গত সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ রবিবার। আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন।
আগেরদিন রাতে মুরগীর মাংস মেরিনেট করে ফ্রীজে রেখে দিয়েছি, আমার দারুন প্রিয় হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী রাধার জন্য। আরও প্ল্যান প্রোগ্রাম আছে, সারাদিনের। রবিবার সকালে নাস্তা করে এককাপ চা বানিয়ে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছি মাত্র। এমন সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠলো। ক্রিস ফোন করেছে।
কলটা রিসিভ করে বললাম, গুড মর্নিং ক্রিস। কিরে, তোর কোন কাজকাম নাই? এতো সকাল সকাল ফোন দিছস কিল্লাই?
ওপাশ থেকে ক্রিসের উত্তেজিত গলা ভেসে এলো, মর্নিং মফিজ। জলদি তৈরী হও। আমরা আজকে সারাদিনের লাই ডে আউটে যামু রে মামু! ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের কিডারমিনিস্টার সাফারী পার্কে!!
আমি বললাম, তুই হাগল নি কোনো? আড়াইঘন্টা ড্রাইভ কইরা ১৩৪ মাইল দুরে যামু! নো চান্স!! আজকে সারাদিনের প্রোগ্রাম আমার ফিক্সড। তুই সাফারীর হাতি দিয়াও আমারে ঘর থিকা বাইর করতে পারবি না।
ক্রিস কাদো কাদো স্বরে বললো, সুজানা যাইতে রাজী হইছে। কিন্তু হ্যাতে একলা যাইবো না, আরেকটা কাপল লাগবো। এহন আমি কাপল কই পাই?
বললাম, জেমস কি করে? হ্যারে কস না ক্যান?
ওপাশ থেকে বললো, তোমার ঘটনা জানি বইলাই আগে ওরে ফোন দিছিলাম। হুমুন্ধির পো সকাল সকাল ওয়েস্ট কোস্টে গিয়া বইসা আছে, সার্ফিং করনের লাই। এহন আমি কি করি? চলোরে বাপ…...তোমার দুইটা পায়ে পরি। সব খরচাপাতি আমিই করবাম নে, আর আমার গাড়ীই নিয়াম নে!!
ঘটনা হলো, মাস তিনেক আগে আমাদের অফিসে সুজানা নামে এক মেয়ে জয়েন করেছে, রোমানিয়ান। মেয়ে তো নয়, যেন আগুনের গোলা! যেমন তার চেহারা….দেহের রং, তেমনি তার দেহের বাক…...আচার-আচরণ। সামনে দিয়ে হেটে গেলে মানুষ নাকি জলপরী বুঝতেই কয়েক মিনিট সময় চলে যায়। কথা বললে মনে হয় কোথাও যেন পিয়ানোর টুং টাং শব্দ হচ্ছে। যেই ওর দিকে তাকায় তারই চোখ ট্যারা হয়ে যায়! এ হেন জলকন্যার সাথে লাইন মারার লোকের কি অভাব আছে! কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই, এমন মেয়ে দেখে নোলা ঝরানো হুলা বিড়ালের অভাব নাই অফিসে।
এদিকে আমাদের ক্রিসও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না। একটু প্লাস্টিক সার্জারী আর হাল্কা মেইক আপ দিলে ওকেও হলিউডি সিনেমার নায়ক বলে চালিয়ে দেয়া যায়। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী একজন মানুষ। এমন একজন মানুষকে ওর বুরবাক জিএফ মাস ছয়েক আগে ডিচ করেছে! সেই দুঃখে বেকুবটা কয়েকদিন বিছানা থেকেই উঠতে পারে নাই। তবে, সেটা এখন অতীত। সুজানার অন্য অনেক প্রণয়প্রার্থীর মতো ওরও বর্তমানে অফিস হলো পার্টটাইম জব। ফুল টাইম জব হলো, সুজানাকে পটানোর তরীকা বের করা। স্বয়নে-স্বপনে-নিদ্রায়-জাগরনে সারাক্ষণ শুধু সুজানার নাম জপে ক্রিস বেচারা। কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হলো, সুজানাকে বেড়ানোর জন্য রাজী করালো কি করে? যাকগে, সেটা আমার ইস্যু না এই মুহুর্তে। ইস্যু হলো; আমার বউ বলছে, রাখো তোমার হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী। তুমি যদি না যাও, তাহলে কিন্তু এখন থেকে শাস্তিস্বরুপ আমি তোমাকে ‘মফিজ‘ বলেই ডাকবো। আর আমি যাবোই ওদের সাথে, তুমি বাসায় বসে থাকো তোমার প্ল্যান নিয়ে। আমি বললাম, তুমি একা গেলে হবে না। সুজানা বলেছে…….., কথা শেষ করার আগেই বউ আমাকে একটা চোখটিপ দিয়ে বললো, জানি জানি, পাশের বাসার মার্টিনকে বললেই আমার সাথে যাবে!
এরপরে আর কোন কথা থাকে না। এতোটা রিস্ক নেয়া আসলেই রিস্কি হয়ে যায় আমার জন্য। অগত্যা উঠতেই হলো। আমাকে রাজী হতে দেখে বউয়ের সাবধানবাণী ধেয়ে এলো, যাচ্ছো ভালো কথা। কিন্তু সুজানার সাথে কোন রকমের ছ্যাবলামী করার চেষ্টা করবা না। তাইলে কিন্তু তোমার খবর আছে!!
কথা অনেক হলো। চলেন, এবার আপনাদেরকে পার্কটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই আর বাসিন্দাদের সাথে যতোটুকু পারি পরিচয় করিয়ে দেই।
ঢুকতেই পথ আটকে দাড়ালো থ্রি স্টুজেস। যেন বলছে, খাওন না দিয়া কই যাও।
বউকে বললাম, খাওয়াও। সে বেচারী সাহস করে উঠতে পারলো না। অগত্যা আমিই ডেমো দিলাম। জিরাফের খাবার খাওয়ার কায়দা কানুন আলাদা। হাত থেকে সরাসরি না খেয়ে পুরো হাতটাই মুখে ঢুকিয়ে নিয়ে তারপরে খায়। তবে, ভয়ের কিছু নাই। ওরা কামড় টামড় দেয় না।
এবার সাহস সন্চয় করে আমার বউও খাওয়ালো, তবে সাবধানে। হাত পুরোটা মুখে ঢুকাতে দেয় নাই।
এন্টেলোপদের সমাবেশ।
আমাদের থামতে দেখে বক্তব্য প্রদানরত নেতা এগিয়ে এলো। বউ ইতোমধ্যে জিরাফকে খাইয়ে যথেষ্ট সাহস সন্চয় করে ফেলেছে। কাজেই মেহমানদারীর দায়িত্ব ও-ই নিলো।
কোথাও শান্তি নাই। এখানেও স্বার্থের দ্বন্ধ!
গন্ডার আমাদেরকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি।
সাদা সিংহ। এরা নাকি বিলুপ্তির ভয়ে আছে।
এদেরকে দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। আমারও বাসায় এভাবে গা এলিয়ে বসে থাকার কথা ছিল।
আবারও বউয়ের মেহমানদারী।
এই পাহাড়ী ছাগলটার ভাবে মনে হলো, আমাকে কিছু বলতে চায়!
দুর থেকে দেখা হস্তী।
এটা কি জানি না। হরিণের কোন প্রজাতি হবে।
এটাকে সবাই চিনেন। আড়ে আড়ে আমাদের দেখছে।
সাদা ক্যাঙ্গারু। এরাও নাকি বিলুপ্তির পথে।
আমাদের প্রিয় বাঘমামা ওরফে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। উনার এক আত্মীয়ের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম একসময়। পড়তে চাইলে এখানে, বাঘমামার ইন্টারভিউ
শিকা হরিণ।
এই লেপার্ডটার একটা স্থির ছবি নেয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশেষ কোন কারনে উনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। এক মুহুর্তের জন্য উনাকে স্থির পাই নাই। অন্তত ২০/২২ টা শট থেকে এটাই সবচেয়ে ভালো পেয়েছি।
ওখানে এ্যকুরিয়ামে অদ্ভুত অদ্ভুত সব মাছ রাখা আছে। তেমনই দু‘টা ছবি।
সাফারী শেষ করে এক রেস্টুরেন্টে ডিনার করলাম। রাগের চোটে কয়েকটা দামী ডিশ অর্ডার করেছিলাম। ক্রিসের শুকনা হাসি দেখে বুঝলাম ওর শরীরে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। মনে মনে ভাবছিল নিশ্চয়ই, কলিজা ঠান্ডা কইরা খায়া ল, হালার পো! আমারও দিন আইবো কোন একদিন! তবে আমি গুরুত্ব দেই নাই। আমার সারাদিন বরবাদ করার শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে…...তাই না!!!
প্রথম ছবিটা নেট থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:৪৭