আইল অফ ওয়াইট। বৃটিশ দ্বীপপুন্জের মূল দ্বীপের দক্ষিনে লাগোয়া ৩৮৪ বর্গকিলোমিটারের একটা দ্বীপ। আমাদের হাতিয়া দ্বীপের চাইতে সামান্য একটু বড়। এর একদিকে মূল দ্বীপ আর অপরদিকে ইংলিশ চ্যানেল, যার ওপাশে ফ্রান্স। এই দ্বীপে বেড়ানোটা আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা। প্রধান কারনগুলো আপনাদের বলি।
১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে আমার আগ্রহ সীমাহীন। সে’সময়ে সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে এটা জার্মানদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ভু-খন্ড। এটা দখল করতে পারলে জার্মানদের দু’টো প্রধান লাভ হতো। প্রথমতঃ বৃটেনের একেবারে দোড়গোড়ায় পৌছা আর দ্বিতীয়তঃ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই বৃটিশ পোতাশ্রয় পোর্টসমাউথ এবং সাউথহ্যাম্পটন এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহন; আর এটা যদি তারা করতে পারতো তাহলে বৃটিশ নেভির মেরুদন্ড প্রায় ভেঙ্গে যেত! ত্যাদড় বৃটিশরাও এই দ্বীপে এমন এক ঘাটি বানিয়ে রেখেছিল যেটা আমাকে প্রতিনিয়ত ''গানস অব নাভারন'' মুভিটার কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। যাইহোক, শেষপর্যন্ত বৃটিশ বুদ্ধির কাছে হিটলারী বুদ্ধি আর পেরে উঠেনি, ফলে 'বদমাশ' বৃটিশদেরকে জন্মের শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছাটা শেষ পর্যন্ত ফুয়েরারের স্বপ্নই থেকে যায়।
২। রোমানরা কিন্তু হিটলারের চেয়ে চালাক ছিল, কিংবা বলা যায় সে’সময়ে বৃটিশরা হয়তো তুলনামূলকভাবে বোকা এবং দূর্বল ছিল। এই ভুখন্ডে রোমানদের ৪০০ বছরের রাজত্বের শুরুর দিকেই ব্যাটারা আইল অফ ওয়াইট দখল করে নেয়। রোমানদের বেশকিছু স্থাপনা এখানে পাওয়া গিয়েছে। জানেনই তো, এ’ব্যাপারে আমি কতোটা আগ্রহী!
৩। এই দ্বীপটাকে ''ডায়নোসরদের দ্বীপ'' ও বলা হয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ও প্রমানসাপেক্ষে বলা হয়ে থাকে, এখানে একসময় ২৫ প্রজাতীর ডায়নোসর বসবাস করতো!
৪। দি বিট্লস, আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা ব্যান্ড। আমি কোন কাজ করতে করতে সবসময় গান শুনি, কিন্তু জন লেননের গাওয়া 'ইমাজিন' গানটা যখনই শুনি, অন্য কোন কাজ করি না, শুধুই গানটা শুনি। আইল অফ ওয়াইটের রাইড নামের শহরটায় এই বিট্লসদের অনেক স্মৃতি জড়িত।
আপনাদের হয়তো মনে হতে পারে যে আমি চাপাবাজি করছি। বৃটেনে এতোবছর ধরে আছি আর একটা বৃটিশ দ্বীপে আমি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখনও যাইনি। ঘটনা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাহলে শোনেন, না যেতে পারার কারনগুলো একে একে বলি।
১। প্লেনে যাওয়া যায় সেখানে, কিন্তু তাহলে অনেককিছু মিস করবো। তাছাড়া, গাড়ী ছাড়া ওখানে গেলে পুরো দ্বীপের কোনা-কান্চি শান্তিমতো ঘোরা যাবে না। এদিকে, এতো দুরের রাস্তায় আরেকজন ড্রাইভার দরকার। সেটাই কায়দামতো পাচ্ছিলাম না। আমার বউ অবশ্য পারে, কিন্তু ওর হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে জান হাতে নিয়ে বসে থাকার কোন মানে নাই।
২। আমার বউ ঘোষনা দিয়ে রেখেছে, ওখানে গেলে সপরিবারেই যেতে হবে। আর এই ব্যাপারটাই আমার পছন্দ না। কেন? সেটা এই ভ্রমন শেষ হলেই জানতে পারবেন।
৩। বৃটেনে ঘোরাঘুরি খুব এক্সপেন্সিভ। এর চেয়ে কম খরচে ইউরোপ মেইনল্যান্ড ঘোরা যায়। আর সপরিবারে গেলে…….আসলেই গায়ে লাগে।
৪। বৃটিশ আবহাওয়া একটা বিরাট সমস্যা। বলা হয়ে থাকে, এমন ছন্নছাড়া আনপ্রেডিক্টেবল আবহাওয়া পৃথিবীতে একমাত্র জাপানে আছে যা কিনা ঘন্টার নোটিশে পরিবর্তিত হয়। বেড়ানোর জন্য ভালো আবহাওয়া জরুরী। আপনি পরিকল্পনা করলেন, দেখা গেল বেড়ানোর দিনগুলোতে এমন বাজে গ্লুমি ওয়েদার হলো যে, আপনার সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল।
এসব কারনেই যাই যাই করেও যাওয়া হয়ে উঠছিল না। আপনাদেরকে কোন এক লেখায় সুমনা ভাবীর কথা বলেছিলাম না! গত দু’সপ্তাহ ধরে দেখি দু’জনের মধ্যে যখন-তখন ফুসুর-ফাসুর চলছে, আমি সামনে আসলেই কথার পরিবর্তন হয়। বুঝলাম, কোন একটা গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা চলছে। অবশেষে, বউ একদিন আমাকে বললো, শোনো, সামনের সপ্তাহে তোমার ছুটি আছে না? চলো, সবাই মিলে দু’দিনের জন্য আইল অফ ওয়াইট যাই।
বুঝলাম, এটা নিয়েই তাদের পরিকল্পনা চলছিল। না বোঝার মতো করে বললাম, এতো দুরের রাস্তা, আমিতো একা এতো এতো ড্রাইভ করতে পারবো না। আর তুমি স্বপ্নেও ভাইবো না যে, তোমারে মটরওয়েতে আমি গাড়ী চালাইতে দিব।
আমার বউ 'বগাকে ফান্দে ফেলা' মার্কা একটা বিশাল হাসি দিয়ে বললো, এই কথা বলে তুমি এইবার পার পাবে না চান্দু! তোমারে পাশে নিয়া আমি গাড়ী চালাইতেও চাই না, বহুত ডিস্টার্ব করো তুমি। গাড়ী তুমি আর রাশেদভাই (সুমনাভাবীর পতিদেব) চালাবা। হুহ, বারে বারে চালাকী!!
তো, কি আর করা; বুঝতে পারলাম এবার আর রেহাই পাওয়া যাবে না। পরবর্তী কয়েকদিনে হোটেল বুকিং এবং অন্যান্য যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। দুই পরিবারের গুড়া আর বুড়া মিলিয়ে জনসংখ্যা সাত জন। কাজেই চিন্তা-ভাবনা করে একটা নাইনসিটার ভাড়া করা হলো, যেন একটু হাত-পা খেলিয়ে ভ্রমন করা যায়। তারপর এক কাকডাকা ভোরে যাত্রা শুরু করলাম আইল অফ ওয়াইটের উদ্দেশ্যে।
কথা অনেক হলো। চলেন, এবার সচিত্র বর্ণনাতে যাই।
সাউথহ্যাম্পটন এসে সময়মতোই আমাদের ফেরীতে উঠলাম। এই ফেরীগুলোতে একটা ফ্লোরে মোটামুটি একই উচ্চতার গাড়ী উঠানো হয়, তারপর পুরোটা ছাদ নামিয়ে ফেলা হয়। এভাবে তিনতলার উচ্চতাকে দোতলার উচ্চতায় নামিয়ে আনা হয়, ফলে এরা একেকবারে অনেক গাড়ী নিতে পারে।
রেড ফানেল কোম্পানীর আরেকটা ফেরী, আমাদেরটার মতোই, শুধু নাম আলাদা। এই ফেরীগুলো ’সোলেন্ট প্রণালী’ দিয়ে আইল অফ ওয়াইট যাওয়া-আসা করে।
সোলেন্ট প্রণালী ইংলিশ চ্যানেলেরই একটা অংশ যেটা আইল অফ ওয়াইটকে মূল দ্বীপ থেকে আলাদা করেছে।
প্রণালীতে নোঙ্গর করা একটা প্রাচীন জাহাজের স্যাম্পল। এ’ধরনের জাহাজ দিয়েই একসময় এরা সারা দুনিয়াতে দাপিয়ে বেড়িয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
আইল অফ ওয়াইটের নিউপোর্ট শহরে পৌছে হোটেলে চেক-ইন করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ক্যারিসব্রুক ক্যাসেল পরিদর্শনে।
ক্যারিসব্রুক ক্যাসেল বৃটিশ ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আপনারা মাইন্ড না করলে একটু ইতিহাস বলি, সংক্ষেপে। কারন আমার কাছে এটা ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। একাদশ শতাব্দীতে তৈরী এই দূর্গে রাজা প্রথম চার্লসকে প্রায় ১৪ মাস বন্দী করে রাখা হয়। পরবর্তীতে তাকে হাইকোর্ট অফ জাস্টিস এর বিচারের সম্মুখীন হতে হয় এবং রায় মোতাবেক ১৬৪৯ সালে লন্ডনে প্রকাশ্যে শিরোচ্ছেদ করা হয়। কথা হলো, সে’সময়ের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজন রাজার এই হাল কিভাবে হলো?
তখন চার্চ অফ ইংল্যান্ড প্রচন্ড ক্ষমতাশালী ছিল এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, পার্লামেন্ট অফ ইংল্যান্ডও অত্যন্ত ক্ষমতাধর ছিল। রাজা হিসাবে চার্লসের সেটা পছন্দ হয়নি। ত্যাড়ামীর অংশ হিসাবে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাহ্য করে উনি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। ফলে অবধারিতভাবে তাকে দু’দুটো গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয় এবং দু’টোতেই উনি পরাজিত হন।
রাজা চার্লসের শিরোচ্ছেদের পর রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ''কমনওয়েলথ অফ ইংল্যান্ড'' নামে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এটা অবশ্য মাত্র এগারো বছর স্থায়ী হয়। ১৬৬০ সালে প্রথম চার্লসের ছেলে 'দ্বিতীয় চার্লস' বৃটিশ রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হন। বেশীরভাগ মানুষই জানে যে, বৃটেনে সবসময়ই রাজতন্ত্র চালু ছিল। আমিও তাই জানতাম। কিন্তু এটা জানতাম না যে, এগারো বছরের জন্য হলেও বৃটেন একসময় প্রজাতন্ত্র ছিল!!
ক্যারিসব্রুক দূর্গ
দূর্গের প্রতিরক্ষা
দূর্গের সর্বোচ্চ স্থান থেকে দেখা চারপাশের দৃশ্য। প্রথম ছবিটা কিন্তু পাহাড়ের গায়ে একটা কবরস্থানের!
দূর্গের ভিতরের মিউজিয়ামে রাজার ব্যবহৃত জিনিসপত্র আছে। সেসব ছবি দেখানোর কোন মানে নাই। তবে, চার্চটা বেশ সুন্দর। প্রথম ছবিটা মূল বেদীর, দ্বিতীয়টা ছাদের, আর তৃতীয়টা রাজা প্রথম চার্লস এর।
দূর্গের ভিতরের পানির সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল চমকপ্রদ। একটা বিশাল ট্রেড হুইলের মধ্যে গাধাকে হাটানো হয় এবং এর মাধ্যমে পাশের কুয়া থেকে পানি তোলা হয়। প্রথম ছবিতে গাইড পানি তোলার প্রক্রিয়া বর্ণনা করছে, দ্বিতীয়টাতে প্র্যাকটিক্যাল ডেমোন্সট্রেশান আর তৃতীয়টা জ্যাক এর ছবি। জ্বি হ্যা, এই গাধার নাম জ্যাক। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, গাজীভাইয়ের গাধা-প্রীতির কথা মাথায় রেখে এর ক্লোজ শট নিয়েছি। এর সাথে গাইড ঠিক এ’ভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, Meet Jack, he’s the naughtiest donkey in the castle!!!
আজ এ'পর্যন্তই। এরপর আমরা একটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেরে সদলবলে হোটেলে ফিরে যাই।
ছবি আমার; তথ্য নেট, লিফলেট ও পুস্তিকার।
আইল অফ ওয়াইট ভ্রমন – ২