'বারোভাজা' চিনেনা এমন বাঙ্গালি সম্ভবতঃ খুব বেশী নাই। বারোভাজায় প্রকৃতপক্ষেই বারোটা ভাজা থাকে কিনা, আমি কোনদিন গুনে দেখিনি। 'সরল বিশ্বাস'-এই মেনে নিয়েছি। তবে এতে বারোটা ভাজাই থাকবে নিঃসন্দেহে, না হলে একে বারোভাজা বলার কোন যৌক্তিকতা নাই। তো, এই বারোটা ভাজা এবং তার সাথে পেয়াজ, কাচামরিচ, ধনিয়াপাতা, লেবুর রস, সেদ্ধ ছোলা, ক্ষেত্রবিশেষে টমেটু এবং বিভিন্ন মশলার সংমিশ্রণে যে বস্তুটা তৈরী করা হয়, তা আসলেই খুবই মুখরোচক; অন্ততঃ আমার কাছে।
বারোভাজায় যে বারোটা মূল উপাদান থাকে, যেগুলো হিসাব অনুযায়ী ভাজাই হবে; সেদ্ধ বা কাচা হওয়ার কোন উপায় নাই। আর এই বারোটা ভাজাভুজি উপাদানের যে মিশ্রণ, তার স্বাদের পূর্ণতা দেয়ার জন্য থাকে কিছু সাইড উপাদান, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা আগে বলেছি, এই সাইড উপাদানগুলো কিন্তু ভাজা হতে পারবে না। কাচা বা সেদ্ধ হতে হবে। তবে আপনি এই সাইড উপাদানগুলো বাদ দিয়ে যদি শুধু বারোটা ভাজা খান, আপনার কাছে ভালো লাগবে না…..অন্তত আমার কাছে কোন পদের মনে হয় নাই।
ঢাকায় গেলে খুব আগ্রহ নিয়ে যে খাবারগুলো আমি খাই, এটা তার অন্যতম। তো গতবার ঢাকায় গিয়ে এই বারোভাজা খেতে খেতে আমার মনের আকাশে একটা তত্ত্বের ভাবনা উদিত হয়। সেটা মূলতঃ আপনাদের সাথে শেয়ার করার জন্যই আজ আমার এই পোষ্টের অবতারনা। এটাকে দেশের প্রকৃত উন্নয়নে একটা 'বারোভাজা তত্ত্ব' কিংবা ফর্মূলাও বলতে পারেন। কি সেই তত্ত্ব? আসুন তাহলে, এক এক করে বারোটা ভাজা…..থুক্কু, আমার ফর্মূলার বারোটা উপাদান দেখি যার সম্মিলিত ক্রিয়া-কলাপের মধ্যেই দেশের প্রকৃত উন্নতি নিহিত।
১। জনগনকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা মানে প্রকৃত শিক্ষা, অন্য কোন অপশান নাই। আপনি সই করতে পারেন দেখেই শিক্ষিত...এসব হাবিজাবি চিন্তা ভুলেও মাথায় আনবেন না। তবে হ্যা, আপনি যদি কোনভাবে প্রভূত সম্পত্তির মালিক হতে পারেন, তাহলে আপনার জন্যে বিশেষ কনসেশানের ব্যবস্থা থাকবে আমার এই তত্ত্বে।
২। প্রত্যেকে যার যার দায়িত্ব সততার সাথে পালন করবেন। আমি দূর্ণীতি করি না, কিন্তু কাজ-কামও ঠিক মতো করি না। অফিসে বসে ব্যক্তিগত কাজ করি (যেমন, এই মূহুর্তে অফিসে বসে এটা টাইপ করছি), আর মাস শেষে কোনরকমের বিবেকের দংশন ছাড়াই বেতন নেই…..তাদের সোজা হয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নাই।
৩। দূর্ণীতি, খুবই ভাইটাল একটা ব্যাপার। এটা একেবারে দূর করা যাবে না। যারা এটাকে একেবারে দূর করার কথা বলেন, তারাই এর প্র্যাকটিস সবচাইতে বেশী করেন বলে আমার ধারণা। 'চোরের মার বড় গলা' প্রবাদবাক্যটার আবির্ভাব সম্ভবত এদের জন্যেই হয়েছে। তবে এর নিয়ন্ত্রণটা আরো বেশী ভাইটাল। এ'ব্যাপারে আর বেশী কিছু বলতে চাই না।
৪। যে কোন কাজে স্বচ্ছতা অবশ্যই থাকতে হবে, একেবারে কাচের মতো। টেবিলের তলে একেবারেই যাওয়া যাবে না। সবাই যেন আপনাকে এবং আপনার কাজকে পরিস্কার দেখতে পায়, সেভাবে কাজ করতে হবে।
৫। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মাঝে একটা কথা খুবই প্রিয়। উনারা যাই করেন আর নাই করেন; কিন্তু বলার সময় বলেন যে, 'জনগণ আমাদের সাথে আছে'। এখানে কে যে আসলে কার সাথে আছে, আর কে নাই….সেটাই আমার কাছে পরিস্কার না। তবে জেনুইন জনসম্পৃক্ততা ছাড়া যে কোন উন্নয়নই টেকসই না, এই সত্যটা কি উনারা আদতে বোঝেন? লাখ...না, কোটি টাকার একটা প্রশ্ন!
৬। আইনের শাসন, জ্বী, ঠিকই শুনেছেন। আইনই আপনাকে শাসন করবে; পুলিশ, আমলা কিংবা রাজনীতিবিদরা সহায়ক শক্তি মাত্র। আর এটার জন্যে দরকার একটা স্বাধীন আইনের শাসন বাস্তবায়নকারী কিংবা দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান।
৭। আমাদের দেশে যারাই ক্ষমতার অংশ হয়ে যায়, তদের সবার কাছেই রবীঠাকুরের একটা গান খুবই জনপ্রিয়। সেটা হলো ''আমরা সবাই রাজা''। এই গান তাদের রক্ত-মাংসে এমনভাবে মিশে যায় যে, জবাবদীহিতা বলে যে একটা শব্দ আছে, সেটাই তারা ভুলে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ক্ষমতা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই তারা তাদের হারানো স্মৃতি ফিরে পায়!
৮। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়টাই হলো, অর্থকে এমনভাবে ব্যবহার করা, যেন সেটার থেকে একশতভাগ (বা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ) রিটার্ন আসে। অর্থের যোগান কোথাও আনলিমিটেড না। সেজন্যেই এর ব্যবহারে 'প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার' শব্দটা ব্যবহার করা হয়। মনকে এতো বুঝাই, তারপরও এ'প্রসঙ্গে কথা উঠলেই আমার মন মিনমিন করে স্যাটেলাইটের কথা বলতে চায়, ধমকেও কাজ হয় না। কি সমস্যা বলেন দেখি!
৯। মানব সম্পদ অভিশাপ নাকি আশির্বাদ, এটা নির্ভর করবে এর সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর। জ্বী, ঠিকই শুনেছেন। আমি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কথাই বলছি। তবে আশার কথা, পাট, চামড়া, পর্যটন ইত্যাদি সেক্টরের মতোই এটার ক্ষেত্রেও আমাদের কর্তাব্যক্তিগণ তাদের পারফরমেন্সের ধারাবাহিকতা অনেক প্রতিকুলতার মধ্যেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
১০। প্রাকৃতিক সম্পদ একটা দেশের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আশির্বাদ। আর আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা কিভাবে হয় জানতে চোখ রাখুন সুন্দরবন, পার্বত্য অন্চল, খনিজ সম্পদের আহরন এবং এর ব্যবস্থাপনার দিকে। আপনি অচিরেই বুঝতে পারবেন, এ'ব্যাপারে আমরাই সেরা!
১১। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার বর্তমান বিশ্বে একটা দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। এইদিক দিয়ে অবশ্য আমরা এগিয়ে আছি বিশ্বের যে কোনও দেশের চাইতে। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এবং দেশব্যাপী ফেসবুকারদের আধিপত্য এ'ধারনাকে আরো সুসংহত করেছে। এই সাফল্যের রহস্য জানার জন্যই বিভিন্ন উন্নত দেশের মন্ত্রীরাও আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়দের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য সব সময় লালায়িত থাকে।
১২। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বা এর যথাযথ রক্ষনাবেক্ষণ না করলে প্রকৃতি যথাসময়ে প্রতিশোধ নেয়। এটা নিপাতনে সিদ্ধ একটা ব্যাপার। তবে কতিপয় জ্ঞানী লোকজনের বক্তব্য হচ্ছে, প্রকৃতি থাকলেই দূর্যোগ আসবে, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; এখানে কারো কোন ভূমিকা নাই। তাই আমাদের সুযোগ্য প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, দেশে কোন প্রকৃতিই রাখবেন না। দেখা যাক, দূর্যোগ কোত্থেকে আসে!!
এই হলো অতি সংক্ষেপে বারোটা উপাদানের আলোচনা। এর সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা এবং দেশপ্রেম হলো সেই সাইড উপাদান যাদের অনুপস্থিতি এই বারোটা উপাদানকে একেবারেই মুল্যহীন করে দিতে পারে কিংবা অন্যকথায়, বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে! আপনি আমার সাথে একমত হতে পারেন, দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কিংবা সংযোজন-বিয়োজন করতে চাইতে পারেন; সে আপনি চাইতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন…...এই মডেল বা ফর্মূলার সর্বস্বত্ব ভুয়া মফিজ কর্তৃক সংরক্ষিত।
একটা কথা আগেই পরিস্কার করে দেই। ছেড়া কাথায় শুয়ে যেসকল অলস কূপমন্ডুক লাখ টাকার স্বপ্ন দেখেন, তারা তাদের ভাঙ্গা চকিতে শুয়ে আমার এই মডেলের সফল বাস্তবায়নের দিবাস্বপ্ন দেখতেই পারেন। স্বপ্নে দেখতে পারেন, ঢাকা লন্ডন-প্যারিস-নিউইয়র্ককেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। তবে, তাদের জন্যে আমার একটা উপদেশ। এই স্বপ্ন দেখে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তিনবার সজোরে মাথায় ঝাকি দিবেন, যাতে করে এই স্বপ্নের ছিটেফোটাও মাথায় না থাকে এবং ঘোর পরিপূর্ণভাবে কেটে যায়। নতুবা ঘরের বাইরে পা দেয়ার সাথে সাথে যে অবশ্যম্ভাবী আফটার শক আসবে, তাতে আপনার হার্টের যে কোনও ধরনের ক্ষতি হতে পারে। আর সেটা যদি হয়েই যায়, তাহলে ভুয়া মফিজকে কোনভাবেই দায়ী করতে পারবেন না।
পৃথিবীতে কতোরকমেরই না আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। তেমনিভাবে আমার এই উন্নয়নের মডেল যদি সত্যিই দেশের উন্নয়নের কাজে লাগে, আর এর জন্য কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি আমাকে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন পুরস্কারের জন্য মনোনীত করতে চান….গো এহেড। আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নাই। আমার এই ঘোষণাকে 'আনুষ্ঠানিক অনাপত্তি পত্র' হিসাবেও গন্য করতে পারেন!
দেশ সত্যি সত্যিই উন্নয়নের মহাসড়ক, হাইওয়ে কিংবা মোটরওয়েতে সর্বোচ্চ গতিতে চলতে শুরু করুক। আর আপনার (সহৃদয়বান ব্যক্তির কথা বলছি) প্রচেষ্টা সার্থক হোক, আপনি কামিয়াব হোন; এটাই আমার আন্তরিক চাওয়া।

ফটোক্রেডিট: গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১১:২৮