somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোহনীয় রমণীয় প্যারিস (পর্ব ২)

১৭ ই জুন, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্বের লিঙ্কview this link


আমি আজ পর্যন্ত যতগুলো নগরী দেখেছি, তার মধ্যে প্যারিসকে মনে হয়েছে সবচেয়ে রুপবতী। সত্যিকারের প্রেমে পরার মতোই একটা নগরী। ভেবে দেখলাম, এতোটা সাদামাটা আর ম্যাড়মেড়ে শিরোনাম প্যারিসের সাথে কেমন যেন যাচ্ছে না। তাই আমার পোষ্টের শিরোনাম বদলে দিলাম।

চলুন তবে, হাটা শুরু করা যাক!

কোথায় যেন ছিলাম? হ্যা, সেইন নদীর ব্রীজটা পার হয়ে চিল্লট প্রাসাদের দিকে এগুচ্ছিলাম। ব্রীজটা পার হলেই একটা মোড়, আর তারপরই চিল্লট প্রাসাদের সীমানা শুরু। এই পর্যায়ে নিশ্চিতভাবেই যে কেউ পরিশ্রান্ত হতে বাধ্য। প্রাসাদের সবুজ ঘাসে ছাওয়া চমৎকার চত্বর বিশ্রামের জন্য খুবই উপযুক্ত একটা জায়গা। একটু হাল্কা খাওয়া-দাওয়াও করে নেয়া যায় এখানে।



এই চত্বরে বেশ কয়েকটা বিশাল বিশাল ভাস্কর্য আছে। ছবিতে দেখুন,




এই ঐতিহাসিক প্রাসাদে আর সময় নষ্ট না করে পিছনে চলে এলাম। পেছনটাও খুব সুন্দর।



পেছনটা সাতটা রাস্তার একটা মিলনস্থল। এই রাস্তাগুলোর মধ্যে থেকে ক্লেবার এভিনিউ ধরে এগুতে থাকলে দেখা মিলবে বিখ্যাত আর্ক ডি ট্রায়াম্ফ এর। ২০০৭ এ এই রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় এক বাটপারের খপ্পরে পড়েছিলাম। স্যুট-টাই পড়া এই সুদর্শণ বাটপারের সাথে আমার কথোপকথন আপনাদেরকে সংক্ষেপে বলি।

- হ্যালো, শুভবিকাল। তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
- ইয়েস। আমি পুরাপুরি সতর্ক!
- আমি আজই একটা ব্যবসার কাজে ইতালী থেকে এসেছি। কিন্তু যার কাছে এসেছিলাম, সে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্যারিসে নাই। আমাকে আজই ইতালী ফেরত যেতে হচ্ছে। এদিকে, এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে আমার ওয়ালেট হারিয়ে ফেলেছি। পেট্রোল কেনার পয়সাও নাই। আমার কাছে গুচির দু’টা লেদার জ্যাকেট আছে, একেবারে তোমার সাইজের। হাইস্ট্রীটের যেকোনও দোকানে একেকটার দাম কমপক্ষে এক হাজার ইউরো। তোমাকে আমি চারভাগের একভাগ দামে দিয়ে দিব। মাত্র ২৫০ ইউরো।
- আমি দুঃখিত। লেদার জ্যাকেটে আমার কোন আগ্রহ নাই। আমি বললাম।
- তুমি কিন্তু বিশাল সুযোগ হারাচ্ছো। তুমি অত্যন্ত শস্তায় একটা দামী জ্যাকেট পাচ্ছো। সেইসাথে একজন বিপদে পড়া মানুষকে সাহায্য করছো।
- দেখ, আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। এতো টাকা আমার কাছে নাই।
- ব্যাংক কার্ড তো আছে। টাকা তুলে দাও। ওইযে ক্যাশ মেশিন!!

মনে মনে বললাম, হালায় কয়কি? আমি হইলাম গিয়া ঢাকাইয়া পোলা। আমারে ভোদাই বানাইতে চায়? তিনবারে সেই জ্যাকেটের দাম ১০০ ইউরোতে নেমে এসেছিল। দুঃখ প্রকাশ করে বহুকষ্টে ব্যাটার কাছ থেকে ছুটেছিলাম। আমার কাছে ইতালীয়ানদের ইংলিশ বলার স্টাইল আর অঙ্গভঙ্গি কেন জানি খুব ফানি মনে হয়। জ্যাকেট না নিলেও বাটু’র (বাটপারের সংক্ষেপ) সাথে কথা বলে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।

যাইহোক, আর্ক ডি ট্রায়াম্ফে ফেরত আসি। বারোটা রাস্তার মিলনস্থলের উপর এই অনুপম মনুমেন্টটা। এটাকে ঘিরেই এই বিশাল রাউন্ড এবাউট! এটা প্লেস দ্য গলের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত; একটা টানেল দিয়ে যেতে হয়। ফরাসী বিপ্লব আর সম্রাট নেপোলিয়নের সময়কার বিভিন্ন যুদ্ধে মারা যাওয়া সৈন্যদের স্মরণে উৎসর্গকৃত এই মনুমেন্টটাতে নিহত সবার নাম চতুর্দিকে খোদাই করা আছে। এর ঠিক নীচে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত নাম না-জানা বহু সৈন্যের একটা কবরস্থানও আছে।

বিস্তারিত ইতিহাস বলার ধৈর্য নাই। বরং ছবি দেখাই,







আর্ক ডি ট্রায়াম্ফে এসে মিলিত হওয়া বারোটা রাস্তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত রাস্তা হলো এভিনিউ দে শ’জ এলিজে; অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন একটা রাস্তা। এটা প্যারিস নগরীর অন্যতম প্রধান সড়কও বটে। এই রাস্তায় হেটে আমি খুবই আনন্দ পাই।



এই সড়কের শেষে যে জায়গা তার নাম প্লেস ডি লা কনকর্ড। ফরাসী বিপ্লবের সময় এখানে অনেক রাজপরিবারের সদস্য এবং তাদের অনুসারীদের গিলেটিনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এখানে একটা মিশরীয় ওবেলিস্ক আছে। এই অনিন্দ্যসুন্দর ওবেলিস্কটা প্রাচীন মিশরের লুক্সর মন্দিরের প্রবেশমুখে ছিল। সেখান থেকে তুলে এনে ব্যাটারা এখানে লাগিয়ে দিয়েছে! সাংস্কৃতিক চৌর্যবৃত্তির আরেকটা প্রকৃষ্ট উদাহরন। সামনে এক ফেরাউন সাজা মুর্তিও আছে!



হাটতে হাটতে একটা বিশাল আর্টগ্যালারী কমপ্লেক্স আর চমৎকার বাগান পার হয়ে এসে পৌছলাম আর্ক ডি ট্রায়াম্ফ ডু কারুসেল এর সামনে। এটা নেপোলিয়নের একটা যুদ্ধজয়ের স্মৃতিকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য তৈরী করা হয়। এখানে কয়েকটা ভ্রাম্যমান খাবারের দোকান আছে যারা চমৎকার ক্রেইপ (অনেকটা আমাদের পাটিসাপটা পিঠার মতো, তবে পুর হিসাবে চকোলেট ব্যবহার করা হয়) বানায়। এটা খেতে খেতে আরেকটা ব্যাপার আমি খুবই উপভোগ করি। খাওয়ার সময় দেখবেন, আশেপাশে অনেক চড়ুই পাখি আছে। ক্রেইপের ছোট্ট টুকরা হাতে নিয়ে এদের দিকে ধরবেন। এরা এতোই সাহসী যে, উড়ে এসে আপনার হাত থেকেই খাবে, ছুড়ে দিতে হবে না।



এখান থেকে অল্প একটু হাটলেই নজরে পড়বে কাচ এবং ধাতু দিয়ে তৈরী একটা বড় আর তিনটা ছোট পিরামিড। এসে গিয়েছি ল্যুভর মিউজিয়ামে। বড় পিরামিডটার ভিতর দিয়েই মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে হয়।



ল্যুভর আক্ষরিক অর্থেই একটা বিশাল মিউজিয়াম। আপনি যদি দৌড়াতে দৌড়াতেও দেখেন, তাহলেও একদিনে শেষ করতে পারবেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। পুরোটা মিউজিয়াম কমপ্লেক্সের ছবি দেয়া তো সম্ভব না, বিল্ডিংগুলোর একটা কোনা’র ছবি দিলাম।



আগেই বলেছি, পুরোটা দেখা সম্ভব না। তাছাড়া মিউজিয়াম জিনিসটা আমার খুব একটা প্রিয়ও না। বরন্চ প্রাচীন নিদর্শন আমি উৎসস্থানে গিয়ে দেখতেই বেশী পছন্দ করি। বউয়ের চাপাচাপিতে কিছু বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ তে ঢুকেছিলাম। এজেন্ডাগুলোর কিছুটা আপনাদেরকে দেখাই। প্রথমেই মোনালিসার ছবি। এই ছবি দেখার জন্য মানুষ কেন পাগল হয় আমার মাথায় ঢোকে না।



মোনালিসার ঠিক উল্টাপাশে প্রদর্শিত হচ্ছে ১৫৬৩ সালে পাওলো ভেরোনেসের বিশাল ক্যানভাসে তেলরং এ আকা 'দি ওয়েডিং ফিস্ট এ্যট কানা'। এটি ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত সবচেয়ে বড় এবং অন্যতম মহামুল্যবান পেইন্টিং। এটা দেখে বরং আনন্দ পেয়েছি। বাইবেলে বর্ণিত আছে, এই অনুষ্ঠানেই নাকি যীশু পানিকে মদে পরিনত করেন।



ল্যুভর মিউজিয়াম যেই বিল্ডিং কমপ্লেক্সে অবস্থিত সেটা প্রথমে তৈরী করা হয় দূর্গ হিসাবে। ল্যুভর প্রাসাদ একসময় রাজপ্রাসাদ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। এর অন্যতম প্রধান আর্কিটেক্টের পোর্ট্রেট।



এই দু’টো কোন বিখ্যাত পেইন্টিং না। ল্যুভরের রুমগুলোর সিলিং আর কোনাগুলো এভাবেই পেইন্ট এবং ডেকোরেট করা।




'দি উইঙ্গড ভিক্টোরী অফ সামোথ্রেস'। যীশুখ্রীষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে মার্বেল পাথরে বানানো হেলেনিস্টিক ভাস্কর্যের এক অনুপম নিদর্শন। এটা 'নাইক অফ সামোথ্রেস' নামেও পরিচিত। নাইক হচ্ছে বিজয়ের গ্রীক দেবী।



'নেপোলিয়নের এপার্টমেন্ট' নামে একটা সেকশন আছে ল্যুভরে। এটা আসলে ল্যুভর রাজকীয় প্রাসাদের একটা নমুনা বলতে পারেন। এর চোখধাধানো বিলাসিতা দেখানোর একটু চেষ্টা করি। আমার এই ছবিগুলোতে আসল মজা খুব একটা পাওয়া যাবে না আমার ক্যামেরা আর আনাড়িপনার কারনে। এর সিলিং আর দেয়ালের যে কারুকাজ, এমনটা আমি আর কোথাও দেখিনি। আপনারা চাইলে গুগলে ঝকঝকে সব ছবি দেখতে পারেন। মুগ্ধ হবেন, এই নিশ্চয়তা দিলাম।

নেপোলিয়নের এপার্টমেন্টের প্রথম ছবিটাই নেপোলিয়নের না হলে ভালো দেখায় না।








টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি। একদিনে আর কতো হাটা যায় বলেন! একটু রেস্ট নেই। আপনারাও নেন। ফাইনাল হন্টন হবে 'আগামী এবং শেষ' পর্বে!


ছবিঃ প্রথমটা নেট থেকে, বাকী সব আমার ক্যামেরার।
তথ্যঃ নেট এবং বিভিন্ন গাইড বুকলেট।

মোহনীয় রমণীয় প্যারিস (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ রাত ১০:১৪
৩৯টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপব্লগার "জটিল ভাই"-এর সাক্ষাৎকার

লিখেছেন জটিল ভাই, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৩৭

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জয় বাংলা - জাতীয় শ্লোগান হিশেবে বাতিল: ঐতিহ্যবিরোধী এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

লিখেছেন কিরকুট, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪০



বাংলাদেশের ইতিহাসে "জয় বাংলা" শ্লোগান শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়; এটি একটি জাতির আবেগ, চেতনা এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই শ্লোগান ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির প্রেরণা। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু... ...বাকিটুকু পড়ুন

পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ.......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪০

পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ.......

জীবনে কিছু সময়, কিছু দিনের কথা আমৃত্যু মনে থাকে তেমন বেশ কয়েকটি দিন তারিখ আমার জীবনেও খোদাই হয়ে আছে....মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের ১ম সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও অতিজাতীয়তাবাদ উন্নয়নের মূল অন্তরায়

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩১


উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রকে কিছু স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হবে কথাটি বলেছিলেন অত্যাধুনিক সিংগাপুরের উন্নয়নের কারিগর লি কুয়ান। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৯ সালে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরের প্রধান মন্ত্রি হন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাবির ভাই বেরাদার (অন্তর্বর্তীকালীন) সরকার কি বালটা ফালাচ্ছে বলতে পারবেন?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০

১) সরকারী কোন অফিসে নূন্যতম কোন লুটপাট বন্ধ হয়েছে?
২) জায়গায় চাঁদাবাজী বন্ধ হয়েছে?
৩) আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নুন্যতম কোন বিচার তারা করতে পেরেছে? বা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে পেরেছে?
৪। আইন শৃঙ্খলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×