আমাদের বাসায় অনেক বছর আগে আমার এক ফুপাতো ভাই থাকতেন, জামাল ছিল উনার নাম। আর্থিক অবস্থা বেশী ভালো না হওয়ায় আব্বা উনাকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্যে। অত্যন্ত সাদাসিদা, বোকা কিসিমের মানুষ।
একদিন দেখি খাটে বসে ঘুটা দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছেন। হাতে কানায় কানায় ভর্তি একটা গ্লাস। আমি বললাম, জামাল ভাই, কি করেন? এইভাবে মাথা নাড়ছেন কেন?
উনি লজ্জা লজ্জা হাসি দিয়ে বললেন, একটু চিনির শরবত খেতে মন চাইলো। চিনি গুলাচ্ছি!
আমি বললাম, তো পানি না নাড়াবেন; মাথা নাড়লে কি চিনি গলবে?
উনি এক ঢোক খেয়ে বললেন, গলেছে; পানি তো দেখি মিষ্টি মিষ্টি লাগে!
আরেকদিনের ঘটনা। বাইরে থেকে এসে দেখি উনি ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বসার ঘরে বসে আছেন। আমাকে বললেন, গেটে কোন রিক্সাওয়ালাকে দেখলা? ঘটনা হলো, উনি বাজার থেকে রিক্সায় এসেছেন। দশ টাকা ভাড়া, উনার কাছে ছিল একশত টাকার নোট। এদিকে রিক্সাওয়ালার কাছে এতবড় নোটের ভাংতি নাই। উনি রিক্সাওয়ালাকে বললেন, ভাই, বাইরে গরমে টেকা যাচ্ছে না। আমি ভিতরে গিয়ে বসি। তুমি টাকা ভাংতি করে তোমার টাকা রেখে আমার টাকা দিয়ে যাও।
বলাই বাহুল্য, ওই রিক্সাওয়ালাকে আর কোনদিন এলাকায় দেখা যায়নি। তখন ছোট ছিলাম। স্কুলে পড়তাম। উনার কাজকারবারের কারনে উনি সেসময়ে ছিলেন আমার আনন্দের অন্যতম উৎস। উনি ছিলেন বোকা মানুষ, তবে এখন দেশে গেলে চালাক মানুষদের কাজ-কারবার দেখেও বিমলানন্দ উপভোগ করি। দু'টা ঘটনা বলি।
বছর দু'য়েক আগে দেশে গিয়েছি। দেশে রাস্তার ধারের টং দোকানের চা খাওয়া আমার বহু পুরানো অভ্যাস। বাসার কাছাকাছি একটা ট্রাফিক সিগন্যালের মোড় আছে। একদিন দুপুরবেলা বসে বসে চা খাচ্ছি, খেয়াল করে দেখলাম; সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বললে ট্রাফিক পুলিশ সাহেব সবকিছু থামিয়ে দিচ্ছে, আর লাল বাতি জ্বললে ছেড়ে দিচ্ছে। একটু পর উনি দোকানে এলেন পানি খেতে। আমি বললাম, ভাই, আপনি যদি হাত দিয়েই কাজ করবেন, তাহলে বাতি জ্বালানোর দরকার কি? ওটা বন্ধ রাখেন না কেন? কিছু ইলেক্ট্রিসিটি তো অন্ততঃ বাচবে! উনি ইশারায় একদিকে দেখিয়ে বললেন, যান, স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
দেখলাম মোড়ে মোটর সাইকেলের পাশে দু'পা ফাক করে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট দাড়িয়ে আছে। ক্যালিফোর্ণিয়া হাইওয়ে পেট্রলের স্মার্ট অফিসারের মতো টাইট আউটফিট! কোমরে পিস্তল। একহাতে ওয়াকিটকি, আরেকহাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সানগ্লাসটা চোখের উপরে তোলা। দেখে মনের মধ্যে ডলি সায়ন্তনীর পুরানো একটা গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠলো….হে যুবক!! ভাবলাম, এই আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবে। প্রশ্ন শুনে সার্জেন্ট নিতান্ত অবহেলায় আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলল, এই দুপুরবেলা এইখানে কি করেন, কোন কাজ-কাম নাই? গ্রাম থিকা নতুন আসছেন?
আমি বললাম, না দেশের বাইরে থাকি। কয়েকদিনের জন্য বেড়াইতে আসছি।
আমার আসল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবার প্রশ্ন, কই থাকেন, দুবাই?
না সৌদি থাকি। আমি জানালাম।
বললো, এই জন্যই জানেন না। কাজ-কাম না থাকলে ঘরে যান। আমার কামে ডিস্টার্ব কইরেন না।
ইংল্যান্ডে পুলিশের সাথে কথা বললে তাদের আচরণে বোঝা যায় যে তারা জনগনের কর্মচারী। এর সাথে কথা বলে মনে হলো, আমিই এর কর্মচারী। বুঝলাম, উত্তর পাওয়ার আশা এখানে এক কষ্ট-কল্পনা। মনে মনে বললাম, সানগ্লাস কপালে তুইলা চেগায়া দাড়ায়া আছো। তুমি কাম কি করতাছো, তাইতো বুঝলাম না। বিনোদন!! সিগন্যাল বাত্তি, ট্রাফিক কন্ট্রোল, চেগায়া দাড়ানো…..সবই দেখি বিনোদন!!
সে বারেই শোনা আরেকটা ঘটনা বলি। ঢাকায় আমাদের বাসার সামনের রাস্তার দু‘পাশ ছিল খোলা, ঢালু। বৃষ্টির পানি বেশিক্ষণ আটকা থাকতো না। বছর পাচেক আগে ফুটপাথ ঠিক করার সময় সেগুলো ঢেকে দেয়া হলো। এলাকার মুরুব্বীরা তখন আপত্তি জানিয়ে কন্ট্রাক্টরকে বলেছিলেন, বাবা, তুমি এমনেই বিল করে দাও। এটা ঢেকো না। কে শোনে কার কথা। যা হোক, পরবর্তী দু'বছর সেই ঢেকে দেয়া ড্রেন ব্লক হয়ে একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা ভেসে যেতো। তৃতীয় বছরে এসে এলাকাবাসীর অভিযোগের মুখে আবার সেটা ভেঙ্গে আগের মতো করে দেয়া হয়েছে।
এটা যেন সেই পুকুর ভরাট করে আবার কেটে পুরানো অবস্থায় নিয়ে আসার মতো। তফাত শুধু, পুকুরে হাতই দেয়া হয়নি, আর এক্ষেত্রে দু‘বার কাজ করে জনগনের পকেট হাল্কা করা হয়েছে। পুরো ঘটনাটা শুনে খুবই বিনোদিত হয়েছিলাম। দেশে বিনোদনের বড়ই অভাব, এগুলোই এখন ভরসা। বালিশ বিনোদন, পর্দা বিনোদনের পর এখন চলছে ক্যাসিনো বিনোদন!
আজ পত্রিকায় পড়লাম, আগামীতে হজযাত্রীদেরকে জামাই আদরে হজ করাতে চান ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। প্রতিবছরই আশ্বাসের বন্যা বয়ে যায়, তারপরে যেই লাউ, সেই কদু। তবে প্রতিমন্ত্রীর এবারের আশ্বাসে অভিনবত্ব আছে নিঃসন্দেহে; যদিও এতে জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশান সুস্পষ্ট! উনি শুধু পুরুষ হজযাত্রীদের কথা বলেছেন। মহিলা হজযাত্রীদের আদরের ধরন সম্পর্কেও একটু আলোকপাত করা উচিত ছিল, নয় কি? আপনারা কি বলেন?
অরেকটা খবর। অভিজ্ঞতা না থাকায় মেগা প্রকল্পে অর্থের 'মিস ইউজ', বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা এখানে পদ্মা সেতু করব, কর্ণফুলী টানেল করব বা আমরা এমআরটি (মেট্রোরেল) প্রজেক্ট করব-এগুলো তো স্বপ্ন। এগুলো বাস্তবায়নে কারও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। সুতরাং এখানে ডিসটরশন (নড়চড়) হবে এবং মিস ইউজও (অপব্যবহার) হবে, এটাকে ধরে নিতে হবে। এটা ইন্দোনেশিয়ায় হয়েছে, মালয়েশিয়ায় হয়েছে, অন্যান্য দেশেও হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন। আগেই উনি খোলাসা করে দিয়েছেন যে, টাকা-পয়সার নয়ছয় হবে এবং এটাকে মেনেও নিতে হবে। কাজেই এ'ব্যাপারে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। সত্যিই তো। উনি তো রাতের আধারে কিছু করছেন না। দিনে-দুপুরে মিডিয়ার সামনেই বলেছেন। এরপরে তো আর কোন কথা থাকতে পারে না!
সদ্য দেশ থেকে ফেরত আসা বন্ধু জানালো, দেশে বিনোদনের নাকি খুবই অভাব, তাই লোকজন বাইরের খাবার বেশী বেশী খায়। এটাই এখন বিনোদন। রাত ৯টার পর নাকি দোকানগুলোতে খাবার-দাবার ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তবে আমি এটা মানতে পারি নাই। সারা বিশ্বেই এখন দিন দিন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানদের চাহিদা বাড়ছে। দেশে আমাদের মাননীয় মন্ত্রীদের মুখ নিঃসৃত বানীগুলোই তো অনেক বড় বিনোদন। খুব বেশী হলে, উনারা 'স্ট্যান্ডআপ' নাকি 'সিটডাউন' কমেডিয়ান এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কারন, কমেডিগুলো উনারা তো বেশীরভাগ সময় বসে বসেই করেন!!!
এখন বলেন, পরিবেশটা সুন্দর না! আমি কি কাহারো মনে আঘাত দিয়েছি!! ভুল কিছু বলেছি!!! এরপরে আপনারা বলবেন, ভুয়া মফিজ ভালা না….......তাইলে আপনেরা ভালা লইয়াই থাইকেন!!!!

ছবি ও তথ্য: ইন্টারনেট!!