কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েই এই পোষ্টটা লিখছি। বিভ্রান্তিটা এসেছে বিভিন্নসময়ে বিভিন্ন পোষ্ট পড়ে; পোষ্টগুলোর মূল বক্তব্য আর আমার চিন্তা-ভাবনার যে ইনফারেন্স তার মধ্যকার অসামন্জস্যতা বা বৈপরিত্য থেকে। প্রত্যেকের ভাবনায় ভিন্নতা থাকতেই পারে, তবে সেটা যদি হয় কনসেপ্চুয়াল, তাহলে ভালো দেখায় না। ব্লগাররা হচ্ছে সমাজের প্রাগ্রসর একটা জনগোষ্ঠি। এরা কোন কিছুর আশা না করেই নিরপেক্ষভাবে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি, ভালো-মন্দ কিংবা উচিত-অনুচিতকে তুলে ধরতে সক্ষম। কাজেই এটা আশা করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না......এদের চিন্তা হবে সমাজের অন্য যে কোনও অংশের চেয়ে ভিন্নতর এবং উন্নততর।
বেশ কিছুদিন ধরেই আমি খেয়াল করছি, অনেকেই পোষ্ট দিচ্ছেন। বক্তব্যগুলো অনেকটা এরকম, আমরা জাতীগতভাবেই অসভ্য, অভদ্র, উচ্ছৃংখল, বর্বর, নোংরা একটা জাতী। যারা এমনটা ভাবছেন, তারা জানেন তারাও এই জাতীর-ই অংশ। তারপরও দিচ্ছেন। আমি উনাদের হতাশা বুঝতে পারি। কিন্তু ভূল জায়গায় ক্ষোভ উগড়ে দেয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত? এ'বিষয়ে আলোকপাত করাই আমার আজকের উদ্দেশ্য।
প্রথমেই আমার গতবছর দেয়া একটা পোষ্টের অংশ-বিশেষ তুলে ধরছি। দেখুন।
অনেকে বলেন, সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে সবকিছু ঠিকভাবে পরিচালিত করার; জনগনেরও তেমনি দায়িত্ব আছে নিয়ম-কানুন মেনে চলার। এই কথাটা অনেকাংশেই ভূল। সরকার এবং একমাত্র সরকারেরই দায়িত্ব জনগনকে একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা। শুধু আমরা বাংলাদেশীরা না, সব দেশের সব মানুষের মধ্যেই প্রবনতা আছে নিয়ম ভঙ্গ করার। নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য কোন শাস্তি যদি না থাকে, তাহলে মানুষ মাত্রই নিয়ম ভাঙবে। বৃটেনের রাস্তাঘাটে যত্রতত্র অসংখ্য ক্যামেরা আছে। প্রতিটা সিগন্যালে, পথচারী পারাপারের স্থানে, এখানে-সেখানে ক্যামেরা। এদেশের মানুষ যদি সভ্য-ভব্যই হবে, তাহলে এতো ক্যামেরা কেন? আপনি সিগন্যাল অমান্য করেছেন? ভূল জায়গায় গাড়ী পার্ক করেছেন? নির্ধারিত স্পীডের চেয়ে বেশী স্পীডে গাড়ী চালিয়েছেন? কিছুদিনের মধ্যে অবধারিতভাবেই আপনার ঠিকানায় জরিমানার চিঠি প্রমানসহ এসে যাবে। আপনার লাইসেন্স থেকে কিছু পয়েন্টও কাটা যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরও অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে, জরিমানা দেয়। তাহলে?
এদের সাথে আমাদের পার্থক্য এক জায়গাতেই। এখানে ধরা পড়লে আপনার রক্ষা নাই। শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। ঘুষ, ক্ষমতার বাহাদুরী কিংবা কোন ক্ষমতাশালীর ফোনকল; কোনকিছুই আপনাকে রক্ষা করবে না। এই যে সিস্টেম, এই সিস্টেমটাকে তৈরী এবং রক্ষনাবেক্ষন করে সরকার। জনগনকে বাধ্য করে এই সিস্টেম অনুযায়ী চলতে। জনগনও এই সিস্টেমে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষনিকের উত্তেজনা বা ভূলে কেউ যদিও বা এই সিস্টেমের বিপক্ষে কিছু করেই বসে, এমন শিক্ষাই পায় যে ভবিষ্যতে কিছু করার আগে দশবার চিন্তা করে। আর আমরা বাইরে থেকে এসে এসব দেখে ভাবি, আহা, কি সুশৃংখল আর সুসভ্য জাতী! এদিকে আমাদের তো সর্ষের মধ্যেই ভুত!! তাই আমরা বিশ্বে অসভ্য, উসৃংখল জাতী হিসাবে পরিচিত!!!
আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তখন আমি এখানে নতুন। একটা জরুরী কাজে লন্ডন যাবার ট্রেন ধরতে হবে। সময় নাই। নতুন একটা পার্কিং স্পটে গাড়ী রেখে দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম। সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখি ওখানে নোটিশ টাঙ্গানো, তিন ঘন্টার বেশী গাড়ী রাখা যাবে না। পরবর্তী তিনদিন ভয়ে ভয়ে থাকলাম কখন না জানি জরিমানার চিঠি আসে! না আসাতে ভাবলাম ব্যাটারা বোধহয় আমাকে ধরতে পারে নাই। ৫ম দিন চিঠি হাজির, আমার গাড়ীর কয়েকটা ছবিসহ। একসপ্তাহের মধ্যে দিলে ৫০ পাউন্ড জরিমানা। না দিলে এরপর প্রতি সপ্তাহে ১০ পাউন্ড করে বাড়তে থাকবে! পরদিনই টাকা ব্যাংকে জমা দিলাম। এই এক শিক্ষার কারনে আজ এতোগুলো বছর পার করলাম এই দেশে, আর একপয়সাও জরিমানা দেই নাই।
তাহলে আইনকে শক্ত হাতে প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব কার? সরকারেরই তো, নাকি? যেই দেশে সরকার ঠিক, সেই দেশে সবকিছুই ঠিক হতে বাধ্য।
দেশভিত্তিক আইনের অনেক উদাহরন দেয়া যায়। যারা বিভিন্ন দেশে থাকেন তারা সেসব দেশের আইন এবং তার প্রয়োগ সম্পর্কে অনেক ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু দু’টা দেশের উদাহরন টানছি। একটা সিঙ্গাপুর (কারন, এটা এশিয়ার একটা দেশ), আরেকটা বৃটেন (কারন, এখানে আমি থাকার কারনে সিস্টেমটা খুব কাছে থেকে দেখছি)।
সিঙ্গাপুরের কথায় আসি। মনে করেন, এখানে এসে রাস্তায় চলতে চলতে আপনার মুখে থু থু জমা হয়েছে। অভ্যাসের বশে একদলা থু থু ফেললেন রাস্তায়। যদি ধরা পড়েন, আপনাকে ১,০০০ সিঙ্গাপুর ডলার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৩,০০০) জরিমানা করা হবে এবং এটা দিতেই হবে। এখন মনে করেন, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে একটা জায়গায় জড়ো করা হলো এবং বলা হলো, যারা যারা সিঙ্গাপুরের রাস্তায় তেষট্টি হাজার টাকা দিয়ে থু থু ফেলতে চান, তারা হাত তোলেন। কয়টা হাত উঠবে বলে মনে করেন? একটাও না। আমি নিশ্চিত, এমন পাগল দেশে একটাও নাই।
এবার এই স্ক্রীনশটটা দেখুন। আমার মন্তব্য আর ব্লগার সায়েমুজজ্জামান এর উত্তর। উনার উদাহরন এই জন্য দিলাম কারন উনি এই সিঙ্গাপুর থেকেই 'উদ্ভাবন' বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। এই মন্তব্য এবং উত্তরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আশাকরি পোষ্টের বাকী অংশে দিতে পারবো।
ধুমপায়ীরা রাস্তায় ধুম্রপানের পরে সিগারেটের বাট (গোড়া) রাস্তাতেই ফেলেন। বৃটেনে এই কাজ করে যদি ধরা পড়েন তাহলে অন দ্য স্পট আপনাকে ৫০ থেকে ১৫০ পাউন্ড জরিমানা দিতে হবে। আর না দিলে এটা যদি কোর্ট পর্যন্ত যায়, তাহলে আপনাকে ১,০০০ পাউন্ড (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১,১১,০০০) বা ততোধিক (কোর্ট কর্তৃক নির্ধারিত) জরিমানা দিতে হবে। পুনরায়, একটা সিগারেটের জন্য এ অংকের জরিমানা দেয়ার মতো পাগলও দেশে নাই।
এমন শক্ত আইনের পরও মানুষ এখানে জরিমানা দেয়। বেশকিছু দিন আগে আমার এক কলীগ দেখি মুখ লম্বা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘটনা কি? ঘটনা হলো, আগের দিন সে এই অপকর্ম করে ৭০ পাউন্ড জরিমানা দিয়েছে।একটা চান্চল্যকর মামলার কথা বলি। ২০১৭ সালে ছবির এই মহিলাকে একই অপরাধে কোর্ট জরিমানা করে সর্বমোট ১,১৭২ পাউন্ড (১,৩০,০০০ টাকা)। এখন বলেন, এই রকমের বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের দেশের কেউ জেনেশুনে এই অপকর্ম করবে? আমার তো মনে হয়না।
এই মহিলা আর আমার কলীগ; দু’জনেই হোয়াইট ইংলিশ নারী-পুরুষ। এদের উদাহরন ইচ্ছা করেই দিলাম, না হলে কেউ কেউ আবার বলে ফেলতে পারেন, ওসব দেশে এ'ধরনের অপকর্ম যারা করে তারা স্থানীয় না; হয় ট্যুরিষ্ট, নয়তো অভিবাসী সেটলার।
এখন আসি, ব্লগার সায়েমুজজ্জামানের উত্তর প্রসঙ্গে। উনি একঅর্থে ঠিকই বলেছেন। শহরকে ময়লার ভাগাড় রাজনীতিবিদ না, আমরাই বানাই। তবে, আমরা যেন না বানাতে পারি সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রথমতঃ আইন-প্রণেতা তথা রাজনীতিবিদদের আর দ্বিতীয়তঃ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের; নাকি ভুল বললাম? প্রসঙ্গ এলো তাই বলি, বৃটেনে 'ফ্লাই টিপিং' বা যত্রতত্র ময়লা ফেলা একটা ভয়াবহ অপরাধ। বিশাল অংকের জরিমানা গুনতে হয় ধরা পড়লে। কাজেই নিতান্ত ইডিয়েট না হলে কেউ এ'কাজ করে না। ফলে শহরও পরিস্কার থাকে।
সিগারেটের বাট নিয়ে কিছু কথা বলেছি। আবার সে প্রসঙ্গে আসি। এতো ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে আইন প্রণেতারা মাথা কেন ঘামালেন? গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বছরে লন্ডনের রাস্তায় ষাট লক্ষ সিগারেটের বাট ফেলা হয়। এই বিপুল বর্জ্য পরিস্কার, পরিবেশের দূষণ, প্যাসিভ স্মোকিং এবং আনুসাঙ্গিক অন্যান্য বিষয় চিন্তা করেই এটাকে কঠোর হস্তে দমন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখন এই জনহিতকর চিন্তা এবং তা বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ, এটা কোন দেশে কবে জনগন নিয়েছে?
এভাবে, আমাদের দেশের প্রতিটা অনাগরিকসুলভ কাজের ব্যাখ্যা দেয়া যায়.....তবে মূল ব্যাপার কিন্তু ওই একটাই। এবার আসুন দেখি, আমাদের দেশে কি হয়।
আমাদেরও অনেক রকমের আইন আছে। প্রথম কথা হলো, এসব আইন ভঙ্গে যে জরিমানার বিধান আছে, তা সহনীয় মাত্রার। এগুলো জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলার জন্য যথেষ্ট না। কাজেই, মানুষ খুব একটা ভয়ও পায় না। আবার জরিমানা যদি করা হয়েই যায়, তাহলে যে জরিমানা করছে, তাকে কিছু দিয়ে 'খুশি' করা হয়। টাকাটা সরকার পর্যন্ত যায় না। এখন কেউ যদি লাফ দিয়ে উঠে বলেন, এই তো, দেখলেন? এই হচ্ছে আমাদের জনগন। তাহলে বলবো, জনগনের কথা তো অনেক বললাম। যে টাকাটা নিল, সে তো প্রশাসনের অংশ। তাহলে দায় কার? জনগনের নাকি প্রশাসনের? এক্ষেত্রে আবার উন্নত দেশের কথা বলতে হয়। এসব দেশের জনগন অপকর্ম করে ধরা পরলে অনুনয়-বিনয় বা ঘুষ অফার যে করে না তা কিন্তু না। করে, তবে আইনের বাস্তবায়নকারী জানে এসবকে প্রশ্রয় দিলে তার নিজেরই চাকুরী থাকবে না। তাছাড়া এদেরকে ঘুষ অফার করাও একটা অপরাধ। মোদ্দা কথা হলো, সিস্টেমটাকে জনকল্যানমুখি একটা অবস্থায় নিয়ে আসা। এরপরেও যদি আপনি বলেন, না, এখানে জনগনের দায়িত্ব আছে.......তাহলে আমার বলার আর কিছুই নাই।
সব দেশের মানুষই বিপদে পড়লে বাচার চেষ্টা করে। এটা মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। কথা হচ্ছে, উন্নত দেশের মানুষ চেষ্টা করেও পার পায় না, কাজেই একসময় তারা চেষ্টা করা বন্ধ করে দেয়, বরন্চ চেষ্টা করে অপকর্মটি না করতে। অন্য কথায়, একজন সভ্য মানুষে পরিনত হয়। আর আমাদের দেশের মানুষ যেহেতু জানে অপকর্ম করলে বাচার অনেক রাস্তা খোলা আছে, তাই তারা আগপিছ চিন্তা না করে বুক ফুলিয়ে অপকর্ম করতেই থাকে.......করতেই থাকে এবং একসময় তা অভ্যাসে পরিনত হয়। অন্য কথায় অসভ্যে পরিনত হয়। তাহলে জনগনকে অসভ্যে কে পরিনত করছে? জনতা সভ্য নাকি অসভ্য হবে, এটা নির্ধারনের দায়িত্ব কার?
সেই প্রাচীণকাল থেকেই সমাজে, গোষ্ঠিতে শৃংখলা ঠিক রাখার জন্য নেতা এবং সামাজিক কাঠামো ঠিক করা হতো। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের এই সরকার-ব্যবস্থা। আমাদের সবাইকে এই সরকার-ব্যবস্থা বা সিস্টেম এবং এর কার্যপরিধি বুঝতে হবে। এই সিস্টেমটা আগে ঠিক হবে নাকি জনগন আগে ঠিক হবে, এই বিতর্কটা সম্ভবতঃ 'ডিম আগে এসেছে, নাকি মুরগী আগে এসেছে' এই বিতর্ক থেকে সহজতর। আপনাদের মতামত কি?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:১৫