আজ থেকে প্রায় ৭/৮ বছর আগের কথা। আমি ডাক্তার দেখানোর জন্য জিপি (ডাক্তারখানা) তে বসে আছি। হন্তদন্ত হয়ে এক সৌম্যকান্তি বয়স্ক ভদ্রলোক ঢুকলেন। রিসেপশানে বসা মহিলার সাথে উনার কথোপকথনে বুঝলাম, সময় মতো না আসায় উনার এপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করা হয়েছে। ভদ্রলোকের উদভ্রান্ত চেহারা দেখে খারাপ লাগলো। রিসেপশানের মহিলাকে বললাম, তুমি আমার এপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে উনাকে দিয়ে দাও। আমি আরেকদিন আসবো। মহিলা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আর ইউ শিওর?? তারপরে আমার মহানুভবতায় সংক্রামিত হয়ে সেও মহানুভব হয়ে উঠলো। বললো, তুমি অপেক্ষা করো। তোমার তো বেশী সময় লাগবে না। এই ভদ্রলোকের পরই তোমার সিরিয়াল!!
আমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে দেখি উনি আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। সেই প্রথম আসিফ আহমেদ বাট সাহেবের সাথে আমার পরিচয়। উনি আমাকে এতোবার ধন্যবাদ দিতে লাগলেন যে, একপর্যায়ে আমার লজ্জাই লাগলো। উনাকে বললাম, এটাতো মুরুব্বীদেরকে সন্মান দেখানোর আমাদের সাব-কন্টিনেন্ট কালচার। এতো ধন্যবাদের কি আছে? আমার কোন কথাই শুনলেন না, আমাকে রীতিমতো বগলদাবা করে উনার দোকানে নিয়ে গেলেন 'কাহাবা/কাহাওয়া' (কাশ্মীরি চা) খাওয়ানোর জন্য।
আসিফ আহমেদ বাট (গত সপ্তাহে উনাকে নিয়ে লিখবো বলাতে উনি অনুমতি দিয়েছিলেন, তবে তা সংক্ষেপে এবং উনার ডিটেইলস গোপন রাখার শর্তে। তাই নাম, এলাকা সবই ভুয়া, শুধু ঘটনা জেনুইন), কাশ্মীর থেকে আগত এই সত্তুরের কাছাকাছি ভদ্রলোকের আমাদের শহরের টাউন সেন্টারে একটা কাশ্মীরি কার্পেট এবং হস্তশিল্পের দোকান আছে। ওই ঘটনার পর থেকে আমাদের সম্পর্কটা পোক্ত হতে হতে এখন এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, কোন উইকএন্ডে উনার দোকানে না গেলে উনি ফোনের পর ফোন করতে থাকেন। উনার ওখানে গেলে আবার আমার দু’টা লাভ। এক, স্পেশাল কাশ্মীরি চা আর স্ন্যাক্স। দুই, ঘন্টার পর ঘন্টা উর্দু/হিন্দিতে বাতচিতের প্র্যাকটিস; সেই সঙ্গে বোনাস... উনার সাহচর্য। এই ভাষায় আমার ফ্লুয়েন্সি এখন এতোটাই যে, মাঝে মাঝে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে উনি অনেকসময় দুষ্টামী করে আমাকে উনার এলাকার মানুষ বলে পরিচয় করিয়ে দেন। বাটসাহেব সবসময় একটা কথা বলেন, বাংলাদেশের মানুষদেরকে এমনিতেই সাধারন কাশ্মীরিরা পছন্দ করে; আর আমার কারনে উনার এই পছন্দ নাকি ডাবল হয়ে গিয়েছে।
যাইহোক আজাইরা প্যাচাল বাদ, মূল প্রসঙ্গে আসি। আপনাদেরকে আজ বাটসাহেবের বেদনাদায়ক কাশ্মীরি-জীবন সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে বলবো, যা আসলে, অন্যকথায়, কোন না কোন ভাবে সিংহভাগ কাশ্মীরির জীবনালেখ্য।
বাটসাহেবের জন্ম বর্তমানের ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলায়, ঝিলম নদীর পাড়ে উরী নামের একটা ছোট্ট শহরে। উনাদের ছিল স্বচ্ছল একটা যৌথ পরিবার। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের দু’বছর পরে একদিন রাতে ইন্ডিয়ান আর্মীর একদল সেনা হঠাৎ উনাদের শহরে তল্লাশীর নামে তান্ডব চালায়। ধরে নিয়ে যায় বড়চাচার বড় ছেলেকে, অন্য অনেকের মতো উনার সেই ভাই আর কোনদিন ফিরে আসেনি। তুলে নিয়ে যায় ১৮ বছর বয়েসী অবিবাহিত আরেক চাচাতো বোনকে। অনেক দেন-দরবারের পর প্রায় পাচ মাস বাদে সেই বোন বাড়ীতে ফিরে আসে... ...অন্তঃসত্ত্বা হয়ে। এ'ঘটনার পরে অনেক পারিবারিক আলোচনা আর যুক্তিতর্কের পর যৌথপরিবার ভেঙ্গে একটা অংশ চলে আসে পাকিস্তানের মুজাফফরাবাদের নওসাড্ডাতে। পিছনে রয়ে যায় দাদা-দাদীর স্মৃতি-বিজরিত উরী আর আরেক চাচার পরিবার। এভাবেই ভাগ হয়ে যান তারা। পরবর্তীতে '৭৪ সালের দিকে আসিফ আহমেদ বাট চলে আসেন ইংল্যান্ডে।
ভারতে উনাদের জান-মালের কোন নিরাপত্তাই ছিল না। পাকিস্তানে জান-মালের নিরাপত্তা তো ছিল, কিন্তু ছিল না কোন সন্মান। সেখানে অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গন্য করা হয় কাশ্মীরিদের, সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বাট সাহেবের কথায়, এখানে, ইংল্যান্ডে ভালো আছি কিন্তু একমুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারি না আদি ভিটা, দাদা-দাদীর স্মৃতি আর শৈশবের উরী। উরীর কথা বলতে গেলেই উনার চোখের কোনে টলমল করে পানি। উনার এখন একটাই স্বপ্ন, মৃত্যুর পর কবরটা যেন দাদা-দাদীর কবরের পাশে হয়, যদিও উনি জানেন এটা একটা কষ্ট-কল্পনা মাত্র।
''কাশ্মীর না পাকিস্তানের, না ভারতের; কাশ্মীর কাশ্মীরিদের'' এটা আমার কথা না। এটা বাটসাহেবের........... প্রতিটি কাশ্মীরির সিগনেচার প্রোক্লামেশান।
উনার গল্প শেষ, এবার কাশ্মীরের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ।
কাশ্মীরকে যদি একটা দেশ ধরি তাহলে এই দেশটা তিনটি দেশের দখলে। ভারত (জম্মু ও কাশ্মীর নামে পরিচিত, আয়তন ২,২২,২৩৬ বর্গকিলোমিটার), পাকিস্তান (আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত, আয়তন ১৩,২৯৭ বর্গকিলোমিটার), চীন (আকসাই চিন নামে পরিচিত, আয়তন ৩৭,২৪৪ বর্গকিলোমিটার)। এর মধ্যে আবার বানরের পিঠা ভাগের মতো ১৯৬৩ সালে করা এক চুক্তি অনুযায়ী পাক-চায়না প্রায় ২,০০০ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা নিজেদের মধ্যে অদল-বদলও করে।
যাইহোক, চীনের অংশটুকু নিয়ে ভারত-চীনের বিরোধিতা আছে ঠিকই, তবে সেটার সূত্রপাত অনেক পুরানো। সেটা ব্রিটিশ আমলের কথা। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার তৎকালীন সরকার কিংবা তৎকালীন চীনা সরকার, কেউ-ই এই সমস্যা সমাধানে খুব একটা তৎপরতা দেখায়নি। এটা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও খুব একটা আলোচিত বিষয় না।
কাশ্মীর লাইমলাইটে চলে আসে মূলতঃ ভারত ভাগের পর। ব্রিটিশরা তাড়াহুড়া করে ভারত ত্যাগের আগে যে বিভক্তিরেখা টানে, তা অনেক এলাকাতেই উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তাদের পুতে যাওয়া এমনই একটি সমস্যার বীজ কাশ্মীর আজ বিশাল মহিরুহের আকার ধারন করেছে। এই কাশ্মীর নিয়ে ইতোমধ্যে তিন-তিনটা পাক-ভারত যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে; আরো যে হবে না তার কোন গ্যারান্টিও নাই। বিস্তারিত ইতিহাসে যাবো না, এটা আগ্রহীরা সবাই জানেন, কিংবা জেনে নেয়া কোন ব্যাপার না। আমি আলোকপাত করতে চাই একটু ভিন্নভাবে।
এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে ভারতে, অত্যাচার-জুলুম-নির্যাতন চলছে ভারতে। পাকিস্তানে কিন্তু এর কোনটার কথাই শোনা যায় না। কাজেই ধরে নেয়া যায় পাকিস্তানে কাশ্মীরিরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছে। বাটসাহেবের অভিজ্ঞতাও সেই কথাই বলে। আজ যদি পাকিস্তান বলে যে, আমরা কাশ্মীরের দাবী ছেড়ে দিলাম; কাশ্মীর আলাদা দেশ হলে আমাদের কোনও আপত্তি নাই। আর ভারতও যদি বলে তবে তাই হোক, কাশ্মীরের ভবিষ্যত কাশ্মীরিরাই নির্ধারন করুক, তাহলে কেমন হয়? জাতীসংঘের অধীনে একটা রেফারেন্ডাম দিয়ে দিক না! পাকিস্তানের কথা বাদ, এতে ভারতের কি লাভ?
ভারত তাদের সামরিক খাতে যে বিশাল অর্থ ব্যয় করে তার একটা বড় অংশ করে মূলতঃ পাকিস্তানকে চাপে রাখার কৌশলের অংশ হিসাবে। উদাহরন হিসাবে তাদের খরচের ধারনা পেতে এই লিঙ্কটা (view this link) দেখতে পারেন।
ভারত কোন ধনী দেশ না, একটা নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ যারা এমনকি সবার জন্য টয়লেট সুবিধাও দিতে পারে না। তেমন একটা দেশের এই বিশাল ব্যয় কমানো যায় কাশ্মীরকে ছেড়ে দিয়ে। কাশ্মীর না থাকলে ভারতের এই বিশাল সামরিক ব্যয়ের দরকার কি? ভারতের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত ৩,৩২৩ কিলোমিটার। কাশ্মীর বাদে সেটা ২,২৪০ কিলোমিটার। কাশ্মীর ছেড়ে দিলে এই ১,০৮৩ কিলোমিটার সীমান্ত রক্ষার খরচ কমে যাবে আশাতীতভাবে। তাছাড়া প্রতিবেশীর সাথে মূল বিরোধের জায়গাই যদি না থাকে তো বাকী সীমান্তও হবে স্বাভাবিক, খরচও কমে যাবে স্বাভাবিকভাবেই। আচ্ছা টাকার হিসাব বাদ, বছর বছর ভারত তাদের যে পরিমান সৈন্য হারায়, মুল্যবান জীবন নষ্ট হয়, তার অবসান ঘটবে। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে শান্তি ফিরে আসবে সেটাও হিসাব থেকে বাদ যাবে কেন? অন্যদিকে ফোকাস করার সুযোগ তৈরী হবে ভারতের, তাতে করে এই অন্চল হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের একটা অন্যতম নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। এতো লাভ বাদ দিয়ে ভারত কোন বুদ্ধিতে কাশ্মীর নামের একটা অলাভজনক, ধ্বংসাত্মক প্রজেক্টে বিনিয়োগ করছে এটা বোঝা সত্যিই কঠিন! শুধুই ইগো? অলাভজনক ইগো ভালো নাকি সবার জন্য টয়লেট ভালো?
কাশ্মীর থেকে আসলেই কি ভারত কিছু পায়? ঝামেলা, মৃত্যু আর ধ্বংস ছাড়া?
শেষ কথাঃ
আজ থেকে অনেক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্টাডি ট্যুরের অংশ হিসাবে কাশ্মীর গিয়েছিলাম। তখন বয়সে তরুণ ছিলাম। অনেক কিছু বুঝতাম, আবার অনেক কিছুই হয়তো বুঝতাম না। তবে কাশ্মীরে গিয়ে বুঝেছিলাম, এই ভূমিকে কেন ভূ-স্বর্গ বলে।
এই স্বর্গকে যারা নরকে পরিনত করেছে, তারা যারাই হোক, যে দেশেরই হোক; তাদের উপর অভিশাপ!
অভিশাপ তাদের পক্ষ থেকে যারা এই ভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রামে জীবন দিয়েছে!!
অভিশাপ তাদের পক্ষ থেকে যারা তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে!!!
আর অভিশাপ সেইসব মায়েদের পক্ষ থেকে যারা তাদের সন্তান হারিয়েছে!!!!
এই অভিশাপের আগুনে অভিশপ্তদের পুড়িয়েই আবার একদিন স্বর্গে পরিনত হবে এই ভূমি। এটা এখন শুধুই সময়ের দাবী।
অশুভ শক্তির শুভবুদ্ধির উদয় হোক............. যতোটা দ্রুত সম্ভব।।
ছবিঃ নেট থেকে নেয়া।