দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আর কিছু লিখবো না ভেবেছিলাম। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে খানিকটা মেজাজ খারাপ করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু না লিখে আর পারলাম কই! লিখে আর কিছু হোক আর না হোক…...মনের রাগ, দুঃখ আর হতাশা কিছুটা হলেও তো প্রশমিত হয়! আমাদের এই প্রিয় প্ল্যাটফর্মের কার্যকারীতা তো এখানেই। যতো দিন যাচ্ছে, আমলা-মন্ত্রীদের কাজ-কারবার ততোই এলোমেলো মনে হচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি আসলেই যে কোনদিকে যাচ্ছে তার পরিস্কার কোন একটা চিত্র কারো কাছেই নাই। সরকারের সব কাজেই এখন ''উঠ ছেড়ি, আইজই তোর বিয়া'' নীতির সমাহার। পরিকল্পনাহীনতার চুড়ান্ত প্রদর্শনী বোধহয় একেই বলে।
করোনা আসলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের সরকারের সফলতা (আসলেই যদি থেকে থাকে), ব্যর্থতা, এই রকম পরিস্থিতিতেও কতিপয় রাজনীতিবিদ আর আমলাদের লোভ, দেশপ্রেমের অভাব, পরিকল্পনাহীনতা, অতিরিক্ত ভারত-প্রেম ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো? তালিকা বড় হতেই থাকবে। তবে অত্যন্ত আশ্চর্য হই এটা দেখে যে, মহামারীর মধ্যেও রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক লম্পটরা তাদের লাম্পট্য প্রদর্শনে কোন রকমের দ্বিধা করছে না। এরা সম্ভবতঃ নিজের মা-বাপ-পরিবার-পরিজনদের মৃতদেহ সামনে রেখেও লাম্পট্য চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ যদি পায়, ছাড়বে না। করোনা রোগীর শ্বাসকষ্ট এখন পরিনত হয়েছে ব্যবসা আর লুটপাটের একটা প্রধান মাধ্যমে।
ছোটবেলায় ঢাকায় দেখতাম বিভিন্ন রুটে লোকাল বাস চলতো। তো, বাস ব্যবসায়ীরা মানুষের পকেট কাটার জন্য চালু করলো বেশী ভাড়ার 'ডাইরেক্ট বাস'। ভালো কথা। কিছুদিন পরে মানুষ দেখলো, আরে এটাতো নামে ডাইরেক্ট, আসলে তো সেই আগের লোকাল বাসই। মানুষ বিশ্বাস হারালো। এরপরে তারা চালু করলো, ননস্টপ সার্ভিস। সেটারও একই দশা। ফলে ব্যবস্যায়ীরা চালু করলো, গেটলক বাস। বলা হলো, এটা জেনুইন গেট লক, এক্কেবারে ডাইরেক্টই যাবে…….ননস্টপ। সেটাও কয়েকদিন পরে হয়ে গেল ফের লোকাল। সাধারন মানুষ কাকে বিশ্বাস করবে?
আমাদের লকডাউনেরও সেই অবস্থা। ১৮ দফা নির্দেশনা অর্থাৎ সাধারন লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন, কঠোর লকডাউন, কার্ফিউ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দিন শেষে সেই পুরানো চিত্র। প্রশ্ন হলো, করোনা প্রতিরোধে সরকারের আদৌ কোন রোডম্যাপ ছিল, নাকি আছে? মাঝখানে যাদের ''দিন আনি, দিন খাই'' অবস্থা, তাদের কোভিড ছাড়াই মরার দশা হয়েছে। একটা সরকার কতোটা উজবুক হতে পারে? আসলেই কতোটা? আমার তো মাথায় ধরে না। একটা মিনিমাম যোগ্যতা তো থাকা দরকার দেশ চালানোর। আমাদের রাজনীতিবিদ আর আমলাদের তো সেটাও নাই। এরা আসলে জানেই না কোন পরিস্থিতিতে কি করা দরকার। শুধু জানে পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে নিজের পকেট ভারী করা যায়।
বসুন্ধরায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত করোনা হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়, রোগী নাই…...এই অজুহাতে। কারন সেই হাসপাতালে প্রতিমাসে খরচ ছিল ৬০ লক্ষ টাকা। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যায়, মাত্র সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ করে সেটাকে চালু রাখলে আজ আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে ডিএনসিসি মার্কেটে আরেকটা হাসপাতালের দরকার পড়তো না। এছাড়া ডিএনসিসি মার্কেটেরই আরেকটা ফ্লোরে ১৩ কোটি ব্যয়ে আরেকটা হাসপাতাল করা হয়েছিল, যেটাও উধাও। অন্যদিকে প্রয়াত কবরীর আইসিইউ সেবা প্রাপ্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তাহলে সাধারন জনগনের কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখা-উপ শাখা ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সেটা কেমন নিয়ন্ত্রণ একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালাই জানেন, খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেন কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আসা কোভিড চিকিৎসা সামগ্রী বছর ধরে পরে থেকে প্রায় নষ্ট হয়ে যায়, শুধুমাত্র সরকারের কোন বিভাগ সেটাকে ছাড় করাবে সেই টানা-হেচড়ায়!! এমনই আমাদের কর্মকর্তাদের কর্মতৎপরতা!!!
ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে চুক্তি হলো তিন কোটি ডোজ সরবরাহের, যেটা প্রতিমাসে ৫০ লক্ষ করে দেয়ার কথা। যার মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পেয়েছে ৭০ লক্ষ ডোজ। একদিকে ভারতীয় সরকারের মুখপাত্র বলছে, বাংলাদেশে ভ্যাক্সিন সরবরাহে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় নাই। অন্যদিকে সেরাম ইন্সটিটিউট বলছে, সরকারী নিষেধাজ্ঞার কারনে তারা বাংলাদেশে কোন নতুন চালান পাঠাতে পারবে না। আর আমাদের ট্রিপল এ্যকটিভ পাপন সর্দার বলছেন, ''তিন কোটি ডোজের মুল্য অগ্রীম পরিশোধের পরও তারা ভ্যাক্সিন দিচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশের কেমন বন্ধু…….তা মুল্যায়নের সময় এসেছে''। সত্যিই!!! একজন আওয়ামী সাংসদ হিসাবে উনার কি জানা নাই যে, বাংলাদেশের এক আজব বন্ধু রাষ্ট্র ভারত! আর কঠিন সত্য হলো এই যে, বাংলাদেশ ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে পুরাপরি এই ভারতের উপরেই নির্ভর করেছে, কোন বিকল্প চিন্তা না করে। ভারতের চোখ উল্টানো কি কোন নতুন বিষয়? আসলে ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে প্রশ্নফাস করা বিশেষ ডিগ্রি লাগবে।
প্রথম ডোজের কথা বাদই দেন, এই প্যাচাপ্যাচির গ্যাড়াকলে পড়ে ভুক্তভোগী হবে যারা ইতোমধ্যে প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছে, তারা। সবাই দ্বিতীয় ডোজের টীকা পাবে কিনা, সেটারই কোন নিশ্চয়তা নাই এখন। টাকা নিয়ে পন্য না দেয়া একটা প্রতারণা। এই প্রতারণা করছে ভারত। ভারত কে? বাংলাদেশের কুটুমবাড়ি। পাপন বলেছেন, ''সরকারের কঠোর ভূমিকা নেয়া উচিত এই ব্যাপারে''। কিন্তু আমাদের সরকার কুটুমবাড়ির বিরুদ্ধে কি বলবেন, বলেন দেখি!!!
এমন একটা পরিস্থিতিতে গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্সকে প্রায় বছর ধরে ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া ঝুলিয়ে রেখেছে সরকার। সমস্যাটা নাকি কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট এর। কার সাথে কিসের কনফ্লিক্ট? নাকি বেক্সিমকোর টীকা মনোপলি যাতে ক্ষুন্ন না হয়, সেটার দেখভাল করছে সরকার? এমন একটা সময়ে আজ যদি আমাদের নিজস্ব একটা টীকা থাকতো, তাহলে ভারতের পা নিয়ে টানাটানি করার দরকার পরতো? নাকি কুটুমদের ইঙ্গিতে গ্লোব বায়োটেককে আটকে রাখা হয়েছে, কে বলতে পারে!! লাইলী-মজনুরা যেখানে একজন আরেকজনের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে……..এই কাবাবে মে হাড্ডি গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স তো সেখানে কোন বিষয়ই না!!!!
একই ধরনের খেলা হয়েছিল গণস্বাস্থ্যের সাথে। সরকারের এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খুবই হতাশাজনক এবং তাদের ইমেজের জন্য লজ্জাজনক। অবশ্য বে-শরম হওয়ার কারনে তারা লজ্জা পান না। কিন্তু আমরা, সাধারন জনগন উনাদের কর্মকান্ডে লজ্জিত হই। আরো বিশেষ করে আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি; কারন, আমাদেরকে অনেক হাস্যরসের মুখোমুখি হতে হয়। কাদের স্বার্থে এবং কেন সরকার এই ধরনের খেলা খেলে, সেটা জানার অধিকার দেশের জনগনের রয়েছে, বিশেষ করে এই ধরনের সেনসিটিভ পরিস্থিতিতে। এমনিতে সরকারী এবং রাজনৈতিক লোকজনেরা দূর্ণীতি করুক, কানাডার বেগমপাড়াতে বাড়ি তৈরী করুক; কিন্তু এমন একটা মহামারীর সময়ে তারা কিছুটা হলেও সততা আর কর্মতৎপরতা দেখাক.…….এ'টুকু তো আমরা চাইতেই পারি!
এখন আবার অক্সিজেন নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন খেলা। এই খেলা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে ফেলে সেটাই দেখার বিষয়; কারন, ইতোমধ্যেই জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে; ভয়ের কোনই কারন নাই। আমি খেলা এই কারনে বলছি যে, সরকারের মন্ত্রীরা মুখ খুললেই কেন জানি বিপর্যয় শুরু হয়ে যায়!!!
ভারতে ডাবল/ট্রিপল মিউট্যান্ট সনাক্তের খবর জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা (B1617ভ্যারিয়েন্ট)। এগুলো বর্তমানগুলোর চেয়ে নাকি তিনগুন বেশী শক্তিশালী। সেই ভাইরাস বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে? সেই প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? এটা প্রতিরোধে একটাই উপায় ছিল…….সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া। ভারতের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করা শুরু হয় এপ্রিলের একেবারে শুরু থেকেই। প্রতিদিন ইনফেকশানের হার সেখানে বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে লাখ ছাড়িয়েছে বহু আগেই। শ্মশানগুলো ২৪ ঘন্টাই ব্যস্ত। কবরস্থানে নাকি গনকবর দেয়া হচ্ছে; আর এ'দিকে সরকার ত্যানা প্যাচাতে প্যাচাতে মাত্র গতকাল দু'সপ্তাহের জন্য সীমান্ত বন্ধ করেছে। সর্বনাশ যা হওয়ার, ইতোমধ্যেই যে হয় নাই তার নিশ্চয়তা কে দিবে? দেশে সংক্রমন হঠাৎ যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা কিসের আলামত? সীমান্ত বন্ধ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এতে করে আশাকরি ঢাকা-দিল্লী কুটনৈতিক সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে না। কি আহ্লাদী কথা!! এখন প্রতিটা দেশই প্রয়োজনমতো তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে, কিন্তু কেউ কোন দেশের এই ধরনের আহ্লাদী কথা শুনেছেন? আমাদের সরকারের লোকজনের এমন প্রেমপূর্ণ বানী শুনলে ইচ্ছা করে বাইরে গিয়ে নিজের গাড়ির নীচে শুয়ে পড়ে আত্মহত্যা করি!!!
সর্বশেষ খবর হলো, বর্তমানের ভুয়া লকডাউন বাড়িয়ে ৫ই মে পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রথম থেকেই করোনা নিয়ে সরকারের ছেলেখেলা আর সিদ্ধান্ত বদলের খেলায় সাধারন জনগনও বিভ্রান্ত হয়ে ঢিলেঢালা আর অসাবধান হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের লকডাউনের লক খুলতে খুলতে এখন আর কোন লকই বাকী নাই। সব খুলে দিয়ে এ কেমন লকডাউন? এই সকল তামাশা বন্ধ করা উচিত অবিলম্বে। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে করোনা সংক্রমন? প্রতিবেশী দেশের উচ্চ সংক্রমণের সূত্র ধরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও সময়ে বাংলাদেশে শুরু হয়ে যেতে পারে করোনার তৃতীয় ঢেউ। পরিকল্পনাহীনতা, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা আর দূর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে সামনে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য তা বলাই বাহুল্য!
এই করোনা সহসা তাদের মরণ ছোবল বন্ধ করবে না। সেটা মাথায় রেখে আমাদের প্রশাসক আর নীতি-নির্ধারকগণ দয়া করে একটু গা-ঝাড়া দিবেন কি?
তথ্য ও ছবিঃ গুগলের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১২:৪৮