ক’দিন ধরে বেশ ব্যস্ততা যাচ্ছে। মাথার মধ্যে বিভিন্ন আইডিয়া ঘোরফেরা করে, কিন্তু কেন জানি লিখতে ইচ্ছা করে না। একদিকে সময় পাইনা, অন্যদিকে লেখার জন্য যদিও বা বসি, বসলে মনে হয় কে যেন চেয়ার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে! এটা কি রাইটার্স ব্লক? কি জানি? যাইহোক, শেষে ভাবলাম অনেকদিন ধরে কোন বেড়ানোর পোষ্ট দেয়া হচ্ছে না, আবার বিতং করে কিছু লিখতেও যেহেতু ইচ্ছা করছে না, তাই ছবি ব্লগই দেই একটা। এটা প্রথম পর্ব। ইচ্ছা আছে, তিনটা পর্বে এটা সম্পূর্ণ করবো। দেখা যাক।
এই পোষ্টের ছবিগুলোর একটা ইতিহাস আছে। আমার বেশ আগের নষ্ট হওয়া একটা ল্যাপটপ ঘরে পরে ছিল বহুদিন। বিভিন্ন সময়ে বেড়ানোর সময় তোলা প্রচুর ছবি ছিল সেটাতে। মাসদুয়েক আগে সেটার হার্ডডিস্ক খুলে একজনকে দিয়েছিলাম, যদি কিছু রিকোভারী করা যায়, এই আশায়। সে বলতে গেলে প্রায় সবই উদ্ধার করেছে। তার মধ্যে আমার প্যারিস ভ্রমনের খুবই প্রিয় ছবিগুলোর বেশীরভাগই আছে। এই পোষ্ট দেয়ার পিছনে সেই আনন্দটাও বলতে পারেন দায়ী....বহুলাংশে!
প্যারিস আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা। ঢাকা থেকে চিটাগাং যাওয়ার মতো, লন্ডন থেকে প্যারিস বহুবার গিয়েছি, বিভিন্ন সময়ে; বিভিন্ন কারনে। তার মধ্যে বিশুদ্ধ বেড়ানো যাকে বলে, সেই উদ্দেশ্যে গিয়েছি মাত্র দু’বার। প্রথমবার ২০০৭ এ একা। দ্বিতীয়বার ২০১১ তে; বউ জেদ ধরাতে আর একা যেতে পারি নাই, সাথে নিতে হয়েছিল। ছবিগুলো সে সময়ের। তখন আমার ক্যামেরা ছিল কম মেগাপিক্সেলের, একেবারে বেসিক। তাই ফটো কোয়ালিটি খুব একটা সুবিধার না। কষ্ট করে দেখেন, কি আর করবেন।
এবার ছবি প্রসঙ্গে আসি। প্যারিসে আমার খুব পছন্দের একটা বেড়ানোর রুট আছে, পায়ে হাটা রুট। প্যারিস গেলেই আমার একটা চেষ্টা থাকে এই রুটে একটা চক্কর মারার। এর শুরু আইফেল টাওয়ার দিয়ে, আর শেষ হয় নটরড্যাম গির্জায় গিয়ে। ছবিগুলো আমি এই রুট অনুযায়ীই সাজালাম। প্রথম পর্ব মোটামুটি আইফেল টাওয়ারের উপর। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম একটা স্থাপনা তো এটুকু দাবী করতেই পারে, কি বলেন!
প্যারিসের শ্যাম্পস ডি মার্সে ১৮৮৯ সালে স্থাপিত রট আয়রনের তৈরী এই টাওয়ারটিকে বহুযুগ ধরেই ''প্যারিসের আইকন'' হিসাবে গন্য করা হয়। কেন এটি তৈরী করা হয় জানতে হলে অতি সংক্ষেপে একটু পিছনে ফিরে যাই। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বিপ্লবীদের হাতে বাস্তিল দূর্গের পতন ঘটে। সেই বিপ্লবটা ছিল ফরাসী রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আর বাস্তিল দূর্গ ছিল তৎকালীন রাজকীয় স্বৈরাচারিতার একটি অন্যতম প্রতীক। ১৮৮৯ সাল ছিল সেই বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপনের বছর। সিদ্ধান্ত হয়, রাজতন্ত্র-পরবর্তী ফ্রান্সের শৌর্য-বীর্য আর উন্নতি একটি মেলা আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হবে। মেলাটির নাম দেয়া হয়, 'এক্সপোজিশান ইউনিভার্সাল অফ ১৮৮৯'। আরো সিদ্ধান্ত হয়, ফরাসী বিপ্লবকে স্বরনীয় করে রাখতে এবং ফ্রান্সের বর্তমান অবস্থানকে তুলে ধরতে একটি টাওয়ারও তৈরী করা হবে। দুই ফরাসী ডিজাইনার মরিস কোচলিন এবং এমিল নুগুয়ের এই টাওয়ারটির ডিজাইন করেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৮৮৭ সালে প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেল এর তত্বাবধানে এর নির্মানকাজ শুরু হয় আর উনার নামেই টাওয়ারটির নামকরন করা হয় 'আইফেল টাওয়ার'।
আইফেল টাওয়ারের তিনটা ফ্লোর বা লেভেল রয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় লেভেলে যেতে সিড়ি বা লিফ্ট; যে কোনটা ব্যবহার করা যায়। আমি অবশ্য সিড়ি বেয়েছি! তৃতীয় বা টপ ফ্লোরে যেতে কোন সিড়ি নেই। আবার টিকেট কেটে লিফটে করে যেতে হয়।
এবার কিছু ছবি দেখা যাক। প্রথম ছবিটা টাওয়ারের নীচে দর্শনার্থীদের লম্বা লাইনের।
লোহা-লক্করের স্তুপ না, টাওয়ারের পেটের ভিতর থেকে তোলা।
বিভিন্ন লেভেল থেকে পাখীর চোখে প্যারিস। সেইন নদী, প্যারিস নগরী এবং চিল্লট প্রাসাদের বিভিন্ন ছবি।
সব ফ্লোরেই একটা করে রেস্টুরেন্ট আছে। টপ ফ্লোরেও 'বিশেষ' একটা আছে। বিশেষ এ’জন্যে যে, বিভিন্ন জুটিরা সেখানে গিয়ে শ্যাম্পেন খায় আর রোমান্টিক ছবি তোলে। এটা হলো একটা ট্র্যাডিশান। ২০০৭ এ একা ছিলাম, কোন ঝামেলায় পরি নাই। ২০১১ তে আমার বউ বায়না ধরলো, আমরাও শ্যাম্পেন খাবো আর রোমান্টিক ছবি তুলবো। কি আর করা। পরেছি মোগলের (পড়েন, বউয়ের) হাতে, খানা (পড়েন, শ্যাম্পেন) খেতে হবে সাথে। শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে রোমান্টিক ছবি তুললাম। ঘরের কথা প্রচার করা ঠিক না, তাই সেই ছবি দিলাম না। বরং আরো অধিকতর আকর্ষনীয় ছবি দেখেন।
টপ ফ্লোরে একটা এপার্টমেন্ট আছে, যেটা গুস্তাভ আইফেলের অফিস ছিল। ওটাকে সেভাবেই রাখা হয়েছে। উনার আর উনার মেয়ে ক্লেয়ারের মোমের মূর্তি দেখুন।
আমেরিকান আবিষ্কারক থমাস এডিসন সেই এপার্টমেন্টে গুস্তাভ আইফেলের সাথে দেখা করেন এবং একটি গ্রামোফোন উপহার দেন। উনার মোমের মূর্তিও সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এই ছবিটা নেট থেকে নিয়েছি। আমার তোলা এমন কিছু ছবিও ছিল, কিন্তু সেগুলো আর উদ্ধার করা যায়নি।
টপ ফ্লোরে আরেকটা আকর্ষনীয় চেম্বার আছে যেখানে আইফেল টাওয়ার থেকে বিভিন্ন বড় বড় নগরীর দুরত্ব দেয়া আছে। আমাদের প্রিয় ঢাকার দুরত্ব দেখুন।
টাওয়ার থেকে নেমে রাস্তা পার হলেই সেইন নদীর উপর একটা ব্রীজ। আমার রুট অনুযায়ী সেই ব্রীজ পার হয়ে চিল্লট প্রাসাদের দিকে এগুতে হবে। এই প্রাসাদের চত্ত্বর থেকে আইফেল টাওয়ারের সবচাইতে সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। তিনটা দিলাম।
প্রতিরাতে সুর্যাস্তের পর রাত একটা পর্যন্ত আইফেল টাওয়ারে আলোর খেলা চলে। এটা অবশ্য চলমান না; প্রতি ঘন্টার শুরুতে কিছুক্ষণ থাকে। দু’টা ছবি দিলাম। কোনটাই বেশী ভালো আসে নাই।
আইফেল টাওয়ারের এখানেই সমাপ্তি। আশারাখি আমার রুট ধরে আরো এগিয়ে যাবো সামনের দিনগুলোতে। সঙ্গী যতো বেশী হয়, ততোই আনন্দ আর উত্তেজনা!
ছবিঃ আমার ক্যামেরা
তথ্যঃ নেট এবং বিভিন্ন গাইড বুকলেট।
মোহনীয় রমণীয় প্যারিস (পর্ব ২)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ রাত ১০:১১