কালচার শকের বাংলা প্রতিশব্দ খোজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন যুৎসই কিছু খুজে পেলাম না। কি হতে পারে? সংস্কৃতির ধাক্কা কিংবা আঘাত? শুনতে খুব একটা ভালো বা পারফেক্ট শোনায় না। তাছাড়া, আমার মনে হয় এগুলোতে কালচার শকের আসল অর্থের প্রতিফলন তেমন একটা ঘটে না, তাই আমার এই লেখায় কালচার শক-ই বলছি। আরেকটা শব্দ হলো 'বিলাত'। আমরা যাকে সাধারনভাবে ইংল্যান্ড বলি, তার বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে এমনিতেই অনেকগুলো নাম। যেমন, যুক্তরাজ্য, গ্রেট ব্রিটেইন (বা শুধুই ব্রিটেইন), দ্য ইউনাইটেড কিংডম (সংক্ষেপে ইউকে), এবং সর্বোপরি ইংল্যান্ড, যেটা আগেই বলেছি। আরেকটা নাম হলো 'বিলাত', এটা কিভাবে বা কোথা থেকে এলো, জানিনা। যাই হোক, বাংলাতে আমার দখল এবং জ্ঞান অত্যন্ত সাধারন মানের; ব্লগে শব্দ নিয়ে যারা খেলা করে, তারা ভালো বলতে পারবে।
কালচার শক বিষয়টা আসলে কি? সংক্ষেপে বলতে গেলে, একজন মানুষ যখন তার চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে অন্য একটা সম্পূর্ণ অচেনা, ভিন্ন পরিবেশে আসে তখন মনোজগতে যে ধাক্কাটা লাগে, সেটা। এটা কোথাও বেড়াতে গেলে ততোটা বোঝা যায় না। দেশে থাকতে বিদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারনে যেতে হয়েছে। তাছাড়া, বেড়ানো যেহেতু আমার অন্যতম প্রধান শখ, এ'উদ্দেশ্যেও অনেকবার দেশের বাইরে গিয়েছি। এসব ধাক্কা টাক্কা খুব একটা অনুভব করিনি কখনও। ঘুরেছি, ফিরেছি, খাওয়া-দাওয়া করেছি, ব্যস......ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। দেশের সবকিছু গুটিয়ে তল্পী-তল্পা, বদনা-বাটি নিয়ে যখন এই সূদুঢ় বিলাতে এসে ছিটকে পড়লাম, তখন বুঝলাম, ধাক্কা কাকে বলে এবং ইহা কতো প্রকার ও কি কি!
বিরক্ত হবেন না, একটু একাডেমিক-টাইপ কথাবার্তা বলি। কালচার শকের বলতে পারেন চারটা পর্যায় বা পর্ব আছে, যার প্রথমটা হানিমুন পর্ব। এটা আসলে, সহজ কথায় ঘোরের পর্ব। এই পর্বে আমরা যা দেখি, খাই কিংবা যেসব লোকজনের সাথে মিশি....বেশীরভাগই ভালো লাগে। আমরা যখন কোথাও বেড়াতে যাই, তখন এই পর্বেই থাকি। আর এটা শেষ হবার আগেই দেশে ফিরে যাই। এর পরেরটা আপোষ পর্ব যেখানে প্রাথমিক উত্তেজনা কাটার পর আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আপোষ করা শুরু করি। তৃতীয়টা সমন্বয়সাধন পর্ব। এখানে আমাদের দীর্ঘদিনের মজ্জাগত অভ্যাস বা পরিবেশের সাথে নতুন অভ্যাস বা পরিবেশের সমন্বয়সাধন করি। আর সবশেষ পর্বে আমরা পুরানো এবং নতুন কালচারের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদের পর একটা স্থিতাবস্থায় আসি।
যাইহোক ভূমিকা অনেক হলো, যা বলছিলাম বরং সেটাতে ফিরে আসি।
ইংল্যান্ডে প্রথম শকঃ
ইংল্যান্ডে আমি যেই শহরে থাকবো সেখানে পরিচিত একজন একটা রুম আমার জন্য ঠিক করে রেখেছিল। সাবলেট বলতে পারেন। বাসাটায় বাবা (বিল) আর তার সাত বছরের ছেলে (ব্রায়ান) থাকে। মা ছেলেকে ফেলে রেখে আরেক লোকের সাথে ভেগে গিয়েছে। তিন বেডরুমের বাসায় একটা রুম তারা গেস্টরুম হিসাবে ব্যবহার করতো। সেটাই আমার রুম। কোন এক শীতকালে রাত সাড়ে সাতটার দিকে বাড়ীটাতে ঢুকলাম। প্রথম পরিচয়েই চা খেতে খেতে বিল যেভাবে তার বউয়ের ভেগে যাওয়ার বিস্তারিত কাহিনী বয়ান করছিল, আমার শুনতেই লজ্জা লাগছিল.....যদিও ওর মধ্যে কোন বিকার দেখিনি। নিজের দুর্দশার কাহিনী কিংবা ঘরের কথা পরকে, অর্থাৎ একজন স্বল্পপরিচিত মানুষের কাছে কেউ এভাবে অবলীলায় বলতে পারে, আমার জানা ছিল না। আর ব্রায়ানের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল এভাবে: ব্রায়ান, এ হচ্ছে মফিজ, ফ্রম বাংলাদেশ। এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। আশা করছি তুমি এনাকে বিরক্ত করবে না, এবং ভালোভাবে মিলেমিশে থাকবে।
ত্যাদোড় ছেলেটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি দেখছিল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে 'ওকে' বলে আবার টিভির দিকে মন দিল।
বিল বললো, ব্রায়ান, বি নাইস! তুমি কিন্তু হাই বলোনি!
ব্রায়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললো, হাই মফিজ। তারপর হাই তুলতে তুলতে হাই-এ অর্থাৎ উপরে ঘুমাতে চলে গেল।
পিচ্চি একটা ছেলে। এ তো দেখি বিরাট বেয়াদপ, নাম ধরে বললো! মফিজ আংকেল বা নিদেনপক্ষে মফিজভাই তো বলতে পারতো! আর বাপটাই বা কেমন? ছেলেকে কিছুই বললো না। কিন্চিৎ মন খারাপ করেই আমার রুমে চলে গেলাম। সকালে টেবিলে একসাথে বসেছি নাস্তা করতে। নাস্তার সাথে সাথে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই ব্রায়ান আমাকে বললো, মফিজ, দুধের বাটিটা এদিকে পাস করবে.....প্লিজ!
রাগে আমার পিত্তিসুদ্ধা জ্বলে গেল। আড়চোখে বিলকে দেখলাম। নির্বিকারভাবে খেয়ে চলেছে, ছেলেকে শাসনের কোন নামগন্ধই নেই। বুঝলাম, সুবিচার প্রাপ্তির কোন আশা এখানে দুরাশা মাত্র। আস্তে আস্তে জানলাম, এখানে বড়-ছোট কোন ব্যাপার না, সবাই সবাইকে নাম ধরেই ডাকে। এ পর্যায়ে আপনাদের জানিয়ে রাখি, ইংলিশ ব্রেকফাস্টের মতো জঘন্য ব্রেকফাস্ট আমাদের এই দুনিয়াতে খুব কমই আছে।
শকের পরে শকঃ
চাকুরীতে জয়েন করেছি। স্যরি, প্লিজ, থ্যাঙ্ক ইউ, এক্সকিউজ মি ইত্যকার শব্দগুলো বলতে বলতে জীবন মোটামুটি ওষ্ঠাগত। দেশে কে আর এগুলো ব্যবহার করে? অথচ এখানে খুব খেয়াল করে এবং মনে করে এ’গুলো ব্যবহার করতে হয়। না করলে এরা আবার মাইন্ডও করে। উঠতে বসতে প্রতি মুহুর্তে এ’গুলো বলতে বলতে কেমন যেন হাপ ধরে যায়। তারপরও একদিন শেষরক্ষা হলো না।
তখনও গাড়ী কিনি নাই। আমার এক কলীগ একদিন আমাকে বাসায় ড্রপ করলো। জায়গামতো এসে আমি গাড়ী থেকে নেমে হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকে গেলাম। পরদিন সে আমাকে ধরলো,
- মফিজ, কাল তোমাকে ড্রপ করলাম। তুমিতো একটা থ্যাঙ্কস-ও দিলে না। আমি খেয়াল করেছি স্যরি, প্লিজ, থ্যাঙ্ক ইউ, এক্সকিউজ মি ইত্যাদি শব্দগুলো তুমি খুবই কম ব্যবহার করো। তোমাদের দেশে এমন শব্দ তোমরা ব্যবহার করো না?
- করি, অবশ্যই করি। তবে তোমাদের মতো এতো করি না। তাছাড়া, আমরা মুখে বলার চেয়ে এক্সপ্রেশানে বেশী বিশ্বাসী। যেমন, তুমি খেয়াল করে দেখবে, আমাকে কিছু দিলে আমি মুখে থ্যাঙ্ক ইউ না বলে অনেক সময় একটা হাসি দেই। ওটাই কিন্তু আমাদের 'থ্যাঙ্ক ইউ'! এটুকু বলে একটা মধুর হাসি দিলাম।
- না, সেটা ঠিক আছে। তবে এখানে এগুলো না বললে লোকজন তোমাকে রুড ভাববে। ও গম্ভীর হয়ে বললো।
- বুঝতে পারছি। সবজান্তার মতো মাথা দোলাতে দোলাতে বললাম। বুঝতেই পারছো, নতুন দেশ, নতুন কালচার; এডাপ্ট করতে একটু সময় তো লাগবে, তাইনা! আর মনে মনে বললাম, তোদের এসব লোকদেখানো ভদ্রতা করতে করতে তো আমার অবস্থা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো। অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছি!!
দীর্ঘদিন ধরে এমন আর্টিফিশিয়াল ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকতে থাকতে কি অবস্থা হয় তার একটা উদাহরন আপনাদেরকে দেই। বোধহয় বছর দু’এক আগে এক বন্ধুকে নিয়ে দেশে পাড়ার টং দোকানে চা খেতে গিয়েছি। চা বানিয়ে দোকানদার বললো, মামা চা নেন। আমি বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে চা নিয়ে দোকানদারকে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ মামা! দেখি আমার বন্ধু আর দোকানদার দু’জনেই আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন এইমাত্র ফ্লাইং সসার থেকে একটা এলিয়েন নেমে তাদের সামনে এসে দাড়িয়েছে!
আমি মনে মনে বললাম, শালার কি লাইফ! ওখানে থ্যাঙ্ক ইউ না দিলে মাইন্ড করে, আর এখানে আশ্চর্য হয়! কই যাই?
এদেশে এসেছিলাম শীতকালে। দেখতে দেখতে সামার এসে গেল। এদেশে প্রথম সামার। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, গরম যতো বাড়তে থাকলো, মেয়েদের শরীর থেকে কাপড় চোপড় তার চেয়েও দ্রুতগতিতে কমতে থাকলো। বুঝতে পারলাম, এ'দেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের গরম লাগে বেশী। একই সঙ্গে শংকিত হলাম, এই গতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে কি হবে চিন্তা করে! যাইহোক, সময় সবকিছুই ঠিক করে দেয়। এক পর্যায়ে এসবও চোখে সয়ে গেল। তবে, এতোকিছুর পরও, এই এখনও, এখানে কিছু মেয়ের নির্লজ্জতা দেখে আসলেই অবাক হই। অবাক হয়ে ভাবি, আমি একজন পুরুষ হয়ে যেখানে লজ্জা পাচ্ছি, এদের সেখানে এটা কোন ব্যাপারই মনে হচ্ছে না। সখেদে ভাবি, ও মনু.......কেমুন দ্যাশে আইলাম!!
আসলে এই কালচার শক নিয়ে অনেকদিন ধরেই কিছু লিখবো ভাবছিলাম। এ’ধরনের শক থেরাপীর মধ্য দিয়ে আমাকে বিভিন্ন সময়ে যেতে হয়েছে। অনেককিছু বলতে ইচ্ছা করে। আপনাদেরকে মাত্র তিনটা বিষয় বললাম। আপনাদের ভালো লাগলে আবার কোন একসময় হয়তো দ্বিতীয়পর্ব লিখতেও পারি। আর যদি ভালো না লাগে......জাস্ট ফরগেট ইট!!!

ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৯ রাত ৮:২৮