একজন মানুষ, যিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন। যিনি আমাদের ছেড়ে, এই পৃথিবী ছেড়ে চিরাচরিত নিয়মে চলে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রেখে গিয়েছেন এমন কিছু যা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে অনন্তকাল আদরনীয় থাকবে। বলছি হুমায়ূন আহমেদের কথা। অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন হুমায়ুন স্যার বা শুধুই স্যার। তবে আমার কাছে উনি ছিলেন হুমায়ূন ভাই। ব্লগে আমি লেখালেখি শুরু করার পর থেকে বিভিন্ন দিবসে উনাকে স্মরণ করে বিভিন্ন ধরনের লেখা এসেছে। আমারও প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা করেছে অনেকবার। অনেকবারই কি-বোর্ডে হাত রেখেছি, কিছু লিখবো চিন্তা করে। কিন্তু বার বার হাত সরিয়ে নিয়েছি। বিভিন্ন কথা চিন্তা করে লেখা হয়ে ওঠেনি। উনাকে নিয়ে আমি কিছু লিখতে গেলেই এই ''মফিজ''ও প্রসঙ্গক্রমে সামনে চলে আসে, যেটা আমি চাই না। উনার বিভিন্ন প্রসঙ্গও সামনে চলে আসতে পারে, যেটা উনি হয়তো পছন্দ করতেন না। আমি যেহেতু কোন পদের লেখক না, কি লিখতে কি লিখে ফেলি তার কোন ঠিক নাই। কল্পনা করি, অত্যন্ত প্রচার-বিমুখ ইন্ট্রোভার্ট হুমায়ূন ভাই হয়তো আমাকে ফোন করে বলতেন, এইসব কি লিখছো? এক্ষুনি বাসায় আসো। তোমার কান-ডলা না দিলে শান্তি নাই। এই রকমের অস্বস্তি থেকেই অনেকবার লেখা শুরু করেও শেষ করি নাই, পোষ্ট করা তো অনেক দুরের কথা।
''লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু লেখি না''; এমনি একটা অদ্ভুত দো'টানার মধ্যে থাকতে থাকতে এবার কিছু কথা লিখেই ফেললাম।
হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনে। উনাদের দু'বাসা পরেই ছিল আমাদের বাসা। নেক্সট ডোর নেইবার না হলেও প্রতিবেশী। উনি থাকতেন দোতলায়। উনাদের ঠিক পাশের চারতলা বাড়িটা ছিল আমার অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর। বাড়িটার ছাদ ছিল আমাদের বৈকালিক আড্ডার জায়গা। হুমায়ূন ভাইদের বাসায় একটা লম্বা টানা বারান্দা ছিল। উনি একটা নোটখাতা নিয়ে সিগারেট খেতে খেতে একমাথা থেকে আরেক মাথা পায়চারী করতেন। আর উনার বড় মেয়ে নোভা (তখন পিচ্চি ছিল) উনার চাদরের খুট ধরে উনার পিছনে পিছনে হাটতো। এটা দেখে আমরা খুবই মজা পেতাম। অনেক সময়েই নোভাকে দুষ্টামি করে কিল-ঘুষি দেখাতাম। সে তখন বাবার চাদরের খুট আরো টাইট করে ধরতো। হাটতে অসুবিধা হওয়াতে হুমায়ূন ভাই তাকে কিছু একটা বললে আবার হাল্কা করে ধরতো। যতোদূর মনে পড়ে, উনি কোন সময়ে আমাদের দিকে তাকাতেন না।
একবার পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচের চাদা চাইতে উনাদের বাসায় গিয়েছি আমরা তিন বন্ধু। আমি, আমার চার তলা বাড়ির বন্ধু আর একজন। বসার ঘরে অপেক্ষা করছি, হুমায়ূন ভাই এসে ঢুকলেন, সাথে যথারীতি চাদরের খুট ধরে মেয়ে। দেখে আমরা তিনজনই একসাথে হেসে দিলাম।
হুমায়ূন ভাই বললেন, তোমরা পাড়ার ছেলে। বাসায় এসেছো। চা-নাস্তা দিতে বলেছি, খেয়ে চলে যাও। কোন পয়সা-কড়ি দিতে পারবো না।
আমার ছাদ-মালিক বন্ধু বললো, কিছু না দিলে বসবো না। আরো অনেক বাসায় যেতে হবে। তবে, বড় আয়োজন করছি, অনেক খরচ। সবাই কিছু না কিছু, না দিলে সমস্যা হয়ে যাবে।
হুমায়ূন ভাই বললেন, তোমরা তোমাদের সমস্যা দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমিও আমার সমস্যা দেখছি। আমার লেখালেখির চিন্তার সময়টাতে তোমরা আমার মেয়েকে বিরক্ত করো, আমার মেয়ে আমাকে বিরক্ত করে। তোমরা বিকালে যদি ছাদেই আড্ডা দেও, তাইলে ক্রিকেট খেলো কখন? তারপরে ছাদ-মালিক বন্ধুকে বললেন, ওটাতো তোমাদের বাড়ির ছাদ, তাই না?
আমরা ভাবতাম, উনি আমাদের কাজ-কারবার খেয়াল করেন না। আসলে ঠিকই আমাদের বাদরামী দেখতেন। যাই হোক, উনি সেদিন বেশ ভালো অঙ্কই দিয়েছিলেন। আমাদের প্রত্যাশার চাইতে বেশী। আগে রাস্তায় দেখা হতো, কথা হতো না। সেদিনের পর থেকেই হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে আস্তে আস্তে আমার কথা বলার সূচনা হয়।
আমার বড়চাচা থাকতেন আজিমপুর কলোনীতে। উনি সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। হুমায়ূন ভাই একটা বিশেষ প্রয়োজনে উনার কাছে যেতেন। চাচার বাসায় উনার সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। সেটা অবশ্য আরো পরের কথা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র, আর উনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একদিন সন্ধ্যাবেলা তৃতীয় তলাতে চাচার বাসায় যাওয়ার আগে কলোনীর অন্ধকারের চিপায় নীচে দাড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেট খাচ্ছি, হুমায়ূন ভাই কখন পিছনে এসে দাড়িয়েছেন, খেয়ালও করি নাই। ওই সময়ে আমি প্রেমে এমন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম যে, অনেক সময়ে দিনে-দুপুরেও সামনে দিয়ে হাতি চলে গেলেও কিছুই দেখতাম না; সেখানে সন্ধ্যার ছায়া ছায়া অন্ধকারে তো দেখার প্রশ্নই ওঠে না। উনি পিছন থেকে বলে উঠলেন, তুমি কি উপর থেকে আসলা, নাকি যাবা?
আমি ভয়ানক চমকে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে একেবারে সামনে হুমায়ূন ভাইকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সিগারেট যে হাত থেকে ফেলবো, সেই সময়ও নাই। বেকুবের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি বললেন, ছাগলের মতো তাকায়া আছো কেন? টান দেও, সিগারেটের তো অপচয় হচ্ছে। তোমার সিগারেট খাওয়া দেখে তো আমারও নেশা চেপে গেলো। বলে ফস করে একটা ধরালেন। আমি তখনও সিগারেটে টান দিচ্ছি না দেখে বললেন, খাও। অতি ভদ্রতা করার দরকার নাই। তোমার সব খবরই আমার কাছে আছে। আমেরিকায় আমরা ছাত্র-শিক্ষক একসাথে সিগারেট টানতাম। আমার দিক থেকে কোন অসুবিধা নাই। তাছাড়া এই অন্ধকারে কেউ দেখবে না।
সেদিন নীচে দাড়িয়ে আমরা পনের মিনিটের মতো কথা বলেছিলাম। এর মধ্যেই হুমায়ূন ভাই তিনটা সিগারেট খেয়েছিলেন…...একটা ম্যাচের কাঠি খরচ করে। প্রচন্ড রকমের ধুমপান করতেন উনি। আমি এতো ঘন ঘন ধুমপান করতে আর কাউকে দেখি নাই।
সম্ভবতঃ ১৯৯৪ সালের দিকে হুমায়ূন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। উনি তখন নাটক, সিনেমা আর বই লেখা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, এ'ছাড়া আর কোনও উপায়ও উনার ছিল না। এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আমি চাকুরী নিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে চলে যাই। সবমিলিয়ে উনার সাথে আমার যোগাযোগ কমে যায়।
আরো অনেক পরে ঢাকায় একটা নাটকের স্ক্রীপ্টের মিটিংয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। লান্চের একটু আগে মিটিং শেষ হওয়াতে উনাকে লান্চ করার জন্য অনেক ঝুলাঝুলি করলাম। উনি আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, এই গাছতলায় দাড়িয়ে একটা সিগারেট খেয়ে চলে যাবো। ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বললেন। সেদিনটাতে ছিল গ্রীষ্মের চান্দিফাটা গরম। আমি বললাম, হুমায়ূন ভাই, এই গরমের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিলেন? উনি বললেন, এই রোদের মধ্যে যদি হাটো, তাহলে অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখতে পাবা। মাথায় অনেক রকমের আইডিয়া আসে।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেই কাঠ ফাটা রোদে নেমে পড়লেন। এই ছিলেন হুমায়ূন ভাই। প্রচন্ড খেয়ালী, কল্পনা-প্রবণ এবং অদ্ভুদ একটা চরিত্র। উনার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে এক কাঠ ফাটা দুপুরে রোদের মধ্যে আধাঘন্টা হেটেছিলাম। সর্ষেফুল ছাড়া কিছুই দেখি নাই, কোন আইডিয়াও পাই নাই। ঘেমে নেয়ে এক দোকানে গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা স্প্রাইট খেয়ে সবচেয়ে কাছের রিকসাটায় এক লাফে উঠে পড়েছিলাম। সবাই আসলে হুমায়ুন আহমেদ হতে পারে না! শত চেষ্টা করলেও না!!!
সেই মিটিংয়ের দু'মাস পর রমনার ইষ্টার্ন হাউজিংয়ের পিছনে এক রেকর্ডিং স্টুডিওতে উনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়। দুপুরে মোরগ-পোলাও খেয়ে স্টুডিওর বারান্দায় দাড়িয়ে দু'জন সিগারেট টানছি। উনাকে বললাম, হুমায়ুন ভাই, এবার সিগারেট খাওয়াটা একটু কমান। আপনের এই বয়সে এই পরিমান সিগারেট খাওয়া ঠিক না।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি যথারীতি রসিকতার সুরে বললেন, কাঠাল যদি লিচুকে বলে, তোর গায়ে কাটা; তাইলে কেমন শোনায়?
হুমায়ূন ভাই এমনিতে কথা বলতেন কম, তবে পরিচিত লোক পেলে প্রচুর কথা বলতেন। নুহাশ পল্লীতে কাজে-অকাজে কয়েকবারই গিয়েছিলাম। একবার জোৎস্না রাতে মাঠে বসে উনি বলেছিলেন, দেখছো, কি সুন্দর চাদের আলো। এই জোৎস্নার বন্যা ঢাকায় বসে কিছুই বুঝা যায় না, সেইজন্য সুযোগ পাইলেই এখানে চলে আসি। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়, মারা যাওয়ার পরে জোৎস্না দেখা সম্ভব হবে?
আমার বলার কিছু নাই। উনার ভক্তরা সবাই জানেন, হুমায়ূন আহমেদ জোৎস্না প্রচন্ড পছন্দ করতেন। উনার মধ্যে এই জোৎস্না নিয়ে অনেক পাগলামী ছিল। সেদিন উনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নাই। আজও পারবো না। জানি না, উনি উনার অতিপ্রিয় জোৎস্না দেখতে পারছেন, কি পারছেন না।
ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়,
সত্যি সত্যিই হুমায়ূন ভাইয়ের একটা বিরাট আকুতি ছিল এটা।
শেষ কথাঃ গত ১৩ তারিখ ছিল হুমায়ুন ভাইয়ের জন্মদিন। অনেকেই লিখেছেন, আমারও এটা পোষ্ট করার ইচ্ছা ছিল। ব্যস্ততার জন্য পারি নাই। অনেক কাটাকুটি করে এই লেখাটা দাড় করিয়েছি। আশাকরি, এতে আমার পর্দার পিছনে থাকার সদিচ্ছা আর হুমায়ূন ভাইকে বিরক্ত করার মতো কিছু না থাকা…..দু'টাই নিশ্চিত করতে পেরেছি। তারপরেও যদি কোন ভুল করে থাকি, উনি নিশ্চয়ই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, যদি দেখার সুযোগ থাকে।
ওপারে ভালো থাকুন হুমায়ূন ভাই। আমার ধারনা, বাংলা ভাষা যতোদিন এই পৃথিবীতে টিকে থাকবে, আপনি ততদিনই বাঙ্গালীর হৃদয়ে একইভাবে সমাসীন থাকবেন। এই আসন থেকে আপনাকে সরানো শুধু অসম্ভবই না, অবাস্তব কষ্ট-কল্পনাও বটে!!!
ছবিটা গুগলের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০১