মফস্বল শহরের রাত তিনটা মানে কবরের নিস্তব্ধতা।
এ'সময়ে রাস্তাঘাটে যেখানে একটা নেড়িকুত্তার দেখা পাওয়াও ভার; সে'সময়ে একটা বাড়ি মোটামুটি সরগরম। একটু আগে সেখানে এক নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার আর কান্নার শব্দ, তার একটু পরেই আজানের ধ্বনি; পাড়া-প্রতিবেশীদের বুঝতে কষ্ট হয়নি, ঘটনাটা কি! অতি ঘনিষ্ঠ দু'একজন এতোরাতেও এসে হাজির হয়েছে শুভেচ্ছা জানাতে, আর এরাই মন্ডলবাড়ির উঠানে একটা অসময়ের আড্ডায় মেতে উঠেছে। আড্ডার মাঝেই হঠাৎ ভিতর থেকে চিল-চিৎকার ভেসে এলো, ওই বদইর্যা, ছেড়ার নাম ঠিক করছোস নি?
যাকে উদ্দেশ্য করে এই চিৎকার; সে হলো বদরউদ্দিন মন্ডল, সদ্যজাত পুত্রের গর্বিত পিতা। আর যিনি চিৎকার দিলেন, তিনি হলেন বদরউদ্দিন মন্ডলের মা জননী। পাড়ার লোকজন উনাকে 'হিটলার বুড়ি' হিসাবেই চিনে। কথিত আছে, উনার স্বভাবের কারনে বাসার সামনে কুকুর-বিড়াল, কিংবা উপর দিয়ে কাক-পক্ষীও নাকি এই বাড়ির কাছ ঘেষে না। এহেন মহিলা গত পরশুদিনও বদরউদ্দিন মন্ডলকে রাতে উঠানে বসে বলেছেন, হুন বদইর্যা, তোর বউ যদি এইবারও মাইয়া বিয়ায়, আমি কিন্তু তরে আবার বিয়া করামু। পর পর চাইরখান মাইয়া পয়দা করছে…...এমুন অলুক্ষুইন্যা একটা বউ দিছে আল্লায়! বংশের বাত্তি জ্বালাইবো কে…….কিছু ভাবোস, নাহি খালি গায়ে বাতাস লাগায়া ঘুইরা বেড়াস? বলদ কুনহানকার!
বদরউদ্দিন মন্ডল এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছিল মায়ের কথা। দ্বিতীয় মেয়ে হওয়ার পর থেকেই দিন-রাত মায়ের কাছ থেকে এটা শুনে আসছে সে। আরেকটা বিয়ে করার কথা চিন্তাই করে না বউ অন্তঃপ্রাণ স্বামী, বদরউদ্দিন। বরং সন্তান জন্ম দিতে দিতে নেতিয়ে পড়া বউকে সে আশ্বাস দিয়ে রেখেছে, মেয়ে কিংবা ছেলে যাই হোক…….এবারই শেষ!
বদরউদ্দিন অবশ্য ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক, নাম আগেই ঠিক করে রেখেছিল। ছেলে হলে আনন্দের সীমা থাকবে না, তাই একটা বড়সড় নাম ঠিক করাই আছে…….আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল আলম। ডাকনাম রাখার চল এদের বংশে নাই। আসল নামেরই একটা অংশ ধরে ডাকা হয়। ছেলের দাদী অবশ্য নাম শুনে প্রতিবাদ করে বলেছে, এইডা কেমুন নাম! নামে বংশ পরিচয় থাকবো না! বদরউদ্দিন কান দেয়নি। মন্ডল পদবীটা এমনিতেই তার পছন্দ না। তার উপরে ছেলের নাম আরো লম্বা হয়ে দাড়াবে আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল আলম মন্ডল; কোন মানে হয়? আকীকার সময় হুজুর নাম শুনে বললেন, মাশাআল্লাহ, বড়ই সুন্দর নাম…..খুবই ওজনদার! কিন্তু যার এই নাম, সে ভবিষ্যতে এই ওজন কতোটা বইতে পারবে, এটা কেউই তখন ভাবলো না!!
সে যাকগে। ছেলে হওয়ার পর তার ব্যবসা ফুলে ফেপে বিশাল আকার ধারন করলো। চার মেয়ের পর এক ছেলে, তার উপরে ব্যবসায় এই উন্নতি…...পয়া ছেলেকে মাথায় তুলে রাখার জন্য যথেষ্ট। ধনী হওয়ার সুবাদে মফস্বলের পাট চুকিয়ে বদরউদ্দিন ঢাকায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললো। সময়ের সাথে সাথে ছেলেও এখন বড় হয়ে কলেজে পড়ে। সবার অতি আদরের কারনে ছেলেও হয়েছে কেমন যেন পুতু পুতু স্বভাবের, মেন্দামারা। দাদী তার আদরের নাতিকে সবসময় পুরো নাম ধরেই ডাকেন, আর নাতি তাতে যথেষ্টই বিরক্ত। বাবাকে অনেকবারই বলেছে, নামটা কেটেকুটে একটু ছোট করা যায় কিনা! ছেলের কোন কথাই না ফেলা বদরউদ্দিন এই কথাটা মানতে পারে নাই। বড়ই শখ করে রাখা একটা নাম! বরং ছোটবেলা থেকেই ওকে শেখানো হয়েছে, কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পুরা নাম বলাটাই আদব। এদিকে এখন আদব রাখতে গিয়ে এই লম্বা নাম নিয়ে প্রায়শঃই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল আলমকে।
কলেজে পড়ার সময়েই পাড়ার সবচেয়ে ত্যাদর মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল বেচারা। বন্ধুদের সহযোগিতায় মেয়ের সাথে প্রথম দেখা করার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। মেয়ের প্রথম প্রশ্ন, আপনের নাম যেন কি? নাম বলতেই মেয়ে বলে উঠলো, উহু, এতো বড় নাম পোষাবে না। আপনের আবুল বাশার মোহাম্মদকে সংক্ষেপ করেন…..হবে, এবিএম ফাখরুল আলম। শুনে একটা তেলতেলে হাসি দিয়ে ও বললো, তুমি যা বলো, তাই হবে। মেয়ে আদেশের সুরে বললো, ঠিকাছে…….কাল সকাল ঠিক ১০টার সময় আমার স্কুলের গেটে আসবেন। হাস্নাহেনা ফুল আমার খুবই প্রিয়। এর একটা মালা নিয়া আসবেন। তথাস্ত, বলে এবিএম ফাখরুল আলমের প্রস্থান। এদিকে ও পড়লো বিপদে। জীবনে গোলাপ, জবা আর হালের 'লাল গেন্দা ফুল' ছাড়া আর কোন ফুলই ও চিনে না। পাড়ায় ওর সবচেয়ে প্রিয় বড়ভাই আবু হেনা মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ব্রাকেটে পলাশের (উনিও বিশাল নাম নিয়ে বিব্রত থাকায় সমব্যাথী হিসাবে দু'জনের সখ্যতা বেশী) শরনাপন্ন হলো ও। ভাবলো, নামে যেহেতু হেনা আছে, উনিই এই ফুলের হদিস দিতে পারবেন। কিন্তু দেখা গেল, ফুলের ব্যাপারে ওনার জ্ঞানও গোলাপ, জবা পর্যন্তই, এমনকি লাল গেন্দা ফুলও চিনেন না উনি!!
কি আর করা। শাহবাগের এক ফুলের দোকানদারের পরামর্শে রজনীগন্ধা ফুলের মালা নিয়ে যথাসময়ে যথাস্থানে হাজির হলো ও।
মেয়ে রজনীগন্ধার মালা দেখে বললো, আমি আগেই জানতাম, আপনেরে দিয়া এই কাজ হবে না। আর শোনেন, আমি সারারাত চিন্তা করলাম একটা জিনিস!
কি সেটা? অত্যন্ত সাগ্রহে দু'পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো ও।
এবিএম এ কি হয় জানেন তো!
হ্যা, আবুল বাশার মোহাম্মদ……..
না না। এইটার মানে এন্টি ব্যালাস্টিক মিসাইল! একটা মিসাইলের সাথে আমি সারাজীবন ঘর-সংসার করতে পারবো না!! হি হি হি…….
এই অপমানের পর ওর প্রেম-চেষ্টার ওখানেই সলিল সমাধি ঘটলো। লাভের মধ্যে লাভ হলো, সমস্ত পাড়ার মানুষ কি একটা বিশেষ কারনে এর পর থেকে আড়ালে-আবডালে, ক্ষেত্রবিশেষে সামনাসামনিই, ওকে মিসাইল ডাকা শুরু করে দিল!
বিদেশে পড়তে যাওয়ার খুবই শখ ছিল ওর। একজন মিডিওকার ছাত্র হলেও চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখলো না। কিন্তু ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়ে পড়লো বিপদে। Surname এ আলম দিয়ে পার পেলেও First Name আর Middle Name কি হবে এটা নিয়ে ওর মনে আধার ঘনিয়ে এলো। 'আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল' এর কোন অংশ First Name আর কোন অংশটা Middle Name ঠিক করতে না পেরে শেষে দিশামিশা না পেয়ে First Name এ এবিএম আর Middle Name এ ফাখরুল দিয়ে দিল।
যথাসময়ে ডাক পড়লো ভিসা ইন্টারভিউয়ের জন্য। ভিসা অফিসার এপ্লিকেশান ফর্মে চোখ রেখে বললো, ইয়োর নেইম ইজ এবিএম ফাক্…..তারপর একটু পজ দিয়ে কাধ ঝাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো, হোয়াটএভার! এবিএম তো মনে হচ্ছে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে…...এটার মানে আমরা একটাই বুঝি! তোমার ব্যাখ্যা টা কি দয়া করে বলবে? বদের বদ ব্যাটা যে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে বুঝতে আর বাকী রইলো না আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল আলমের। নামের কারনেই হোক আর অন্য যে কোনও কারনেই হোক, বিদেশে আর যাওয়া হলো না ওর।
ভাবলো, যথেষ্ট হয়েছে। পড়ালেখার ইতি ঘটিয়ে বাবার ব্যবসাতেই ঢুকে পড়লো যথাসময়ে। এবং যথাসময়ে বিয়ের আসরে বর হিসাবেও দেখা গেল ওকে। কাজী সাহেব যথারীতি এলেন কবুল পড়াতে। বললেন, বলুন…...আমি আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল আলম; তারপর একটু থেমে, ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে রসিকতার সুরে বললেন, আবুল বাশার আর মোহাম্মদ ফাখরুল আলম…...পাত্র কি দুইজন? বিশাল এক হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল সমস্ত আসর জুড়ে; আর অক্ষম আক্রোশে ভিতরে ভিতরে ফুসতে থাকলো বেচারা ভিক্টিম!!!
---------------------------------------------------
আরো বছর চারেক পরের কথা। স্কয়ার হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে বসে বসে এতোক্ষণ নিজের জীবনের এসব নাম-সংক্রান্ত বিব্রতকর খন্ডাংশের কথাই ভাবছিল আবুল বাশার মোহাম্মদ ফাখরুল আলম। একটু আগেই ডাক্তার এসে সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছেন……..ছেলে এবং ছেলের মা, দু'জনেই সুস্থ আছে। ছেলে হবে, আগেই জানতো সে। নিজের অতীত দুরবস্থার কথা চিন্তা করে ছেলের নাম আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছে।
নিজের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব বাবার নাম, আর নিজের নামের শেষাংশ মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছে বদরুল আলম। শুধুই……..বদরুল আলম!
'নামের বিড়ম্বনা' এর উপরে একটা কায়দামতো ছবির জন্য অনেকক্ষণ গুগলাইলাম। দেইখা শুইনা মনে হইলো, নামের বিড়ম্বনা নিয়া এমন যুৎসই ছবি আর হইতে পারে না। তাই এইটারেই সিলেক্ট করলাম!!

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:১০