প্রথমেই অত্যন্ত সংক্ষেপে একটু ইতিহাস কপচাই।
১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে একটা মিশরীয় দূর্গ পূনঃনির্মানের সময় একজন ফরাসী সৈনিকের একটা পাথর দৃষ্টিগোচর হয়। অদ্ভুদ কিছু বর্ণমালা খোদাই করা ছিল পাথরটাতে। এটাকে সে মুল্যবান কিছু মনে করে তার অধিনায়ককে দেখায় আর এইভাবে নিজের অজান্তেই সে একটা বিশাল অপঠিত ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করে। এই পাথরটাই 'রোজেটা স্টোন' নামে পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রোজেটা স্টোন
পরের বছরগুলোতে অসংখ্য ইতিহাসবিদ, ভাষাতত্ববিদ আর পুরাতত্ববিদ গলদঘর্ম হয়ে যান এটাতে কি লেখা আছে তা বের করার জন্যে। অবশেষে ১৮২২ সালে জ ফ্রসোয়া শম্পলিয় নামক এক ফরাসী এর পাঠোদ্ধার করেন। এটা ছিল প্রাচীন মিশরীয় বর্ণমালা, যা হায়ারোগ্লিফিক্স নামে পরিচিত, তার একটা স্ক্রীপ্ট।
এই ফরাসী ভদ্রলোকের হাত ধরেই জ্ঞানচর্চার একটা নতুন শাখার সূত্রপাত হয়। ইজিপ্টোলজি। কি এটা? এক কথায় বললে, এটা প্রাচীণ ইজিপ্শিয়ান, অন্যকথায় মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা বা গবেষণা। জ ফ্রসোয়া শম্পলিয়র হাত ধরে যেহেতু এর সূ্ত্রপাত, তাই উনি হয়ে যান ফাদার অফ ইজিপ্টোলজি। এই প্রাচীণ মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে যারা গবেষণা করেন কিংবা এ'সম্পর্কিত পড়ালেখা করেন, তাদের কাছে 'হোরাসের চোখ' খুবই পরিচিত একটি বিষয়।
জ ফ্রসোয়া শম্পলিয়
এই 'হোরাসের চোখ' বিষয়টা কি? তাহলে এবার মূল গল্পটা বলি।
হোরাসের মা ছিলেন যাদুবিদ্যার দেবী আইসিস আর বাবা অসিরিস, মৃত্যুপরবর্তী জীবনের দেবতা। কথিত ছিল, দেবতাগিরির সাথে সাথে এই অসিরিস আকাশ এবং মাটির মিশরের অধিপতিও ছিলেন। তো, এ্যাজ ইয়ুজুয়্যাল…….যেখানে রাজত্বের প্রশ্ন, সেখানেই চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র! অসিরিসের ভাই সেথ (যুদ্ধ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ আর ঝড়ের দেবতা) সিংহাসনের লোভে পরে অসিরিসকে মেরে একটা কফিনে পুরে নীলনদে ডুবিয়ে দিয়ে সিংহাসনে চড়ে বসলো।
বিধবা আইসিস বৈধব্যের জ্বালা সইতে না পেরে তার যাদুবিদ্যার বলে অসিরিসকে খুজে বের করে পূনর্জীবন দান করে। গাধা অসিরিস কেমন দেবতা ছিল ইশ্বর জানে, মারাও খায়……..থুক্কু মারাও যায়, আবার নতুন জীবন লাভের জন্য তাকে বউয়ের সাহায্যও নিতে হয়! সে যাই হোক, জ্যান্ত অসিরিসকে দেখে ক্ষীপ্ত সেথ গালাগালি করে তাকে ৪২টা টুকরা করে এবং সারা মিশরে ছড়িয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে, তৎকালীন মিশরে ৪২টা প্রদেশ ছিল; কাজেই সেথের চিন্তা-ভাবনা ইনোভেটিভ ছিল বললে অত্যুক্তি হবে না!
বেচারী আইসিস আবার তার হতভাগ্য বেকুব স্বামীর সব টুকরা খুজে বের করে ( পতিভক্তির এমন উদাহরন সম্ভবতঃ আর কোন মিথে নাই! )। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পুরুষাঙ্গ আর খুজে পায় নাই। এখন এই ইউজলেস খোজা স্বামী দিয়ে আইসিস কি করবে? সে সময়ে ব্লগার শেরশায়েরীও ছিলেন না…...যার কাছ থেকে আইসিস এ'সংক্রান্ত মুল্যবান তথ্য বা সহযোগিতা পেতে পারতো! শেষমেষ দিশামিশা না পেয়ে সে সোনার তৈরী একটা পুরুষাঙ্গ সংযোজন করে অসিরিসের দেহে (আমার মতে, বর্তমানের হিউম্যান বডি পার্টস রিপ্লেসমেন্ট সার্জারীর প্রথম অনুপ্রেরণা সেখান থেকেই আসে)। তৎকালীন মিশরে পূজনীয় সর্বশক্তিমানের কি মহিমা, এই স্বর্ণলিঙ্গের সক্রিয়তায়ই অবশেষে হোরাসের জন্ম হয় (বাচ্চালোগ!…….লাগাও তালিয়া!!!)।
এখানে আরেক দেবী ওয়াদজেৎ এর কথা না বললে তার অবদানের প্রতি অবিচার করা হয়। ইনি হলেন পরম পূজনীয়া সুরক্ষা, সুস্বাস্থ্য আর রাজকীয় ক্ষমতার দেবী। মিশরের ফারাওরা তাদের মুকুটে ইনার প্রতীক ধারন করতেন সবসময়ে। এই দেবী একইসঙ্গে সন্তান জন্মদানকারী মাদেরকেও সুরক্ষা প্রদান করতেন। কথিত আছে, ইনি শিশুদেবতা হোরাসের নার্স হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। শয়তান দেবর সেথের নজর এড়িয়ে মা আইসিস, ওয়াদজেৎ এর সহযোগিতায় হোরাসকে (যে কিনা আবার রাজত্ব আর আকাশের দেবতা) লুকিয়ে রেখে তার বাবার প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ধীরে ধীরে তৈরী করতে থাকে। পরবর্তীতে শয়তান চাচার সাথে হোরাস একাধিক মল্লযুদ্ধ করে। চুড়ান্ত যুদ্ধে চাচা (সেথ) ভাতিজার (হোরাস) বাম চোখ উপড়ে ফেলে। হোয়াট এ শেইম!!!
দেবী ওয়াদজেৎ
ফারাওদের মাথায় সব সময়ে শোভা পেতো দেবী ওয়াদজেৎ
এ'পর্যায়ে চলেন, আপনাদেরকে প্রাচীণ মিশরে চর্মচোক্ষে সেই দেবতাদ্বয়ের যুদ্ধ দেখাতে নিয়ে যাই। এখানে অবশ্য পরিচালক মাতবরী করে সেথকে দিয়ে হোরাসের দুই চোখই তুলে নেওয়ায়; যেটা শুধু অমানবিকই না, মূল ঘটনার সাথে সামন্জস্যহীন। যুগে যুগে এ'ধরনের লোকেরাই ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। যাকগে, আপনারা শুধু বাম চোখই কল্পনা করে নিয়েন দয়া করে কারন মূল স্ক্রীপ্টে তাই বলা আছে। যুদ্ধ দেখতে এইখানে ক্লিকান সেথ এবং হোরাসের মল্লযুদ্ধ
পরবর্তী কাহিনী একটু সংক্ষেপ করি। পতিসেবা করতে করতে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আইসিস এবার ক্ষ্যান্ত দিলে এগিয়ে আসে হোরাসের বউ হাথোর (আনন্দ আর ভালোবাসার দেবী)। সে ওই উৎপাটিত চোখ রিপেয়ার করে ফের হোরাসের অক্ষিকোটরে সংযোজন করে। হোরাস আর সেথের মধ্যে কাইজ্জা ফ্যাসাদ লাগাতার চলতেই থাকে….চলতেই থাকে এবং একপর্যায়ে দেবতা কমিউনিটি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে হোরাসকেই সিংহাসনের জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করে।
এই হোলো হোরাসের চোখের মূল কাহিনী। মিশরীয় মিথ অনুসারে হোরাসের ডান চোখ সূর্য (পৌরুষত্ব) কে প্রতিনিধিত্ব করে, আর বাম চোখ চাদ (নারীত্ব) কে। অনেকে আবার হোরাসের ডান চোখকে 'রা' এর চোখ বলে এবং 'রা' এর সাথে গুলিয়ে ফেলে কারন, 'রা' হলো সূর্যদেবতা। পরবর্তীতে হোরাস তার এই বাম চোখ তার বেকুব দেবতা বাপ অসিরিসকে নিবেদন করে। তারপর থেকেই মিশরীয় মিথে হোরাসের বাম চোখকে পুনরুদ্ধার, নিরাময়, প্রেম, সুরক্ষা এবং ত্যাগের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। এক অর্থে যা নারীত্বের প্রতীকও বটে!
আলোচ্য কয়েকজন দেবতা
এভাবেই প্রাচীণ মিশরীয় মিথে হোরাস এবং তার চোখ একটা বিশেষ ভূমিকা পালনকারী প্রতীকে পরিনত হয়। কিন্তু আধুনিক গবেষকদের কাছে এটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কারন কি? কারন এই প্রতীকটার বিশেষ কিছু ফিচার।
হোরাসের চোখের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সাতটি পৃথক হায়ারোগ্লাইফ রয়েছে যা সাধারণতঃ মিশরীয় ভাষায় "ইর/টি" হয়, যার অর্থ 'তৈরি করা বা করা' বা 'যারা করে'। মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীতে চোখটি যতোটা না 'দেখার অঙ্গ' ছিল, তার চেয়েও বেশী ছিল ক্রিয়া, সুরক্ষা বা রাগের প্রতীক। সেজন্যেই এটা প্রাচীণ মিশরীয় বর্ণমালার এক বা একাধিক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।
জেনে রাখা ভালো, প্রাচীণ মিশরে ভগ্নাংশ লিখতে লব সবসময়ে ১ রাখা হতো। যেমন ১/২, ১/৩, ১/১২ ইত্যাদি। কাজেই তারা ৩/৪ না লিখে লিখতো, ১/২+১/৪। Rhind Mathematical Papyrus প্রাচীণ মিশরীয়দের গাণিতিক উৎকর্ষতার একটা নমুনা। সেখানে হোরাসের চোখের ভগ্নাংশসমূহ এভাবে বর্ণিত আছে,
The right side of the eye = 1 ⁄2
The pupil = 1⁄4
The eyebrow = 1⁄8
The left side of the eye = 1⁄16
The curved tail = 1⁄32
The teardrop = 1⁄64 ( সূত্রঃ উইকিপিডিয়া )
মিথ অনুসারে, সেথ হোরাসের চক্ষু উৎপাটনের পরে প্রচন্ড ক্রোধে ছিড়ে ৬ টুকরা করে। হোরাসের চোখের গাণিতিক মডেলের অংশও ৬টা। হোরাসের চোখের প্রতিটা অংশের কিন্তু স্বতন্ত্র অর্থ আছে। চোখের ডান দিকটা ঘ্রানেন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত, কারণ এটা নাকের কাছাকাছি এবং এই অঙ্গটির সাথে সাদৃশ্যযুক্ত। বলাই বাহুল্য, পিউপিলটা দৃষ্টিশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। ভ্রু চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে, কারণ এটি আমাদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চোখের বাম দিকটা শ্রবণশক্তিকে রিপ্রেজেন্ট করে কারন এটি কানের দিকে নির্দেশ করে। বাঁকা লেজ গম বা শস্যের একটি রোপিত ডাটা থেকে বের হওয়া অঙ্কুরের মতো। খাবারের উপস্থাপনা হিসাবে বা স্বাদ অর্থে এটাকে দেখা হয়। অবশেষে, অশ্রুবিন্দু স্পর্শের অনুভূতিকে উপস্থাপন করে।
মিশরীয় মিথে হোরাসের বাম চোখকে পুনরুদ্ধার, নিরাময়, প্রেম, সুরক্ষা এবং ত্যাগের প্রতীক হিসাবে দেখা হতো এবং সেইসাথে তারা এটাও বিশ্বাস করতো যে, এই চোখের একটা আধ্যাত্মিক শক্তি আছে। এই বিশ্বাস থেকেই তারা তাদের নৌকাতে এই প্রতীক আকতো। এছাড়া, এই প্রতীক সম্বলিত লকেট, তাবিজ, আংটিসহ বিভিন্ন ধরনের গয়নাগাটিও তারা ব্যবহার করতো। যদিও প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অবসান ঘটেছে, তবুও 'হোরাসের চোখ' কেন্দ্রিক শক্তির প্রতি বিশ্বাসী মানুষের অভাব নাই আজও, আর সে কারনেই এই প্রতীকটি এখনও ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে জেলেরা সুরক্ষার জন্য প্রায়শঃই তাদের নৌকা/জাহাজে এই চিহ্নটি আকেন। অনেকে অন্যের অশুভ প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এখনও গহনা হিসাবে হোরাসের চোখ পরেন। এটি অতিপ্রাকৃত শক্তি বা আধ্যাত্মিকতা চর্চাকারী এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তাদের মধ্যেও জনপ্রিয়। এনারা চক্ষুটিকে কেবল একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রতীক হিসাবেই দেখেন না বরন্চ শক্তি, জ্ঞান এবং মায়া (ইল্যিউশান)র উৎস হিসাবেও দেখেন।
প্রাচীণ মিশরীয় লকেট
প্রাচীণ মিশরীয় নৌকা
আধুনিক মিশরীয় লকেট
আধুনিক মিশরীয় নৌকা
আপনারা যারা বহুবিধ বিপদে আছেন, তারা একটা সাদা কাগজে এই চক্ষু অঙ্কন পূর্বক একটা মাদুলিতে ভরে অঙ্গে ধারন করলে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারেন। ব্লগারগণ তাদের যে কোনও পোষ্টে কোন রকমের কু-দৃষ্টি থেকে যদি পরিত্রাণ পেতে চান, পোষ্টের শুরুতেই এটা ঝুলিয়ে রাখতে পারেন……..তবে আগেই বলে রাখি, সাফল্যের কোন গ্যারান্টি আমি আপনাদেরকে দিতে পারবো না! স্যরি!!!
ছবি ও তথ্যের জন্য গুগলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২০ ভোর ৬:২৪