আবরার ফাহাদকে খুন করা হলো অক্টোবরের ৬ তারিখ রবিবারে।
এরপর থেকে আমার প্রধান কাজ হয়ে দাড়ায় এ'সম্পর্কিত খবর পড়া, দেখা এবং শোনা। অনলাইনে বিভিন্ন পত্রিকা, ইউটিউব, টিভি; এর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। শুধু দেখি, পড়ি আর শুনি। কিছুই ভালো লাগে না। যেখানে প্রতিদিন সামু'তে অন্তত একবার না আসলে আমার ঘুম হয় না, সেখানে সামু'তে আসার কথাই যেন ভুলে গেলাম। এদিকে আমার ঘুম এমনিতেই হারাম হয়ে গেল। বিছানায় শুই, চোখ বন্ধ করি। আর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে উনিশ/বিশজন তরুণ আরেক তরুনকে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে উন্মত্তের মতো মারছে। যেন মানুষ না, কোন পশুকে মারছে। আচ্ছা, একটা পশুকেও কি এভাবে মারা যায়? বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। ঘুম আর আসে না। তারপর উঠে গিয়ে সিগারেট ধরাই। ল্যাপটপ চালু করি আর কানে হেডফোন গুজি, যেন বাসার অন্যদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে সকালে গোসল করে যথারীতি অফিসে যাই।
চারদিনেই চোখের নীচে কালি পরে গেল। চেহারা হয়ে গেল ভুতের মতো। এটা অবশ্য আমার কথা না, আমার কলীগ ক্রিসের কথা। ক্রিসের কথা হয়তো আপনাদের কারো কারো মনে আছে, একটা পোষ্টে ওকে নিয়ে খানিকটা লিখেছিলাম। আমার সাথে মিশতে মিশতে ও নিজেও বাংলাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, যখনই কোন নেতিবাচক খবর পড়ে। এ'কটা দিন অফিসে সুযোগ পেলেই আমার ডেস্কের সামনে এসে বসেছে। খানিক পর পর ফোস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছে, এটা কোন কথা! এতগুলো মেধাবী তরুন আরেকটা মেধাবী তরুনকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেললো! আমি কোন কথা বলি না। একবার ওর দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকাই, তারপর আমার এই শুন্য দৃষ্টি মেলে দেই কাচের বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে, দিগন্তের দিকে। আমার বাধাহীন দৃষ্টি বহুদুর পর্যন্ত দেখতে থাকে, কিংবা কিছুই দেখে না!
আমার সামনে বসে, কিংবা বাইরে সিগারেট খেতে গিয়ে ও বিভিন্ন জোকস বলে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করেছে। আমার প্রতিক্রিয়া কিংবা মতিগতি বোঝার চেষ্টা করেছে। আমি হাসতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নাই। ছবিতে দেখা আবরারের এক খুনীর হাসি মনের পর্দায় প্রতিনিয়ত ভেসে উঠেছে। মনে হয়েছে আমার হাসিটাও কি ওই খুনীটার হাসির মতো দেখাবে? ক্রিস সান্তনা দিয়ে বলে, মফিজ, ভুলে যাও ওসব। ইটস এ পার্ট অফ লাইফ। আমি বলি, ইটস রিয়েলি নট, ক্রিস! এটা আমাদের লাইফের পার্ট বানানো হয়েছে…..জোর করে।
আমাকে নিয়ে ক্রিসের দুশ্চিন্তার মাত্রাটা বুঝতে পারলাম বৃহসপতিবার সকালে অফিসে গিয়ে। কফি নিয়ে মাত্র বসেছি, ফোনটা বেজে উঠলো। সেকশান চীফের ফোন। বললো, মফিজ, আমার রুমে চলে এসো। সকালের কফিটা একসাথে খাই। এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
বসের সামনে বসতেই বললো,
- ও, তুমি দেখছি কফি নিয়েই এসেছো। আমি আরো তোমার জন্যেও বানিয়ে নিয়ে এলাম।
- অসুবিধা নাই। আমারটাও খাবো, তোমারটাও খাবো। আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম।
- ওকে, শোন। কথা সরাসরিই বলি। ক্রিস আমাকে তোমার দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলেছে। তোমার অবস্থাও বলেছে। তোমার মতো একজন হাসিখুশি, প্রানবন্ত মানুষের এই অবস্থা কেন? তোমার বউ তোমার এই চেহারা দেখে কিছু বলে না!
বলার মতো কিছু খুজে না পেয়ে কফি খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম।
- মফিজ….আমার কথা শোন। আমি বুঝতে পারছি, তুমি খুবই স্ট্রেসড। অবহেলা কোরো না, এটাকে মনের ভিতরে পুষে রাখলে আরো বড় সমস্যায় পরতে পারো। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের সাথে কথা বলো। তেমন কিছুই না, জাস্ট কিছুক্ষণ কথা বলা। এখন বাসায় চলে যাও। আজ আর কাল ছুটি নাও। তারপর শণি রবি উইকএন্ড। আশা করছি, সোমবার থেকে তোমাকে আবার আগের মতো করে পাবো।
বাসায় এসে বসে বসে ভাবছি আমার এই হঠাৎ পরিবর্তনের ব্যাপারে। এর চেয়েও অনেক বড় বড় দুঃখের ঘটনা আমাকে একদিনের বেশী কাবু করতে পারে নাই কখনও। আমি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! প্রতিরোধ শক্তি কমে যাচ্ছে? এর মধ্যে বউ এসে জানালো, আগামী শণিবার বিকাল চারটার সময়ে আমার এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করেছে ও। এক সাইকিয়াট্রিষ্ট এর সাথে। সাইকিয়াট্রিষ্ট? হাসবো নাকি কাদবো বুঝতে পারলাম না এই একেবারেই অপ্রত্যাশিত খবরে। রাগ করতে গিয়েও করলাম না। আসলে ওকে দোষও দেয়া যায় না। গত কয়েকটা দিন নির্ঘুম থাকার ফলে মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি বেশ কয়েকবার। খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতো করি নাই; বলতে গেলে সিগারেটের উপরেই ছিলাম। হাসি-ঠাট্টা যেখানে আমার স্বভাবগত ব্যাপার, সেখানে ওর সাথে কথাও বলি নাই ভালোভাবে। ভাবলাম, জীবনে কত অভিজ্ঞতাই তো হলো, এটা কখনও হয়নি। তাছাড়া সাইকিয়াট্রিষ্টদের কাজ-কারবার নিয়ে এত লেখা পড়েছি, এপয়েন্টমেন্ট যখন করেই ফেলেছে…...দেখেই আসি নাহয় জিনিসটা কি!!
তো, যথাসময়ে গেলাম। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে হতাশ হলাম, কল্পনার সাথে না মিলাতে পেরে। ক্লিনশেভড, পরিপাটি করে চুল আচড়ানো চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের এক নিপাট ভদ্রলোক। রুমের চেহারাও ভদ্রলোকের মতোই…..অতিরিক্ত পরিপাটি! আমাকে ঢুকতে দেখে একটা বিশাল হাসি দিয়ে বললো, আমার ভুবনে স্বাগতম, মফিজ! এসো, আরাম করে বসো। তোমার সব কথাই তোমার বউ আমাকে বলেছে। তারপরও তোমার মুখে আরেকবার শুনবো। আমাদের সময় একঘন্টা। এই সময়টাতে তুমি বক্তা, আর আমি হলাম গিয়ে শ্রোতা।
আলাপের শুরুতেই আমি ঘোষণার সুরে বললাম, দেখো, তুমি কি ভেবেছো জানিনা। তবে আমার অবস্থা তেমন সিরিয়াস কিছু না। দু‘দিন পরে এমনিতেই আমি স্বাভাবিক হয়ে যাবো। নেহায়েত আমার বউ এপয়েন্টমেন্টটা করেছে, আর হাতে কোন জরুরী কাজও নাই। তাই ভাবলাম, তোমার এখানেই নাহয় একটু টাইম পাস করি। ইন ফ্যাক্ট, তোমাকে দেখে এরই মধ্যে আমি ভালো বোধ করা শুরু করেছি! শুনে ভদ্রলোক হো হো করে ঘর কাপিয়ে হেসে উঠলো। দেখে আমিও সত্যি সত্যিই ভালো বোধ করা শুরু করলাম।
ডাক্তার সাহেব সত্যিই মজার লোক। গল্পে গল্পে এক ঘন্টা কিভাবে কেটে গেল টেরই পেলাম না। আসার সময় বললো, তুমি চাইলে আমি কিছু এন্টি-স্ট্রেস মেডিসিন দিতে পারি, তবে আমার মনে হয় তার আর দরকার নাই। তবে, তোমাকে একটা এডভাইস দিব। বাসায় গিয়ে তোমার ব্লগের জন্য কিছু একটা লিখে পোষ্ট করো। ব্লগে সময় দাও, বউকেও সময় দাও। চাইলে কোথাও থেকে ঘুরেও আসতে পারো। অল দ্য বেস্ট।
----------
ফিরে আসি আবার আবরার প্রসঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ছাত্র-রাজনীতি বন্ধ হবে না, তবে বুয়েট চাইলে বন্ধ করতে পারে। বুয়েটের মতো আরও হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশে আছে। সেখানে ছাত্রলীগও আছে। দুঃখ হলো, প্রধানমন্ত্রী বুঝতে সক্ষম হলেন না, সন্ত্রাসী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। সিস্টেমই মানুষকে সন্ত্রাসী বানায়। বুয়েটে ঢোকার আগে এই খুনীগুলো ছিল শুধুই মেধাবী। বুয়েটে ঢুকে হয়েছে মেধাবী সন্ত্রাসী। আবরার যদি আজ বেচে থাকতো, তাহলে এই সন্ত্রাসীগুলো একদিন বুয়েট থেকে পাশ করে বড় বড় পদে চলে যেত তাদের মেধা দিয়ে। জাতীকে তারা কি উপহার দিত? একজন সাধারন সন্ত্রাসী থেকে একজন মেধাবী সন্ত্রাসী অনেক বেশী ভয়ংকর…..সেইসঙ্গে ক্ষতিকরও বটে। এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসী দেশে হাজার হাজার আছে। তাহলে জাতীর ভবিষ্যত কি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটাই আমার প্রশ্ন।
'বড়ভাই' নামক কতিপয় বাশীওয়ালার ঐন্দ্রজালিক সুরে মোহাবিষ্ট হয়ে আছে আমাদের দেশের ভবিষ্যতেরা। এই সুরের মায়াজাল থেকে তাদেরকে বের করার কোন পথই আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি দুঃখিত, ব্যথিত, হতাশ। আমার এই দুঃখ-বেদনা-হতাশা দেখার মতো কেউ আজ কোথাও নেই!
শেষকথা: ডাক্তার বলেছিল, বাসায় এসে ''কিছু একটা'' লিখে ব্লগে পোষ্ট করতে। অনেকক্ষণ ল্যাপটপের সামনে বসে রইলাম। মাথা খালি, কোন রকমের ''কিছু একটা''ই মাথায় আসলো না। শেষমেষ ভাবলাম, আমার এ'কদিনের দিনপন্জিই লিখে দেই। সো, হিয়ার ইট ইজ!
সবশেষে একটা পাজল দেই। লেট মি টেইক ইউ টু এ স্লাইটলি ডিফরেন্ট ডাইরেকশান। এই ভিডিওটা দেখেন….আর একটু ভাবেন। কে বলছে, তা না ভেবে কি বলছে শুনেন আর দেখেন কতোটুকু রিলেইট করতে পারেন আপনার নিজস্ব ভাবনাগুলোকে। https://www.youtube.com/watch?v=R2Y3R7ccl20
ছবিটা নিয়েছি গুগল থেকে।
আর পোষ্টের শিরোণামটা নিয়েছি, আমার অতিপ্রিয় হুমায়ুন ভাইয়ের একটা বইয়ের নাম থেকে। অনুমতি ছাড়াই নিলাম। আজ উনি বেচে থাকলে একটা ফোন করে অনুমতি নিয়ে নেয়া যেত। আপনাকে প্রতিনিয়ত মিস করি.....হুমায়ুন ভাই!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৮:৫২