গত বছরের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের অধীনে পরিচালিত বৈশ্বিক উন্নয়নের নেটওয়ার্ক (UNDP) ২০২০ সালের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক, The Global Knowledge Index (GKI) প্রকাশ করে। এটা ছিল ১৩৮টা দেশের উপরে। তারা এই তাৎপর্যময় ইন্ডেক্স প্রণয়ন শুরু করেছে ২০১৭ সাল থেকে। এটা কিভাবে করা হয়, এর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কি, এই ধরনের ইন্ডেক্স থেকে মুল্যায়িত দেশগুলোর লাভ বা ক্ষতি কেমন ইত্যাদি গুরু-গম্ভীর আলোচনায় যাচ্ছি না। এটা আগ্রহী যে কেউ তাদের ওয়েবসাইট থেকে জেনে নিতে পারবেন। আমার ফোকাসটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। এই ফলাফল নিয়ে দেশের পত্র-পত্রিকায় খানিকটা লেখালেখিও হয়েছে তখন। আমার ধারনা ছিল, ব্লগের কেউ না কেউ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টার উপরে আলোকপাত করবেন। যে কোনও কারনেই হোক, কেউ করেন নাই; অন্ততঃ আমার চোখে পড়ে নাই। লিখবো লিখবো করতে করতে আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই মনে পড়লো। মনে পড়ার কারনটা আপনাদেরকে বলতে মন চাইছে। আপনারা মনে কষ্ট না নিলে বলেই ফেলি…..কি বলেন!!
আমার অল টাইম ফেভারিট কিছু মুভি আছে, যেগুলো আমি সময় পেলেই দেখি। যেমন, উইল স্মিথের দ্য পারসিউট অফ হ্যাপিনেস, দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশান, থ্রি ইডিয়েটস, জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া, সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ইত্যাদি। বহুবার দেখার কারনে এখন আর পুরা মুভিটা দেখি না। ছাড়া ছাড়া ভাবে কিছু অতি পছন্দের ক্লিপস দেখি। তো গত সপ্তাহে এমনিভাবেই হীরক রাজার দেশে দেখছিলাম। দেখলাম, রাজা এক দৃশ্যে শিক্ষামন্ত্রীকে পাঠশালা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। কারন কি? কারন হলো রাজার ভাষায়, ''এরা যতোবেশী পড়ে, ততোবেশী জানে, ততো কম মানে''!! এবার তাহলে হীরক রাজের কয়েকটা বচন শোনাই……...লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই! জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই! বিদ্যালাভে লোকসান, নাই অর্থ নাই মান! সুতরাং…...হীরক রাজা বুদ্ধিমান, করো সবে তার জয়গান!! কেমন লাগলো? এই রাজা তাদেরকেই হীরের মালা (আপনারা চাইলে টেন্ডার, ক্ষমতা, ইনডেমনিটি, ব্যাঙ্ক ঋণ প্রাপ্তি আর তা তুরন্ত মওকুফ ইত্যাদি পড়তে পারেন) উপহার দেন, যারা তার হ্যা'তে হ্যা মিলায়। আর যারা মিলায় না, তাদের গন্তব্যস্থল হয় ''যন্তর-মন্তর ঘর'', যেখানে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে মগজকে ডিফরমেশান করা হয়। মজার না!!!
যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান। বটে!!
এবার তাহলে ফিরে যাই ইন্ডেক্সে। ২০২০ সালের এই ইন্ডেক্সে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবার শেষে বাংলাদেশের অবস্থান (১১২তম)। এমন কি পাকিস্তানও আমাদের আগে। একটু কৌতুহলী হয়ে ২০১৭ সালেরটা দেখলাম। তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০০, আর শুধু পাকিস্তান ছিল আমাদের পিছনে। ২০১৮ তে আমরা ১১১তম, পাকিস্তান আমাদের ঠিক পিছনে। ২০১৯ তে আমরা ১১২তম আর সে বছরই পাকিস্তান আমাদেরকে টপকে আগে চলে যায়। ক্রমাবনতিটা কি দেখা যায়? এটা তো হওয়ারই কথা, তাই না! যেই দেশে জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের নমুনা হলো, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কাজি নজরুল ইসলাম; মাউন্ট এভারেস্ট ইংল্যান্ডে অবস্থিত; নেপালের রাজধানীর নাম নেপচুন; সেই দেশে কি এটাই স্বাভাবিক না! আমাকে ভুল বুঝবেন না। এসব আবোল তাবোল জ্ঞানের কথা কিন্তু আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি না, এটা পত্রিকায় এসেছে।
আপনাদেরকে হতাশ করা দু'টা তথ্য দেই। ১৯৭৫ সালে স্বাধীন হওয়া ভিয়েতনাম; ১৯৭৬ সালে উত্তর আর দক্ষিণ একীভূত হয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করে। দেশটাকে আমেরিকা আক্ষরিক অর্থেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। তারপরেও পরাশক্তি আমেরিকাকে কঠিন প্যাদানী দেয়ার কারনে একসময়ে বলা হতো, অবাক নাম, ভিয়েতনাম। তারা এখনও অবাক করা কাজকারবারই করছে। ইনডেক্সে তাদের অবস্থান ৬৬তম। মাথাপিছু আয়ে কমবেশী আমাদের সমপর্যায়ের আফ্রিকান দেশ কেনিয়া তাদের জাতীয় বাজেটের ৪৫ শতাংশ ব্যয় করছে শিক্ষাখাতে। তাদের অবস্থান ৮৮তম। খুব শীঘ্রই এরা আমাদের ধরাছোয়ার অনেক বাইরে চলে যাবে। আর কোন তথ্য দিয়ে হতাশা বরং আর না বাড়াই! আমাদের রক্ষাকর্তারা কবে বুঝবেন যে, ''জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হওয়া'' বলতে কতিপয় ব্যক্তির ছাড়া ছাড়া ভাবে অগ্রসর হওয়া বোঝায় না, পুরো সমাজেরই অগ্রসর হওয়া বোঝায়। সেই ছোট্টবেলা থেকে পড়ে এসেছি, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। অবশ্য যেই দেশে ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আর পরীক্ষা নেয়ার জন্য আন্দোলন করতে হয়, সেখানে এসব বলা অরন্যে রোদনেরই নামান্তর, নয় কি? ছাত্রছাত্রীরা চাচ্ছে তাদের মেরুদন্ড শক্ত করতে, কিন্তু সরকারের ভাবনা পুরাই ভিন্ন। আমাদের হাট-বাজার খোলা…...গায়ে গা লাগিয়ে লোকজন কেনাকাটা করছে। কক্সবাজারের সৈকতে মানুষের ভীড়ে হাটা যায় না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলি বোঝাই থাকে মানুষে। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই ছাত্র-শিক্ষক সব ভাইরাসের হামলায় মরে সাফ হয়ে যাবে। কি অদ্ভুদ যুক্তি আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের! কি অদ্ভুদ সিদ্ধান্ত আমাদের কর্তাব্যক্তিদের। জনগনের জন্য উনাদের দরদ দেখে আমার চোখের পানি বাধ উপচিয়ে বেরিয়ে আসে। কোনভাবেই আটকাতে পারি না। জনগনের জন্য এমন বুক ভরা দরদ নিয়ে উনারা দিনাতিপাত করেন কিভাবে? ভরা বুক নিয়ে চলাফেরা করতে কষ্ট হয় না!!!
এসব আসলে কিসের আলামত?
কেনিয়ার কথা আগেই বলেছি, তাদের তুলনায় শিক্ষাখাতে ২০২০-২১ সালে আমাদের বরাদ্দ মাত্র ১৫.১ শতাংশ। সেটাও আবার শুধু শিক্ষা না, সেটা হলো ''শিক্ষা এবং প্রযুক্তি'' খাত। দেশের টেকসই প্রকৃত উন্নয়নের জন্য স্বাক্ষর-সর্বস্ব শিক্ষিত সমাজ না, আমাদের প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠি। এই অতুলনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বর্তমান জিপিএ ফাইভ প্রজন্ম যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকের আসনে বসবে, তখন দেশ কোথায় যাবে? উন্নয়নের মহাসড়কেই থাকবে, নাকি ছিটকে পড়বে? এই আকাশ ট্রেন, পাতাল ট্রেন, স্যাটেলাইট, টানেল, নগর, সমুদ্র বন্দর ইত্যাদি এরা কিভাবে চালাবে? বিদেশ থেকে লোকবল এনে? আমি বলছি না, এসব ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল উন্নয়নের দরকার নাই। আছে। কিন্তু সবার আগে দরকার প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত একটা জাতি। ব্যাপার অনেকটা গোয়ালঘর প্রস্তুত না করেই গরু কেনার মতো। শিক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগ না করে এসবে টাকা খরচ করলে দেশে শুধু কোটিপতিই বাড়বে; কানাডার বেগমপাড়ায় বিলাসবহুল বাড়ির সংখ্যাও বাড়বে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য কাজের কাজ কিছুই হবে না। এসব বড় বড় প্রজেক্টের নেপথ্যে অবৈধ লেনদেনের যে বিশাল কাহিনী লুক্কায়িত রয়েছে, তা তো আমাদের সবারই জানা।
এবার আপনাদের দৃষ্টি একটু ঘোরাতে অনুরোধ করছি আরেকটা বিষয়ে। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশকে বলা হয় উদীয়মান বাঘ। এশিয়ার তো বটেই, কোন কোন সময়ে বিশ্ব-অর্থনীতিরও। জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান UNFPA বলছে, জনসংখ্যার ট্রেন্ড অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশই হলো ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার এক পন্চমাংশই হলো অত্যন্ত তরুণ, যাদের অধিকাংশই এখনও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে নাই। জনসংখ্যার এই বিপুল অংশের যথাযথ ব্যবহারই নির্ধারন করবে বাংলাদেশের আগামীর ভবিষ্যৎ। সত্যি কথা হলো, যে অথর্ব নেতারা আজকে বাংলাদেশ আগামীর ''উদীয়মান বাঘ'' বলে গর্বে বুক ফোলাচ্ছেন, তারা কিন্তু আগামীর বাংলাদেশে থাকবেন না। সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, তারা ব্যাঘ্র-শাবকদেরকে এমনভাবে তৈরী করছেন বা তৈরী হতে বাধ্য করছেন যে, তারা বড় হয়ে নখ-দন্তহীন বাঘে পরিণত হবে; যা কিনা ছাগলও শিকার করতে পারবে না। তাহলে সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট এর তত্ত্বানুসারে না খেয়ে মরা ছাড়া এদের আর কোন গতি কি আছে? প্রশ্নটা আপনাদের কাছে রাখলাম। আশাকরি এই প্রশ্নের গভীরতা আমাদের নেতৃত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করবেন।
আমি জানি, আমার এই লেখা অনেকে এড়িয়ে যাবেন। তাতে কোন অসুবিধা নাই। কারন কথায় আছে, নিজে বাচলে বাপের নাম, তারপরে কোম্পানীর নাম। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে এটা হয়তো সঙ্গতিপূর্ণও বটে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, দাবানল যখন লাগে, তখন আগুন আপন-পর বিবেচনা করে না। সামনে যে বসতভিটাই পড়ুক না কেন, পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। আমরা তো জীবন সায়াহ্নে পৌছেই গিয়েছি। কিন্তু আমাদের সন্তানদের জন্য কোন বাংলাদেশ আমরা রেখে যাচ্ছি? সেই বাংলাদেশে তারা যথাযথ মর্যাদায় বেচে থাকতে পারবে তো? নখ-দন্তহীন বাঘের ভবিষ্যত কি? সময়ই বলে দেবে। তবে কথা হলো, আমরা কি এখনই সময়কে আগামী প্রজন্মের জন্য বিনির্মাণ করবো, নাকি দর্শকের ভূমিকায় বাকী জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিবো?
হীরক রাজের একটা আরেকটা বচন দিয়েই আমার লেখাটা শেষ করছি,
অনাহারে নাহি খেদ, বেশী খেলে বাড়ে মেদ!
হীরক রাজা বুদ্ধিমান, করো সবে তার জয়গান!!
শিরোনামের ছবিটা গুগল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:২২