পূর্বকথা: এই লেখাটার মূল লেখক ব্লগার সাহিনুর। আমি শুধু নিজের মতো করে আবার লিখেছি। কেন? এই লেখাটা, চিন্তাধারা মন্তব্যসহ পড়লেই বুঝতে পারবেন। এটা লিখতে গিয়ে একটা ব্যাপার বেশ বুঝতে পারলাম। যে কোনও কিছু নিজের মতো করে লেখা অনেক সহজ কাজ, অন্যের লেখার আলোকে আবার লেখা কঠিন। এই কঠিন কাজটা কতটুকু করতে পেরেছি, জানিনা। সাহিনুর এর থেকে কতটুকু উপকৃত হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা তাও জানি না। আমি শুধু আমার কথা রেখেছি।
আমার চাওয়া খুব সামান্য। সাহিনুরের লেখার সুবাস যেন ছড়িয়ে পরে চারদিকে…..ব্লগে এবং ব্লগের বাইরেও। যদি তেমনটা হয়, তাহলেই আমি খুশী। আর তার পেছনে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস যদি সামান্যতম ভূমিকাও রাখে…..তাহলে আরো খুশী।
উচু নিচু ঢেউ খেলানো মাটির বুকে দুঃসাহসিক প্রহরীর মতো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে দাড়িয়ে আছে কতকগুলো গাছ। আর এই মাটির বুক চিরেই বয়ে চলেছে চিন্তাধারা নামের কাকচক্ষু জলের ছোট্ট এক নদী। এই নদীর নাকি মানব-সমস্যা সমাধানের অলৌকিক গুন আছে। তাই মনের দুঃখে কঙ্কাবতী অঝোরে চোখের জল ফেলছে নদীর ধারে বসে। সাক্ষী শুধু চিন্তাধারা আর এই প্রহরী গাছ গুলো। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে এলো। সূর্য পূর্ব থেকে গুটিগুটি পায়ে পাড়ি জমাচ্ছে পশ্চিমে। তবুও কান্না থামাতে পারছে না কঙ্কাবতী। এমনি এক সময়ে হঠাৎ চিন্তাধারা থেকে ধীরে ধীরে উঠে এলো এক দেবী। তার রূপের মায়াবী ছটায় চারিদিকে এক মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করলো। আশেপাশের সমগ্র পরিবেশ যেন থমকে গেল তার চোখধাধানো রূপের সম্ভারে। কঙ্কাবতীর সামনে এসে দাড়ালো দেবী।
কঙ্কাবতী…...কঙ্কাবতী! তোমার কষ্ট, তোমার কান্না আমি আর সহ্য করতে পারছি না। চোখ মেলে দেখ, আমি তোমার কষ্ট নিতে এসেছি। দেবে না তোমার কষ্ট গুলো আমায়!
কঙ্কাবতী একবার চোখ তুলে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল। এমন চোখ ঝলসানো রুপ সে সহ্য করতে পারলো না। বললো, এতো রূপ তোমার! এতো সুন্দর তুমি! আমি সহ্য করতে পারছি না তোমাকে। কে তুমি? আমার কষ্টই বা কেন নিতে চাও?
আমি জলের দেবী। চিন্তাধারার গহীন জলে আমার বাস। তোমার এই বিরতিহীন করুণ কান্না আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি তোমার সকল কষ্ট দুর করতে চাই।
ঈশ্বর কেন আমার সাথে এমন করলো? আমাকে কুৎসিত বানিয়ে কেন সবার মাঝে পাঠালো? আমাকে কেউ ভালোবাসে না। আমাকে কেউ পছন্দ করে না। আমার সাথে কেউ মিশেনা। সবাই আমার থেকে দুরে থাকে। নিখিল…..যাকে আমি জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসতাম সেও আজ অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করছে। কিন্তু ও যে আমাকে ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিল! বলেছিল আমার চেহারায় ওর কিছু যায় আসে না, তবে কেন আমার সাথে প্রতারণা করে আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেল! না না আমি কিছুই চাই না, তুমি যাও…….তুমি যাও! আর্তনাদ করে উঠলো কঙ্কাবতী।
দেবী গেল না, ব্যথাভরা মায়াবী চোখে তাকিয়ে রইলো। কঙ্কাবতী দেখলো, সেই চোখদুটি থেকে যেন করুণা ঝরে পরছে।
কাদতে কাদতে কঙ্কাবতী বললো, দেবী….তুমি জানো, মা আমার দুঃখে রোজ কাদে। মাঝে মাঝে অভিমানে আমাকে যেদিকে দু‘চোখ যায় চলে যেতে বলে! আমি আর সহ্য করতে পারি না এই যন্ত্রনা।
কঙ্কাবতী, কান্না থামাও। তোমার কান্না সহ্য করতে পারছি না বলেই উঠে এসেছি আমি; তোমার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য।
কি হবে কান্না থামিয়ে? আমার জীবনটাই তো একটা কান্না! আমি আর ফিরতে চাইনা ওই সমাজে যেখানে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। যেখানে প্রতিটা দিন আমার কাটে মানসিক যন্ত্রনায়, অন্যদের ঘৃণায় আর একাকিত্বে। আচ্ছা! তুমি কি আমাকে নিয়ে যাবে, তুমি যেখানে থাকো সেখানে? না থাক, তোমার অনেক রূপ। ওদের মতোই, তুমিও আমার কষ্ট বুঝবে না।
তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, কঙ্কাবতী! তবে তোমার সমস্যা আমি দুর করে দেব। এখন থেকে সবাই তোমাকে শুধুই ভালোবাসবে।
সত্যি দেবী! সত্যি!! সবাই আমাকে ভালোবাসবে? কিন্তু তা কি করে হয়? কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে বললো কঙ্কাবতী।
আমার উপর ভরসা রাখো তুমি। আর এবার তোমার চোখ দুটো বন্ধ করো। একটা কথা শুধু মনে রেখো, কখনো তুমি তোমার অতীত কে ভুলে যেও না, অহংকারী হয়ো না। সেটা কিন্তু অনেক বেদনাদায়ক হবে তোমার জন্যে।
দেবীর কথা শুনে চোখের জল মুছতে মুছতে কঙ্কাবতী চোখ বন্ধ করলো। দেবী ওর মাথায় হাত রাখলো ধীরে ধীরে, আর কঙ্কাবতী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মৃতদেহের মতো যেন তার শরীরে আর কোনো শক্তি নেই; দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
পরদিন সকাল…..….. এক মিষ্টি সুবাসে মুখরিত চারিপাশ, কত রংবেরংয়ের পাখি চারিপাশে ভিড় করেছে। তাদের কিচিরমিচিরেই ঘুম ভাঙ্গে কঙ্কাবতীর। এইসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। চারিদিকে যেন কেউ এক মায়াবী আলো ছড়িয়ে রেখেছে। এতো পাখি কেন ভিড় করেছে তার চারিপাশে? কেন প্রজাপতি তার গায়ে এসে বসছে? আগের দিনের কথা মনে পড়তেই আবার গুমরে কেদে উঠলো কঙ্কাবতী।
তুমি কোথায় দেবী? কোথায় তুমি?? বলেছিলে যে আমার কষ্ট গুলোকে তুমি নিয়ে যাবে, আমাকে সুখ দেবে! এখন কোথায় গেলে তুমি? চিৎকার করে কাদতে কাদতে কঙ্কাবতী আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। না, তার কষ্ট কেউই বুঝবে না। তার কষ্টগুলো একান্তই শুধু তার নিজের। তাই নিখিলের মতো, দেবীর মতো সবাই পাশে থাকার কথা বলে মিথ্যা সান্তনা দেয় আর শেষ পর্যন্ত কেউ থাকে না। এই পৃথিবীর সবাই নিষ্ঠুর!
কাদতে কাদতেই উঠে দাড়ালো ও। এতোদিনে বুঝতে পেরেছে, এই স্বার্থপর মানুষদের মাঝে যতদিন সে থাকবে, ততদিন কোন শান্তি পাবে না; কোনদিনই সে সুখ পাবে না। তাই ঠিক করলো আজই সবার মাঝ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলবে। মনস্থির করে ছুটে গেল নদীর দিকে....।
পরিস্কার স্বচ্ছ টলটলে জলে নেমে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে কঙ্কাবতী। আজই এই কঠিন পৃথিবীতে তার শেষ দিন! শেষবারের মতো চারপাশে একবার দেখে নিল। জলের গভীরে ঝাপ দিতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে অকস্মাৎ স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে থমকে গেল কঙ্কাবতী। এ কাকে দেখছে ও? অত্যন্ত রুপবতী এক মেয়েকে দেখছে পানিতে! এটা কি ওর চেহারা? খুশীতে আত্মহারা হয়েই হঠাৎ একটা কথা চিন্তা করে থমকে গেল। চিৎকার করে বললো, হে জলের দেবী! হে আমার ভাগ্য বিধাতা!! তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা খুজে পাচ্ছি না আমি। কিন্তু একটা চিন্তা হচ্ছে আমার। সবাই কি আমাকে দেখে চিনতে পারবে? নতুন চেহারা নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই না আমি। আমার প্রিয় মা আমাকে যদি চিনতে না পারে? তাছাড়া এলাকার লোকজনেরও তো জানা দরকার, এই সেই কঙ্কাবতী, যাকে এতদিন আমরা অবহেলা করেছি, কষ্ট দিয়েছি; সে ফিরে এসেছে নতুন রুপে!!
নদীর গহীন থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, বাড়ী ফিরে যাও কঙ্কাবতী! তোমার আসল চেহারা ঠিক রেখেই তোমাকে নতুনভাবে সাজিয়েছি। সবাই তোমাকে ঠিকই চিনতে পারবে। আর আমার আগের বলা কথাগুলো সবসময় স্মরণ রাখবে!!!
দু'বছর পরের কথা। নতুন চেহারায় কঙ্কাবতীর জগৎ বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। সমাজে তার কদরই আলাদা। ও একটু হেসে কথা বললেই মানুষ এখন কৃতার্থ হয়ে যায়। রুপের সাথে সাথে যশ-খ্যাতি তার পায়ে লুটোপুটি খায়। খ্যাতি মানুষকে বদলে দেয় বেশীরভাগ সময়েই। পুরোনো কোন কথাই তেমন করে আর মনে নেই ওর। শুধু মনে আছে, বাড়ীতে ফেরার পরে সবার কাছ থেকে শুনে নিখিল এসেছিল ওর কাছে। ওকে দেখে বলেছে, চলো কঙ্কাবতী, সব ভুলে আমরা নতুন করে আবার জীবন শুরু করি। তবে কঙ্কাবতী ওকে কোন অপমান করেনি। শুধুই হেসেছে। বলেছে, তা হয় না নিখিল। আমার জীবনে তোমার কোন স্থান নেই এখন!
প্রথমদিকে ভেবেছিল মাকে নিয়ে, সকলের ভালোবাসাকে সাথী করে সমাজের অসুন্দর, দুঃখী মেয়েদের কল্যানের জন্য কাজ করেই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে। কিন্তু মানুষের প্রশংসা আর স্তুতিতে আস্তে আস্তে বদলে গেল ও। ভুলে গেল ওর অতীত। অসুন্দর কাউকে দেখলে অন্যদের মতো সমালোচনা করা শুরু করলো; ওর চারপাশে ঘিরে থাকা স্তাবকদের সাথে এ'সব নিয়ে হাসাহাসি করা অন্যতম বিনোদনে পরিণত হলো ওর।
বেশ কিছুদিন থেকে আরেকটা অভ্যাস হয়েছে কঙ্কাবতীর। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আয়নার সামনে বেশ কিছু সময় বসে থাকে ও। বিভিন্নভাবে নিজেকে দেখে আর ভাবে, আমার মতো সুন্দরী ক‘জন আছে এই পৃথিবীতে! নিজের চেহারার প্রেমে এমনভাবে পরলো যে, আজকাল সবাইকেই ওর কুৎসিত মনে হয়!
একদিন এক কুৎসিত-দর্শন মেয়ে এলো ওর কাছে সাহায্যের জন্য। মেয়েটাকে কটু কথা বলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিল ও। মেয়েটা অসহায়ের মতো কাদতে কাদতে চলে গেল দেখেও ওর বিন্দুমাত্র খারাপ লাগলো না, বরং সবার সাথে হাসাহাসি করলো আর বললো, এমন কুৎসিত চেহারা জীবনেও দেখেনি ও।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি আয়নায় নিজেকে দেখে বিকট এক আর্তচিৎকার দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো কঙ্কাবতী। ওর আগের চেহারা আবার ফিরে এসেছে! নিজের পুরানো চেহারা দেখে চিৎকার দেয়াটাই ছিল ওর জীবনের শেষ চিৎকার।
কঙ্কাবতী জানতেও পারলো না, আগের দিনের সেই অতি কুৎসিত-দর্শন মেয়েটা ছিল চিন্তাধারার সেই জলদেবী!!!
(মূল লেখার এক মন্তব্যে ব্লগার মোঃ মাইদুল সরকার বলেছিলেন, কংসাবতী না হয়ে কঙ্কাবতী হলে পড়তে আরাম হতো। আরামের কথা চিন্তা করেই নামটাও বদলে দিলাম। তাছাড়া, কঙ্কাবতী আমারও একটা পছন্দের নাম

ছবি: গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:১২