আঠারো আনা। ওর ভাবভঙ্গি দেখলে যে কারো মনে হবে, আইসিটি ডিপার্টমেন্টটা সামলানো, এক সময়ের বৃটিশ সাম্রাজ্য সামলানোর চাইতেও কঠিনতর একটা কাজ! কথা বলে খুবই কম। যাও বা বলে, মনে হয় কোন রোবট কথা বলছে!!
আর সারাহ! আহা!! চল্লিশোর্ধ জিনজার হেয়ারের (লাল চুল) এই মহিলাকে দেখলে মনে হয় ত্রিশও পার হয় নাই। একে আমি ঘাস-লতা-পাতা ছাড়া কিছুই খেতে দেখি নাই কখনও। তার ফিগার ঠিক রাখা আর বয়স লুকানোর এটাই সম্ভবতঃ গোপণ মন্ত্র! তবে, সে তার হাইহীলের খট খট শব্দ তুলে যখন হাটা-চলা করে, তখন আমাদের মতো বুড়ারা তো বটেই, তরুণ স্টাফরাও ঘাড় সোজা রাখতে পারে না; স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওর দিকে বেকে যায়…...আগুন-রঙ ঝাকড়া চুলের সাথে সাথে এমনই তার আগুনে সৌন্দর্য!! ইংলিশ উচ্চারণে সারাহ অনেকটা আমাদের চলতি বাংলায় ছ্যাড়া'র মতো শোনায়। তো, ওকে একবার আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম, তোমার এই নামটা আমাদের বাংলায় হলো ছ্যাড়া, যেটা বলতে সাধারনভাবে ''কামের ছ্যাড়া'' বোঝায়! সেদিনই ওর চাহনী দেখে বুঝে গিয়েছিলাম, আর একটু আগে বাড়লে আমার খবর আছে; এমনই তার সেন্স অফ হিউমার!!!
যাই হোক, যা বলছিলাম! এমন দুইজন সফরসঙ্গীর সাথে কে-ই বা খুশীমনে সফর করবে? বসের হাল্কা প্যাদানী খেয়ে আমি যখন মুখ লম্বা করে বসে আছি, দেখি ক্রিসও মুখ লম্বা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর বিষয়টা হলো, আমাদের এই মিশনের কথা শোনামাত্রই সেও বসের কাছে আব্দার করেছিল যাওয়ার জন্য। ফলাফল…..….কঠিন প্যাদানী!!
যাত্রার দিন সকালবেলা দেখি, বাকী দুজনের সাথে ভুতুড়ে মুখোশ পড়া আরও একজন গাড়ীতে বসা। বান্দা আর কেউ না, নাছোড়বান্দা ক্রিস!! ক্রিসের ইমিডিয়েট বস হলো হ্যারি। ও হ্যারিকে ওর কাজের লোড কমানোর কিসব সুবিধা-টুবিধার লোভ দেখিয়ে ম্যানেজ করেছে। তবে আমার অতো কথায় কাম কি? সাথে ক্রিস থাকলে আর কি চাই!! আমাকে ভড়কে দেয়ার জন্য সে এই মুখোশ কিনেছে…….আর আমার জন্যও একটা নিয়ে এসেছে। এই হলো ওর কাজ-কারবার!! পুরাই পাগল একটা!!!
আমাদের গন্তব্যস্থল সপ্তম শতাব্দীতে গোড়াপত্তন হওয়া প্রাচীণ কিন্তু ছোট্ট ওয়েলশ শহর খ্লানগথলেন (Llangollen)। উচ্চারণ যেটা লিখেছি এটা ইংলিশ না, ওয়েলশ ভাষায়। যাই হোক, জায়গামতো পৌছে হোটেল দেখে দারুন পছন্দ হলো। তিনশত বছরের প্রাচীণ একটা বাড়ী। স্বামী-স্ত্রী মিলে হোটেল বানিয়েছে। নীচে একটা বেডরুম ওদের দখলে, আর উপরে চারটা রুম…...যেগুলো ওরা ভাড়া দেয়। সিটিং রুম, কিচেন আর ডাইনিং রুম নীচে। একেবারেই পারিবারিক পরিবেশ। স্থানীয় কালচার আর খাবার-দাবারের সাথে পরিচিত হতে চাইলে এ'ধরনের বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট হোটেলের তুলনা নাই।
আমরা চারজনই বিড়িখোর। কাজেই চেক-ইন করে মালিককে আমাদের প্রথম জিজ্ঞাসা……..বিড়ি কোথায় খাবো? সে ব্যাক-ইয়ার্ড দেখিয়ে দিল, আর সেই সাথে সাবধান করে দিল, দরজা যেন না লাগাই। কারন, ওই দরজার লকটা ভেতর থেকে খোলে; বাইরে থেকে খুলতে চাবি লাগে! আর বেশী রাতে একা যেন ব্যাক-ইয়ার্ডে না যাই। কারন জিজ্ঞেস করাতে কাধ ঝাকিয়েই কাজ সারলো। বুঝলাম, এই ব্যাপারে সে কথা বলতে উৎসাহী না। উপদেশ শুনে আমরা সবাই যার যার রুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে আমি আর ক্রিস বের হলাম। উদ্দেশ্য শহরটাতে একটা চক্কর দেয়া আর সন্ধ্যায় একেবারে ডিনার করে হোটেলে ফেরা।
রুমে এসে আসল কাজে হাত দিলাম। আগামীকাল যেই প্রেজেন্টেশান নিয়ে কাজ করবো, তা তৈরী করেই নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু যতোই চোখ বুলাই, ততোই বিভিন্ন রকমের ছিদ্র বের হয়! সেসব ছিদ্র বন্ধ করতে করতে একসময়ে ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম। কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে খেয়ালই করি নাই। রাত একটা বেজে গিয়েছে! শুয়ে পড়া দরকার!! কিন্তু ঘুমানোর আগে একটা বিড়ি না খেলে চলবে কি করে? সঙ্গীর আশায় রুম থেকে বের হয়ে দেখি, শুধুমাত্র সারাহ'র রুমে আলো জ্বলছে। সম্ভবতঃ সে তার প্রেজেন্টেশানের ছিদ্র বন্ধ করা নিয়ে পেরেশান এখনও। এতো রাতে ওর রুমে নক করলে কেলেংকারীর আর বাকী থাকবে না কিছু। এদিকে হোটেল মালিকের কথাও মনে পড়লো। তবে নেশার টান হলো সবচেয়ে বড় টান! সেই টান টানতে টানতে আমাকে সিড়ির গোড়ায় দাড় করিয়ে দিল।
গুল্লি মার মালিকের কথার! কি আর হবে? পা টিপে টিপে কাঠের সিড়ি বেয়ে নেমে এলাম নীচে। নীচের তলা পুরাই অন্ধকার…….শুধু একটা সবুজ রংয়ের স্পটলাইট জ্বলছে, যেটা অন্ধকার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দরজা খুলে বাইরে না গিয়ে চৌকাঠে দাড়িয়েই বিড়ি ধরালাম, পাছে দরজা না আবার বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে। ব্যাক গার্ডেনটা চৌ-কোনাকৃতির। আমার সামনে দুই দিকে দুই কোনা, এদিকটাতে এক কোনায় দরজা…...যেটাতে আমি দাড়িয়েছি। বিল্ডিং খানিকটা এক্সটেনশান করায় বাকী কোনাটা সরাসরি দেখা যায় না, দেখতে হলে গলাটাতে হাসের মতো একটা টানা দিতে হয়।
বাইরের পরিবেশটা বেশ গা ছমছমে। হাল্কা কুয়াশার কারনে কেমন একটা ধোয়াটে ভাব। আশেপাশের কোন বাড়িতেই আলো জ্বলছে না। দুরের এক স্ট্রীটলাইটের কিছুটা আলো আসছে ঠিকই, তবে সেটা পরিবেশের উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখছে না। একেবারেই বাতাস-বিহীন একটা নিথর, থম ধরা অবস্থা। আসলে কিছু কিছু পরিবেশ আছে না..…….মানুষ পাশে নিজের বউকে দেখলেও চমকে উঠে, বউটা আসল নাকি পেত্নীজাতীয় কিছু!! ঠিক সেরকমই একটা পরিবেশ।
বিড়ি টানতে টানতে মনে কেমন জানি একটা কু-ডাক দিল। না-দেখা কোনাটাতে আবার কেউ দাড়িয়ে নাই তো! কথাটা মনে হতেই গলা লম্বা করলাম, তখনই দেখলাম জিনিসটাকে। ঢাকায় রিক্সাওয়ালারা যেভাবে দেয়ালের সামনে বসে মুত্র বিসর্জন করে, ঠিক সেই ভঙ্গিতে কিছু একটা পেছন ফিরে বসে আছে। সাদা কাপড় পড়া ছিল মনে হয়, কারন অন্ধকারে জিনিসটা সাদাই দেখেছি। ভয় তাড়ানোর জন্য বিড়িতে একটা কষে টান দিয়ে কাপা কাপা গলায় অনুচ্চ স্বরে হাক দিলাম, হু'জ দেয়ার?? কোন হেলদোল নাই। আবার কিছু একটা বলতে যাবো, জিনিসটা উঠে দাড়ালো। ঠিক মানুষের মতো উঠে দাড়ানো না। কেমন যেন….বসা অবস্থাতেই খাড়া উপরের দিকে লম্বা হয়ে গেল। ঘটনা দেখে মাথার চুলসহ শরীরের সবগুলো পশম একলাফে দাড়িয়ে গেল। আর দেরী করা সমীচীন মনে করলাম না। কিসের বিড়ি, আর কিসের নেশা! তৎক্ষনাৎ ওয়েলশ ভুতকে পশ্চাদ্দেশ প্রদর্শন-পূর্বক উসাইন বোল্টীয় ক্ষীপ্রতায় কয়েক লাফে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। রুমের লাইট অন রেখেই সোজা বিছানায়। পায়ের উপর ভারী কম্বলটা দিয়ে দিলাম; বলা তো যায় না…...আবার আমার রুমে এসে শীতল হাত দিয়ে পা স্পর্শ করে কিনা!!!
ভয়ের চোটেই কিনা জানিনা, রাতের ঘুমটা নির্বিঘ্ন হলো। সকালে উঠে বিছানায় শুয়ে শুয়েই ভাবছিলাম, জিনিসটা আসলে কি ছিল? চোখের ভুল হতেই পারে না, কিছু একটা ছিল নিশ্চিত!!
ঘটনার আদ্যোপান্ত ক্রিসকে বললাম। ঘটনা শুনে সে তো পুরাই বাকরুদ্ধ! তোতলাতে তোতলাতে খৃষ্টীয় দোয়া-দরুদ জাতীয় কিছু একটা বললো, যার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। নাস্তা করতে বসে ক্রিস বিষয়টা সবিস্তারে মালিককে জানালো। মালিক পাথর-মুখ করে পুরোটা শুনে শ্রাগ করে কিচেনের দিকে হাটা দিল। ক্রিস উত্তেজিত হয়ে আমাকে বললো, হারামজাদার কারবারটা দেখলা? ওর বাড়িতে ভুত আছে, এইটা আগে কইবো না? কাইল তোমারে যদি ওয়েলশ ভুতে ধরতো, তাইলে ফিরা গিয়া আমি ভাবীরে কি জবাব দিতাম?
আমি বললাম, তুই তো ব্যাটা মহা ধুরন্ধর! আমার চিন্তা বাদ দিয়া ভাবীরে কি কইবি, সেইটা নিয়া টেনশান করস? যাউকগা, বাদ দে। ভুতের কাহিনী চাউর হইলে ওর ব্যবসা লাটে উঠবো; সেই জন্যই পাত্তা দেয় নাই।
পুনশ্চঃ কাজে গিয়েছিলাম, তাই বেশী ঘুরতে পারি নাই। অল্প কিছু ছবি তুলেছি। আপনারা চাইলে এই পোষ্টের এক্সটেনশান হিসাবে একটা ছবি ব্লগ দিতে পারি। তবে ওয়েলসের সৌন্দর্যের তুলনায় সেসব ছবি কিছুই না। ওয়েলস আসলেই সুন্দর…….খুবই সুন্দর!!!
শিরোনামে দেয়া ওয়েলসের ছবিটা আমি তুলি নাই। এখান থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:১৫