আইল অফ ওয়াইট ভ্রমন - ১
প্রথমেই বলি, আইল অফ ওয়াইটে আমরা ছিলাম তিন রাত, দুই দিন। প্রথম পর্বটা ওখানে পৌছার পর বেড়ানো, তারপর রাত কাটানো পর্যন্ত। এই পর্বে বাকী দুই রাত এবং দুইদিন একসাথে দিয়ে দিলাম। শেষের দিনে আমরা সকালেই হোটেল থেকে চেক আউট করে সারাদিন এখানে-ওখানে কাটিয়ে বিকালের দিকে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সুতরাং একইসঙ্গে এটা শেষপর্বও বটে। যেহেতু দুইদিনের বেড়ানো একসাথে দিচ্ছি, তাই দিন হিসাবে না দিয়ে বেড়ানোর ক্রমানুসার অনুযায়ী দিলাম।
স্যানডাউন শহর-সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতঃ এই সৈকতটা ডায়নোসরদের হাড়-গোড় পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। এখানে একটা ইন্টারএকটিভ ডায়নোসর মিউজিয়াম আছে। পোলাপাইনের জন্য খুবই আনন্দদায়ক এবং শিক্ষনীয় জায়গা। বিভিন্ন স্কুল থেকে প্রচুর গাইডেড ট্যুর হয় এখানে।
প্রাচীন (গোশত ছাড়া) এবং আধুনিক (গোশত ওয়ালা) ডায়নোসর
মিউজিয়ামের বাইরের মাঝারী আকৃতির লেকটার রাজহাসগুলি আমার কাছে বরং বেশী আকর্ষনীয় মনে হয়েছে। অত্যাধিক সৌন্দর্য!!
এখানের সী-বীচে প্রচুর সময় কাটানো (নষ্ট) হয়েছে এবং আমি বাদে গ্রুপের বাকী সবাই খুবই আনন্দ-ফুর্তি করেছে। কেন জানি, সমুদ্র দেখলেই আমার ঘুম আসে, কাজেই আমি একচোখ বন্ধ রেখে ঘুমিয়েছি। বাকী একচোখে সজাগ দৃষ্টি রেখেছি গুড়াদের দিকে! সী-বীচের ছবি বারে বারে দেয়ার কোন মানে নাই, তাই দিলাম না। সামনে দেখাবো, কথা দিলাম।
শাঙ্কলীন চাইনঃ শাঙ্কলীন শহরে অবস্থিত একটা শৈলশিরা (Chine এর বাংলা এটাই খুজে পেয়েছি তবে জিনিসটা সম্পর্কে আমার ধারনা অস্পস্ট)। একসময় চোরাকারবারীদের ব্যবহার করা এই চাইনটা ১৮১৭ সাল নাগাদ একটা আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইংরেজ রোম্যান্টিক কবি কীটস ১৮১৯ সালে এখানে অবকাশযাপনকালীন সময়ে বেশকিছু কবিতা রচনা করেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা রয়্যাল নেভীর কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
কালভার ডাউনঃ সবার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও শুধু আমার জেদের কারনে এখানে যাওয়া হয়েছিল। এটা স্যানডাউনের উত্তরে অবস্থিত বেশ খাড়া চক ক্লিফ। এখানে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি-বিজড়িত চমৎকার একটা দূর্গ (বেমব্রিজ ক্যাসেল) আছে যেটা দেখতে পারি নাই। এই জায়গাটা আত্মহত্যার জন্যও বিখ্যাত। লোকজন গাড়ী চালিয়ে খাড়া ক্লিফ থেকে সমুদ্রে পরে গিয়ে আত্মহত্যা করে। আমার কথা হলো, আত্মহত্যা কর, ভালো কথা। গাড়ী নষ্ট করার দরকার কি? ২০১২ এর ১১ই অক্টোবর এখানে শেষ আত্মহত্যা অনুষ্ঠিত হয়!! এরপর এখানে ব্যারিকেড দেয়া হয়, যেন কেউ গাড়ী নিয়ে ঝাপ দিতে না পারে। প্রথম ছবিটা ইয়ারবোরোর দ্বিতীয় আর্লের স্মরণে নির্মিত একটা মনুমেন্ট।
দ্য নীডলস এন্ড এ্যালাম বেঃ দি নীডলস হলো দ্বীপের সর্বপশ্চিমে কতগুলো বিশালাকৃতির চক পাথর এবং এদের শেষ মাথায় একটা বাতিঘর। এই পাথরগুলো হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশীবার ছবি তোলা পাথরসমষ্টির অন্যতম। আর এই পুরো জায়গাটা হলো এ্যালাম বে। এই বে’র ক্লিফের মাথায় একটা ছোটখাটো পার্ক আছে। সেখান থেকে চেয়ারলিফটের মাধ্যমে নীচের সৈকতে যাওয়া যায়। সৈকতে স্থাপিত ছোট্ট একটা ডক থেকে বোটে করে চক ক্লিফ, নীডলস আর বাতিঘরের একদম কাছ থেকে বেড়িয়ে আসা যায়।
দুর থেকে দেখা দ্য নীডলস এবং এ্যালাম বে
পার্ক থেকে সৈকতে যাত্রা
চেয়ার লিফট থেকে দেখা ক্লিফ
সৈকত থেকে চেয়ার লিফট টার্মিনাল
এ্যালাম বে’র পাথুরে সৈকত এবং ক্লিফ
বোট থেকে চক ক্লিফ এবং বাতিঘর
এখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা ফিরতিপথে যাত্রা শুরু করলাম। পুরানো গাড়ী দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। ফেরার পথে দেখলাম একজায়গায় পুরানো গাড়ীর প্রদর্শনী হচ্ছে। থামতে চাইলাম, সবাই না না করে সমস্বরে তেব্র পরতিবাদ জানালো। গাড়ী চালাচ্ছিলাম আমি, আর মেজাজ এমনিতেই খচে ছিল। ঘ্যাচ করে ব্রেক খিচে নেমে গিয়ে বললাম, আমি দেখবো…..তোমরা যাও গিয়া! কি আর করা, সবাই বিরস বদনে নেমে চা, কফি খাওয়ার ধান্ধা শুরু করলো; আর এই ফাকে আমি পটাপট কয়েকটার ফটো খিচে ফেললাম!
ফেরীতে উঠার পর ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিল, আমাদের যাত্রাপথের বিভিন্ন সময়ে তিনটা বৃহদাকার লাক্সারী ক্রুজ শীপ আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাবে। সবার সাথে সাথে আমিও ক্যামেরা নিয়ে রেডি হলাম। এক এক করে পার হলো কুইন মেরী ২ (২০০৪ সালে যখন ভাসানো হয়, এটা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রুজ লাইনার। বর্তমানে সপ্তম), ওরিয়ানা আর ক্রাউন প্রিন্সেস। ছবিতে এদের বিশালত্ব ঠিকমতো বোঝা যায় না। এরা প্রত্যেকেই একেকটা ছোটখাট শহরের মতো! পাশ ঘেষে যাওয়ার সময় দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নাই।
কুইন মেরী ২
ওরিয়ানা
ক্রাউন প্রিন্সেস
প্রথম পর্বের শুরুতেই বলেছিলাম না, এতোদিন পর্যন্ত আইল অফ ওয়াইটে না যাওয়ার দুই নাম্বার কারন ছিল সপরিবারে যেতে না চাওয়া! অন্য কথায় একা একা যেতে চাওয়া! তাহলে শোনেন। এই তিনদিনের ট্যুরেও আমার পছন্দের ছয় ছয়টা জায়গায় যেতে পারি নাই, যেটা আমি একা একা গেলে খুব ভালোভাবে দেখে আসতে পারতাম।
১। হাই ডাউন রকেট টেস্ট সাইট
২। স্টীম রেলওয়ে রাইড
৩। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ইয়ারমাউথ ক্যাসেল
৪। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত দ্য নীডল ব্যাটারীজ
৫। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বেমব্রিজ ক্যাসেল
৬। দ্য বিটলসের স্মৃতি বিজড়িত ’রাইড’ শহরটা
আবার আইল অফ ওয়াইটে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এগুলো না দেখেই চলে আসার দুঃখ বুকে নিয়েই আমার বাকী জীবনটা ধুকে ধুকে পার করতে হবে। সবার দিকে চেয়ে ট্যুরের প্রায় অর্ধেকটা সময় সমুদ্রের পাড়ে বসে ঢেউ গুনে গুনে কাটিয়ে এসেছি। কতগুলো ঢেউ গুনেছি তা পর্যন্ত মনে নাই!
কোন মানে হয়???
ছবি আমার; তথ্য নেট, লিফলেট ও পুস্তিকার।