কান নিয়েছে চিলে, বলে চিলের পেছনে দৌড়ানো; তিলকে তাল করা কিংবা হুজুগে বাঙ্গালী, ইত্যোকার বাগধারা বলেন আর প্রবাদবাক্যই বলেন, এগুলোর উৎপত্তি কিন্তু আমাদের, বাঙ্গালীদের একটা বিশেষ গুনকে উদ্দেশ্য করে। সেটা হলো আমরা কোন একটা বিষয় পেলে ক্রমাগত কচলাতে থাকি। কচলাতে কচলাতে সেটার ছাল-বাকলা সব তুলে ফেলি যতোক্ষন পর্যন্ত না কচলানোর আরেকটা বিষয় পাওয়া যায়। তেমনই একটা কচলা-কচলি গত বেশকিছুদিন ধরে দেখছি। ফেবুতে আমি যাই না, তবে শুনি অনেক কিছুই। ব্লগেও পক্ষে-বিপক্ষে এই ধারা অব্যাহত আছে। অনলাইন পত্রিকাগুলোতেও প্রায়শঃই নিউজ দেখি। ভাবছিলাম শুধু দেখেই যাই……কিন্তু শেষপর্যন্ত ভাবলাম, নাহ, একজন বাংলাদেশী বাঙ্গালী হিসাবে আমারও কচলা-কচলি করার অধিকার আছে। তাই কি-বোর্ড নিয়ে বসে পড়লাম।
এমনিতেই আমাদের দেশে গুরুতর সমস্যার শেষ নাই, তার মধ্যে হালে একটা বিশাল সমস্যা বা বিতর্ক যাই বলেন, দেখা দিয়েছে। বলছিলাম, নোবেলের জাতীয় সঙ্গীত সংক্রান্ত মন্তব্যের কথা। একটা ছোট্ট বিষয়, আর এটা নিয়েই সরগরম দেশ ও বিদেশ (বিদেশ বলতে ওইপাড়!)। কি বলেছে নোবেল?
সারেগামাপা’র গ্র্যান্ড ফিনালে অনুষ্ঠানে নোবেল গেয়েছিলো 'বাংলাদেশ' গানটি। এই গানের গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। গানটি পরিবেশনের পর নোবেল অনুষ্ঠানে বলেছে, 'বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের চেয়েও এসব গান তাকে ও অনেককে বেশি আলোড়িত করে।' আর সেজন্যেই এখন তার সমালোচনা করা হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত অবমাননার জন্যে। জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা? সিরিয়াসলি? ও কি জাতীয় সঙ্গীত কে গালি দিয়েছে? অপমানসূচক কোন কথা বলেছে? না। তাহলে অবমাননা কিভাবে হলো?
এর প্রতিক্রিয়া যতোই দেখছি, ততোই আমার রাগ হচ্ছে। ফেসবুকারদের কথা বাদ। কিন্তু যেসব নামীদামী লোকজন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, তারা কি বুঝে-শুনে দেখাচ্ছেন?
সঙ্গীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেছেন, 'দেশের জাতীয় সংগীতকে নিয়ে কোনোভাবেই কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়। আসলে সবার আগে নিজের দেশের জাতীয় সংগীতকে ভালোবাসতে হবে। সে যেমনই হোক।' নোবেল তো কোথাও বলে নাই যে, সে জাতীয় সঙ্গীতকে ভালোবাসে না। এটা দেখে একটা ঘটনায় দেশের কিছু আতেল সঙ্গীত শিল্পীর আতলামোর কথা মনে পড়ে গেল। বেশ অনেকদিন আগে বাংলাদেশের এক ইউরোপ প্রবাসী মেয়ে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ হিসাবে ফিউশানধর্মী কয়েকটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিল তার কিছু ওইদেশীয় বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে। এটা নিয়ে দেশে বসে আমাদের গুনী কিছু সঙ্গীতশিল্পী দুঃখে কাইন্দালাইলো এই বলে যে, রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বিকৃত করা হচ্ছে ! এই গুনী সঙ্গীতশিল্পীরাই কেউ একটা টু-শব্দও করে নাই যখন অমিতাভ বচ্চন বিজাতীয় উচ্চারনে 'কাহানী' মুভিতে ফিউশানধর্মী ''যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে'' গায়। কেন এই দ্বৈততা?
আমার তো ওই মেয়ের গানগুলো যেমন ভালো লেগেছিল, তেমনি অমিতাভের গাওয়া গানটাও ভীষণ প্রিয়।
দুঃখের সাথে দেখলাম, আমাদের দুই মাননীয় মন্ত্রীও এতে শামিল হয়েছেন। এনারা হলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এবং পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী তো বলেই বসলেন, 'যারা বলে পতাকা বদলাও, যারা বলে জাতীয় সঙ্গীত বদলাও, তারা স্বাধীনতাবিরোধী। এদের শেকড় জাতির পিতার খুনিদের সাথে।' একেই বলে, তিলকে তাল করা!
এদিকে নোবেলের ভাইরাল হওয়া এই সাক্ষাৎকারটি দেখার পরই তাকে চাবুক মারতে চেয়েছেন কলকাতার জনপ্রিয় গায়িকা ইমন চক্রবর্তী। এই বদের বদ মহিলাকে বলবো, আপনার নিজের দেশেই চাবুক মারার মতো কাজ করা অনেক সাবজেক্ট আছে। তাদেরকে মারুন গিয়ে। আমাদের দেশের ব্যাপার, আমরা বুঝবো। আপনার নোংরা নাক এখানে না গলালেও চলবে। ’মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী’ বোধহয় একেই বলে!
নোবেল আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে কোন অবমাননা করেনি, শুধু তার ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছে। এই মতামত প্রদান তার সংবিধান সম্মত অধিকার। আমাদের সংবিধানের পার্ট থ্রি (FUNDAMENTAL RIGHTS)তে Freedom of thought and conscience, and of speech এর অধীনে বলা আছে,
39. (1) Freedom of thought and conscience is guaranteed.
(2) Subject to any reasonable restrictions imposed by law in the interests of the security of the State, friendly relations with foreign states, public order, decency or morality, or in relation to contempt of court, defamation or incitement to an offence–
(a) the right of every citizen to freedom of speech and expression; and
(b) freedom of the press,
are guaranteed.
নোবেল শুধু তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, এটা তার অধিকার। আর প্রত্যেক নাগরিকের এই অধিকারকে নিশ্চিত করা হয়েছে আমাদের সংবিধানে। এটা কেড়ে নেয়ার অধিকার তাই কারোরই নাই। ব্লগে যারা নোবেলের বিরুদ্ধে বলছেন, তার কন্ঠরোধ করতে চাইছেন, তাদের তাহলে সামু'র কন্ঠরোধ (ব্লক) করাকেও সমর্থন করার কথা। সেটা তো করছেন না…..নাকি করছেন? সেলুকাস! সত্যিই কি বিচিত্র আমাদের মন-মানসিকতা!!
জাতীয় সঙ্গীত কোন আসমানী কিতাবের অংশ না যে, এর কোন পরিবর্তন করা যাবে না। আমাদের সংবিধানকেই তো পরিবর্তন করা যায়, করা হয়েছেও। কাজেই সরকার চাইলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় সঙ্গীতও পরিবর্তন করতে পারে। করবে কি করবে না, সেটা সরকারের ব্যাপার। আমাদের মতো সাধারন জনগনের কথায় তো আর পরিবর্তন হবে না! কিন্তু তাই বলে মতামত কেন দেয়া যাবে না? বিশ্বের বহুদেশ বিভিন্ন সময়ে তাদের জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন করেছে। অনেক দেশ তো একাধিকবারও করেছে। এসব উদাহরন খুজলে নেটেই পাবেন প্রচুর। সেসব দেশের জনগনের কি সমস্যা হয়েছে?
অনেকে বলছেন, জাতীয় সঙ্গীতের সাথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আবেগ জড়িত। তাদেরকে বলবো, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আবেগের সাথে যে পতাকা জড়িত ছিল সেটার কি পরিবর্তন হয় নাই? আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেই পতাকাকে সন্মানের সাথে স্যালিউট করতেন, বুকে নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তেন সেটা কি বিজয়ের পরে ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারী পরিবর্তিত হয় নাই? তাহলে? আবেগ ভালো, তবে অতি-আবেগ ভালো না।
আমার কাছে তো কথা, সূর.......সবমিলিয়ে আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা; তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা; এই গানটিকেই অধিকতর উপযুক্ত মনে হয় সবসময়। ক্ষমতা থাকলে আমিই বদলে দিতাম, নিশ্চিত! আমি এটা প্রায়ই একা একা গাই। তবে,
ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
– ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।।
এই লাইন কয়টা গাইতে পারি না, কান্না চলে আসে। তাই বলে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে তো অশ্রদ্ধা করি না কখনও! নিজের বাসায় বসে টিভি দেখতে গিয়ে খেলা বা যে কোন ইভেন্টে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে আমি দাড়িয়ে যাই। বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, আপনারা ক’জন এই কাজ করেন?
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটার কথা দিয়ে দিলাম, আর এর নীচে গানটার লিঙ্ক। অনেক শুনেছেন নিশ্চয়ই, আরেকবার শুনে দেখেন!
ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি তিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা!
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে!
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে, ওঠে পাখির ডাকে জেগে,
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
এতো স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়;
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন, এই দেশেতে মরি
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
আমরা সাধারন জনগন সবাই দেশকে ভালোবাসি। তাই বলে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। দেশপ্রেম কোন দেখানোর বা জাহির করার বিষয় না; অনুভবের বিষয়, বুকে লালন করার বিষয়। আসুন, আমরা সবাই তাই করি। অন্যদেরকেও উৎসাহ দেই। দেশের হাজারো সমস্যা আছে, সেদিকে নজর দেই। অহেতুক ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে কি আদৌ লাভ আছে কোন?
আমাদের দেশমাতৃকার এখন দরকার প্রকৃত দেশ-প্রেমিক সন্তান। তাতেই দেশের মঙ্গল, নয় কি!!!
ছবি: নেট থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১১:৪৫