ভেবেছিলাম দেশ, দেশের উন্নয়ন….ইত্যোকার বিষয় নিয়ে আর কিছু লিখবো না, ভাববোও না। উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে কি লাভ? কতিপয় লোভি মানুষ দেশটাকে যেভাবে চালাচ্ছে, দেশ সেভাবেই চলবে। তারচেয়ে ভালো হাল্কা লেখা লিখবো, মাথায় যন্ত্রণা কম হবে। এসব ভারী ভারী বিষয় নিয়ে লেখার জন্য অনেক জ্ঞানী-গুণী এই ব্লগেই আছে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না! যার মনে যা, ফাল দিয়া ওঠে তা! মাত্রই আমার এক 'ব্লগার বন্ধু' দেশ থেকে ঘুরে এসেছে। সে নিজে লেখে-টেখে না, তবে এই ব্লগেই সে একটু সুযোগ পেলেই ঘোরাঘুরি করে। ওর কাছ থেকে দেশের বিতং শুনে মনে হলো, কিছু লেখি। তাছাড়া, দেশ উন্নয়নের মহসড়কে, দেশের অর্থনীতি এখন সিঙ্গাপুরের চেয়েও 'ইস্ট্রং'......এসব শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছে। ভাবলাম, কিছু না লিখলে আর শান্তি পাচ্ছি না। যদিও জানি, এসব লেখার ফলে কোন পরিবর্তনই হবে না কোথাও, তবে নিজে তো একটু শান্তি পাবো! কয়েকদিন মাথার যন্ত্রনা থেকেও কিছুটা রেহাই পাওয়া যাবে।
মোটা দাগে একটা দেশের জাতীয় উন্নতি কি? প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতি, রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা বা সহনশীলতা, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সামাজিক নিরাপত্তা, সুশাসন, সাংস্কৃতিক মৌলিকত্ব, দেশজ উৎপাদন ইত্যাদি প্যারামিটারগুলোকে এক করেই নির্ধারন করা হয় একটা দেশ কতোটা উন্নত।
সাদা চোখে দেখলে, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে…..ঠিক। কিন্তু সেটা আসলে কতোটুকু টেকসই বা ভঙ্গুর সেটাও একটা বিবেচ্য বিষয়। আবার সম্পদ থাকলেই হবে না, তার সুষম বন্টন না হলে সেই সম্পদের কোন দাম নাই। একটা সহজতম পাটিগণিত করি। মনে করেন, আমাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১,৫০০ টাকা। দেশের জনসংখ্যা যদি চারজন হয়, তাহলে মোট ৬,০০০ টাকা। এই ছয় হাজার টাকার মধ্যে তিনজনের কাছে আছে ২০০X ৩ = ৬০০ টাকা। বাকী একজনের কাছে আছে ৫,৪০০ টাকা। এটা হলো দেশের বাস্তব চিত্র। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে চোখ রাখেন পত্রিকার পাতায়। ব্যাঙ্ক ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের কারনে ২০০ জনকে হালে চিহ্নিত করেছে দুদক। মজার ব্যাপার হলো এনারা আছেন বিদেশে। পান্জেরীকে জিজ্ঞেস করেন, ভোর হতে আর কতো দেরী?
বেশী দুরে যাই না। ক্যাসিনো কান্ড এবং একেবারেই লেটেস্ট শামীমা নুর পাপিয়ার কথাই ভাবেন। এসব চুনোপুটিদের কাছে যদি এই পরিমান টাকা থাকে, তাহলে মন্ত্রী-এমপি-সরকারী আমলাদের কাছে কতোটাকা আছে? আপনারা যেমন জানেন না, ওনারাও তেমনি জানেন না। ওনাদের হিসাব রক্ষণকারীরা জানলেও জানতে পারে!! এই ফাকে আপনাদেরকে একটা চুটকি বলি। মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পাপিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে। মজার কথা না!!! পাপিয়াকে গ্রেফতারের নির্দেশও যদি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয় তাহলে দেশে এত্তো এত্তো আবাল মন্ত্রীর দরকার কি? শুধু প্রধানমন্ত্রী থাকলেই তো হয়!!!
আমাদের এই ব্লগেই গুটিকয় উচ্চশিক্ষিত ব্লগার আছেন, যারা ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল দেখেই উন্নতি উন্নতি বলে বগল বাজান। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, এসব অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের মূল উদ্দেশ্য কি? যতো বড় প্রোজেক্ট, তত বেশী দূ্র্ণীতি…..তত বড় অংকের টাকা, নয় কি! একটা উদাহরন দেই। ২০০২ সালে সম্ভবতঃ, বিআরটিসি সুইডেনের বিশ্ববিখ্যাত ভলভোর অনেকগুলো বাস নিয়ে আসে। বছর পাচেকের মাথায় সেগুলো ঢাকার রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। বিআরটিসির ডিপোতে গেলে ওদের দেখা মিলবে। ওদের দেখলে আপনি কেদে দিবেন, আমি নিশ্চিত। অথচ এই বাসগুলোর লাইফ মোটামুটিভাবে ১৫ থেকে ১৮ বছর, ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশী। এ‘ধরনের অসংখ্য, অগুনতি গল্প আছে…..বলে শেষ করা যাবে না।
রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা বা সহনশীলতা এবং সুশাসন নিয়ে কিছু বলতে চাই না। যে দেশে সকালে একখন্ডে বের হয়ে সন্ধ্যায় একখন্ডে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা নাই; সেদেশের সামাজিক নিরাপত্তা নিয়েও কিছু না বলাই ভালো। সাংস্কৃতিক মৌলিকত্ব নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রসঙ্গ চলে আসে। বর্তমান বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষপট বদলে গিয়েছে। এখন বন্দুক দেখিয়ে কেউ দেশের দখল নেয় না। দেশের ভিতরের সুবিধাবাদী মানুষদেরকে ব্যবহার করেই আগ্রাসন চালানো হয়। ভারতীয় চ্যানেলের দৌরাত্ব সম্পর্কে আপনারা সবাই ওয়াকিবহাল। সীমান্ত সন্ত্রাস, করিডোরসহ আরো অনেক ব্যাপারেই ওয়াকিবহাল; শুধু বলি, টিআইবি-র একটা সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিদেশীরা বাংলাদেশ থেকে বছরে ২৬,৪০০ কোটি টাকা পাচার করছে যার সিংহভাগই ভারতে। এই পরিমান টাকা দিয়ে আমরা প্রতিবছরই একটা পদ্মাসেতু তৈরী করতে পারতাম। আর সেই দেশেরই একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলে কিনা, নাগরিকত্ব দিলে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ ভারতে চলে যাবে! হলি কাউ বলবো, নাকি হাউ ফানি বলবো বুঝতে পারছি না!! সঠিক পররাষ্ট্রনীতিও যে উন্নতির একটা মাপকাঠি এটা আমাদের কর্তারা কবে বুঝবে!
শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব নিয়ে আর কি বলবো! শিক্ষার মান কতোটা তলানীতে সেটা আরো আট-দশ বছর পরে পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারবে দেশ ও জাতি। সালাহউদ্দিন যেভাবে দেশের ফুটবলের নিম্নমুখী উন্নতি করছে, সরকারও তেমনিভাবেই শিক্ষাখাতে উন্নয়ন করে যাচ্ছে। এরপরেও সালাহউদ্দিন আবারও নির্বাচনে দাড়াচ্ছে…উন্নয়নের নেশা পুরোপুরি না কাটার ফলে। আর কিছু ভেঙ্গে বলতে হবে?
শুনতে খারাপ লাগলেও, আমাদের দেশে প্রকৃত দেশ প্রেমিকের বড়ই অভাব। দল প্রেমিকে ভরে গিয়েছে দেশটা। একজন রিকসাওয়ালা যা বোঝে, এসব দলপ্রেমিকেরা তাও বোঝে না। অথচ এরাই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে, এরা উচ্চ শিক্ষিত; তবে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়, প্রকৃত শিক্ষা এদের মধ্যে অতি দুর্লভ বস্তু। কথাগুলো কঠিন লাগলো? কিন্তু এটাই বাস্তব, নয়তো উন্নয়নের নামে বিভিন্ন স্টান্টবাজীকে এরা সমর্থন কিভাবে দেয়? শুধুমাত্র তাদের দল করছে বলে?
আমি কোন ভারী ভারী তথ্য-উপাত্তে গেলাম না, প্রয়োজন নাই। এসব চাইলে আপনারা নেট থেকে যখন-তখন দেখে নিতে পারেন। একজন সাধারন নাগরিক এসব গুরুগম্ভীর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামায় না। এরা চোখের সামনে দিনের পর দিন যা দেখে, সেখান থেকেই তাদের বুঝ গড়ে ওঠে।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভালো কথা। কোন দিকে আগাচ্ছে সেটাই আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢোকে না। আসলে আগানোর কথা বললেই তুলনা চলে আসে! কোন একটা সালকে যদি স্টার্টিং পয়েন্ট ধরি, তাহলেই তুলনা করা যায়…..অন্যদের তুলনায় আমরা আসলেই কতোটা এগিয়েছি। গার্মেন্টস আর রেমিটেন্সখাতের কল্যানে পানির মতো টাকা দেশে আসছে। এসব টাকা এসে পড়ছে বানরের হাতে। বানরকে পিঠা ভাগ করতে দিলে সে কি করবে? সঠিকভাবে ভাগ করবে নাকি খাবে? দেশে এখন হরিলুটের মহোৎসব চলছে। যে যা পারছে, যেভাবে পারছে….লুটে-পুটে খাচ্ছে। কম খরচে যেসব সমস্যা করা যায়, তার সমাধান না করে বিশাল বিশাল প্রজেক্ট হাতে নেয়া হচ্ছে। সীমিত সম্পদে জাতীয় উন্নয়নে প্রায়োরিটি'র গুরুত্ব আমরা কবে বুঝবো? এসব বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নেয়ার প্রকৃত কারন কি.....দেশের উন্নয়ন নাকি দলের ও ব্যক্তির উন্নয়ন? আমাদের সব বড় বড় প্রজেক্ট এর ব্যয় অন্য দেশ থেকে অনেক অনেক বেশী। কেন?
দৃশ্যমান স্থাপনা উন্নতির মাপকাঠি না। আমাদের দেশে পরিকল্পনা আর তার বাস্তবায়ন হয় ব্যক্তি আর দলের স্বার্থে, দেশের-জনগনের স্বার্থে না। দেশে ফ্লাইওভার বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ের বাড়ছে জ্যাম। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘন্টা, পুড়ছে কোটি কোটি টাকার জ্বালানী। এই অপচয়ের দায় কার? ঢাকাতে এখনও ম্যানুয়ালী ট্রাফিক কন্ট্রোল হয়, অথচ তুলনা করা হয় প্যারিসের সাথে। যুগের পর যুগ কতো টাকা ব্যয় হয়েছে ট্রাফিক সিস্টেমের উন্নয়নে? ফলাফল? যেই লাউ, সেই কদু। সব নিয়ে যাচ্ছে সরকার দূর্ণীতির মাধ্যমে। যাচ্ছে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর দলীয় লোকজনের পকেটে। পাতি নেতা কিংবা একজন কেরাণীর যদি কোটি কোটি টাকা থাকে, একজন সচিব বা একজন মন্ত্রী এমপির কতো টাকা আছে? ওয়ান্স ইন এ্য ব্লু মুন মিডিয়াতে দু'একটা খবর আসে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় বয়ে যায়। আর চোখের আড়ালে থেকে যায় এমন আরো লক্ষ লক্ষ কাহিনী।
আমার প্রয়াত নানী প্রায়শঃই বলতেন, ঘর নাই, দুয়ার দিয়া শুইছে। কথাটা বলতেন, কেউ আলগা ফুটানী করলে কিংবা সাধ্যের সাথে সামন্জস্যহীন হাস্যকর কিছু করলে। রাজধানী ঢাকাকে আস্তাকুড় বানিয়ে রেখে ঢাকার বাইরে দু'একটা বিরাট কাঠামো গড়ে উন্নয়নের ঢেকুর তুললে এ‘কথাটাই একমাত্র মনে আসে। আমাদের বড় বড় কথা বলা মন্ত্রীরা কবে আসল কাজ করে তাদের দাবীর যথার্থতা প্রমান করবেন! কবে শক্তপোক্ত ঘর তৈরী করে তবেই দুয়ারের চিন্তা করবেন?
আমাদের কর্ণধারদের কর্ণে দেশমাতার আর্তনাদ কি কোনদিন প্রবেশ করবে?
''যথেষ্ট হইছে, এইবার তোরা থাম'' শীর্ষক ফটোগ্রাফটা গুগল থেকে নেয়া।।