আমার একটা অভ্যাস আছে। বদ অভ্যাসও বলতে পারেন। সেটা হলো, সুযোগ পেলে আমার পুরানো লেখাগুলোতে মাঝে মধ্যে চোখ বুলানো। তবে, লেখাতে যতোটা মনোযোগ দেই, তার চাইতে বেশী মনোযোগ দিয়ে পড়ি সেই লেখাকে ঘিরে মন্তব্যগুলিকে। অনেকদিন পর পড়লে নতুনভাবে পড়ার আনন্দ পাই। কিছুদিন আগে তেমনিভাবে একটা লেখা আমার কাব্যভীতিঃ কেন আমি এমন হইলাম পড়তে গিয়ে একটা মন্তব্যে আমার চোখ আটকে গেলো। মন্তব্যটা করেছিলেন, ব্লগের এবং আমার অন্যতম প্রিয় ব্লগার পদাতিক চৌধুরি।
পড়ে ভাবলাম, উনার মন্তব্যকে যেহেতু আমি একেবারেই রুল আউট করি নাই; তাই দেয়া যাক না হয় গোটা দুয়েক কবিতা!!! ব্লগের প্রিয় ব্লগারদেরও জানার অধিকার আছে, ঠিক কি ধরনের কবিতা আমার কলমের ডগা দিয়ে সেই দুঃসময়গুলোতে বের হতো।
প্রথমটা একটা ছড়া কবিতা। কবিতার নীচে রচনাকাল লেখা আছে ২৯/৫/১৯৮৯। কেন এটা লিখেছিলাম, বিশদ মনে নাই। শুধু মনে আছে, ভারতের হরিজনদের উপর কোন একটা নির্যাতনের খবর পত্রিকায় পড়েই এই কবিতার উৎপত্তি ঘটে।
হরিজন
বল ব্যাটা কুৎসিৎ, বানরের ছানা
এখানে আসতে না করেছি মানা!
তুই হলি হরিজন, নীচ অতিশয়
আমি কি তো দেখছিস, বড় অতিকায়!
আমাদের পদতল, তোদের মহল
সাগরের মতো যার নেই কোন তল!
আমাদের সাথে না করিস তুলনা
মনে না করিস তোরা খুব সেয়ানা।
ছোট ছোটই থাকে, বড় নাহি হয়
বড়রা বড়ই থাকে, নেই কোন ক্ষয়।
ছোট জাত, নীচু জাত, নীচেই থাকিস
দশ হাত দুরে থাক, ছোয়া হলে ইশ!!
এই জন্মেও ছোট, পরজন্মেও
যার কোন রদ নেই শত জন্মেও।
এটাই খোদিত আছে, কপালে লিখন
জেনে নিস; কভু এটা যাবেনা মোচন।
যারা বলে, জাত-পাত সবই বাহানা
তাদের মুখেতে ঝাটা, লাভ হবে না।
এর পরেরটা তথাকথিত আধুনিক কবিতা। কবিতায় যাওয়ার আগে দু'টা কথা বলে নেই। আমার বউ একটা খাবার খুব আগ্রহ নিয়ে খায়। খাদ্যটার নাম টফু। আদি উৎপত্তিস্থল সূদুঢ় চীনদেশে। বউ যেহেতু খায়, ভদ্রতার খাতিরে আমিও খাই। কিন্তু যখনই খাই, আমার ভিতর থেকে একটা দার্শনিক চিন্তা দীর্ঘশ্বাসের মতো বের হয়ে আসে। সেটা হলো, 'ইহা কি খাইলাম, কেন খাইলাম আর না খাইলেই বা জগৎ-সংসারের কি এমন লাভ-ক্ষতি হইতো!!!' কারন, এই খাবারটার আমি স্বাদ বা গন্ধ, কোন কিছুই পাই না। আর এই ভুমিকার কারন হচ্ছে, এই কবিতাটা বর্তমানে পড়ে আমার মনে হলো, ''ইহা কি লিখিয়াছিলাম, কেনই বা লিখিয়াছিলাম। আর না লিখিলেই বা জগৎ-সংসারের কি এমন লাভ-ক্ষতি হইতো!!!''
সত্যিই তাই। এই কবিতার কোন মাথামুন্ডু আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারি নাই। অযথাই সময় নষ্ট করেছিলাম। তখন আসলে বয়স অল্প ছিল, সময়ের মর্যাদা বুঝতাম না। অবশ্য এখনও যে বিশাল বুঝদার হয়ে গেছি, তাও না। সো, হিয়ার ইট গোওজ!
কবিতার নামঃ চন্দ্রাহত মানব মানবী
রচনাকালঃ ৭/৯/১৯৯১
চন্দ্রালোকে হেটে চলেছে দুই মানব মানবী
একে অপরের হাত ধরাধরি করে পরম নির্ভরতায়।
তাদের গন্তব্য তাদের নিজেদের কাছেই অজানা…
এই চলার পথের শুরু, কিংবা শেষ কোথায়?
প্রশ্ন করার জন্য কেউ জেগে নেই এই বিশ্ব-চরাচরে।
অসীমের পানে হেটে চলা দুই মানব মানবী।
এই সেই অসীমতা, যার কোন সীমানা কেউ দেয়নি বেধে!
কেন এই পথ চলা……?
এই দুই পথিকই বা তার কতোটুকু জানে?
শুধু জানে, যেতে হবে আরো অনেক দুর, বহুদুর, সেই সুদূরের পানে।
গন্তব্যহীন এই পথ চলার কি কোন শেষ নেই?
বিরতীহীন এই হেটে চলা কি শুধুই বিলাসিতা?
কিংবা এই বিলাসিতা কি কোন কষ্টের, নাকি আনন্দের?
দু‘জনের কাছেই এই প্রশ্নগুলো অপ্রাসঙ্গিকতায় ভরা মুল্যহীন।
তারা শুধু জানে এই পথচলাই তাদের নিয়তি।
তাই…….
চন্দ্রালোকে হেটে চলেছে দুই মানব মানবী
একে অপরের হাত ধরাধরি করে পরম নির্ভরতায়।
উল্লেখ্য, কবিতা প্রসব করার ক্ষমতা আমার আর এখন নাই। যতোদিন জীবিত ছিলাম, কবিতার প্রসব বেদনা উঠতো ক্ষণে ক্ষণে। যখন-তখন প্রসব করতাম; এমনকি বাসে, রিকশায় কিংবা গাড়িতে পথ চলতে চলতেও। বিবাহিত হওয়ার পর সেই ক্ষমতা চলে গিয়েছে। আমি নিজেই এখন টফু'র মতো হয়ে গিয়েছি। স্বাদ-বর্ণ-গন্ধহীন একটা কিম্ভুতকিমাকার কিছু।
আমাদের কাল্পনিক_ভালোবাসা ভাইজানকে বলছি, আমি জানি আপনাকে প্রতিদিন অনেক কয়টা কবিতা পাঠ করতে হয়। আমি নতুন করে আপনার যন্ত্রণার কারন হতে চাই না (অবশ্য আপনি কবিতা পাঠে আনন্দ পেলে ভিন্ন কথা!!)। কাজেই এই অখাদ্য টফু স্বাদের কবিতা পড়ার থেকে আপনাকে বিরত থাকতে সবিনয়ে নিবেদন জানাইলাম। ''আবেদন'' শব্দটা সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেলাম।
আমার এই লেখাটা ব্লগার পদাতিক চৌধুরিকে উৎসর্গ করছি। আমরা সবাই জানি, উনি এখনও করোনার ধাক্কা শতভাগ সামলে উঠতে পারেন নাই। আমার এই অদ্ভুত কিসিমের কবিতা পড়ে করোনা-উত্তর এই দূর্বলতার সময়ে উনি যদি কিন্চিৎ পরিমানও আনন্দ পান, কিংবা ভালো অনুভব করেন, তাহলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। অবশ্য কবিতা নামক বস্তুটার এহেন দূর্গতি দেখে উনার রাগও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অগ্রীম দু্ঃখ প্রকাশ করছি।
কবিদের এলিট ক্লাসে উঠার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা যে আমার নাই, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। কাজে কাজেই, সামু ব্লগে এটাই আমার প্রথম এবং শেষ কবিতা পোষ্ট। সবাই ভালো থাকবেন।
ছবিটা গুগলের থেকে ধার করা। রবার্ট ফ্রস্টের উক্তিটার গুরুত্ব আশাকরি সবাই বুঝতে পেরেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৩২