ব্লগে যারা আমাকে মোটামুটি চিনেন, তারা অনেকেই জানেন যে, আমি কবিতা পড়ি না। অথচ ব্লগে আমার পছন্দের যেসব ব্লগার আছেন, তারা অনেকেই কবিতা লিখেন। তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্বেও তাদের কবিতা আমি পড়ি না। মন্তব্যও করি না। কিন্তু কেন? আসলে এটাকে একটা অসুখ বলতে পারেন, একটা মানসিক রোগ। অসুখটার নাম হলো ''কাব্যফোবিয়া''। কবে থেকে, কেন এবং কিভাবে আমি এই অসুখে আক্রান্ত হলাম; সেই কাহিনীই আপনাদের বলবো আজ।
কলেজে পড়ার সময় থেকেই টুকটাক লিখতাম। দু’একটা পত্রিকায় কদাচিৎ ছাপাও হয়েছে আমার লেখা। তবে সেগুলো কবিতা ছিল না। ঢাবিতে পড়ার সময় আমার একজন প্রেমিকা ছিল। সে ঢাবি-র কোন এক হলে থাকতো এবং আমার লেখালেখির ব্যাপারটা জানতো। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমার লেখা পড়ে দেখা বা সে ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখানোর ব্যাপারে তার কার্পন্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সত্যি বলতে একাডেমিক বই ছাড়া অন্য কোন বই সে খুব একটা পড়তো না, শুধুমাত্র প্রতিবছর বইমেলা থেকে যে বইগুলো আমি কিনতাম সেগুলো ছাড়া!
এ ব্যাপারে আমার একটু অভিমান থাকলেও দার্শনিকের মতো চিন্তা করতাম, থাকগে। এই দুনিয়ায় সবাইকে দিয়া সবকিছু হবে বা হতে হবে এমন কোন কথা নাই। তবে এটা ঠিক, বই কিংবা কাব্য আলোচনা ছাড়াই আমাদের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল। তবে বিপত্তি বাধলো একদিন!
ওদের হলে কি একটা দিবসে যেন, একটা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হবে। সেখানে সে আমাকে না জানিয়েই স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির ইভেন্টে নাম দিয়ে ফেললো এবং অবধারিতভাবেই কবিতা লেখার দায়িত্ব অবলীলায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল। আমার তীব্র প্রতিবাদেও কোন কাজ হলো না। উল্টো জানিয়ে দিল, ওর জন্য কবিতা লেখার মতো একটা ছোটখাটো কাজও যদি আমাকে দিয়ে না হয়, তাহলে কিসের ভালোবাসা? না পারলে আমি যেন ভবিষ্যতে ওর মুখ-দর্শন আর না করি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল আরকি!
হাতে সময় খুব কম। পরবর্তী তিনটা দিন আমার কামরায় নিজেকে বন্দী করে ফেললাম। যাই লেখি, পছন্দ হয় না। ঘুমের মধ্যে বাংলা অক্ষরগুলো আমাকে তাড়া করে, বিভিন্ন অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে, ভয় দেখায়। কবিতার প্রতি একটা চরম অভক্তি এসে গেল। তিনদিন পর যখন দু’টা কবিতা লিখে রুম থেকে বের হলাম, আম্মা বললো, কিরে, তোর চেহারার একি হাল! রুমের দরজা বন্ধ করে গাজা খাস নাকি?? আম্মার কথা শুনে আয়নায় নিজেকে দেখে আতকে উঠলাম। চোখ লাল, উস্কো-খুস্কো চুল, খোচা খোচা দাড়ি! সে যাই হোক, হাতে সময় নাই। সেইদিনই ওদের সেই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা! কবিতা দিতে গেলাম। ওর লোলুপ দৃষ্টি আমার হাতের কাগজের দিকে। এনেছো? বলে ছো দিয়ে কবিতা দু’টো নিয়ে হলে ঢুকে গেল। যাবার আগে বললো, যাই, হাতে সময় নাই। রিহার্সাল দিতে হবে না! একবার আমার দিকে তাকানো বা কোনরকমের সহানুভূতিমূলক কথার ধারে-কাছে দিয়েও গেল না।
কবিতার ভুত মাথা থেকে নেমে যাওয়াতে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। খুশিতে নীলক্ষেতে গিয়ে ভরপেট মোরগ পোলাউ খেয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে ফোনে জানালেন, স্বরচিত কবিতা পাঠের ইভেন্টে উনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছেন। হলের প্রভোষ্ট পুরস্কার দেয়ার সময় অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, তুমি যে এতো ভালো কবিতা লেখ তাতো জানতাম না!!!
এরপরের কয়েকটা বছর ছিল কবিতার নামে আমার উপর অত্যাচারের বছর! হলের বা ডিপার্টমেন্টের বাৎসরিক স্মরনীকার জন্য কবিতা, দেয়াল পত্রিকার জন্য কবিতা, অমুকের জন্মদিনের জন্য কবিতা... ...হেন-র জন্য কবিতা, তেন-র জন্য কবিতা। কবিতা আমার জন্য হয়ে গেল এক মুর্তিমান আতঙ্কের নাম!
যাইহোক, কবিতা লিখতে লিখতে ততোদিনে নিজেকে কবি ভাবা শুরু করে দিয়েছি। একদিন আমাদের ঢাবি-র এক কবি বড়ভাইকে কয়েকটা কবিতা পড়তে দিলাম। উদ্দেশ্য উনার কাছ থেকে কিছু প্রশংসা বাক্য শ্রবন এবং উচ্চতর কবিত্ব অর্জনের জন্য দিক-নির্দেশনা নেয়া। কবিতা পড়ে উনি বললেন, এই কবিতাগুলো তো মনে হয় আগে কোথাও পড়েছি! উনার তুখোড় স্মৃতিশক্তির প্রশংসা আগে অনেক শুনেছি। সেটাকে সত্য প্রমান করার জন্যই যেন উনি বলে উঠলেন, মনে পড়েছে। এগুলো অমুক ডিপার্টমেন্টের তমুক মেয়ের কবিতা না! তুই তো দেখি মহা হারামী, লজ্জা-শরমের কোন বালাই নাই!! একটা মেয়ের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছিস!!! কবিদের অপমান! এইবার দ্যাখ তোরে আমি কেমন দৌড়ের উপরে রাখি।
এরপর আমার উপর যেই নতুন মাত্রার অত্যাচারের সূচনা হয়েছিল সেটার বর্ণনা দিয়ে আপনাদের বিরক্তি আরো বাড়াতে চাই না। শুধু এটুকুই বলি, কবিতার নাম শুনলেই তখন আমার চোখ লাল হয়ে যেতো, বন্য পশুর মতো দাত বের হয়ে পড়তো......... আর চেহারায় একধরনের হিংস্রতা ভর করতো। পরবর্তী উপসর্গ ছিল, কবিতা দেখলে মাথা ঘোড়ানো, বমি বমি ভাব হওয়া, আর চোখে-মুখে অন্ধকার দেখা। কাজেই কবিতার শব্দগুলো ঠিকমতো আর দেখতে পেতাম না, বোঝা তো অনেক দুরের কথা। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখন আমি কিছুটা ভালো। তবে উপসর্গগুলো এখনো অল্পমাত্রায় আছে, আর এর সাথে একটা নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে....... তা হলো শরীর ঘেমে যাওয়া।
এখন বলেন, কবিতা ঠিকমতো না পড়ে, না বুঝে যদি আৎকা একটা হাস্যকর মন্তব্য করি; লাইক দেই, তাহলে কি আমার প্রিয় ব্লগারদের সাথে প্রতারণা করা হয় না! এতোগুলো প্রিয় মানুষের সাথে এই প্রতারণা আমি কিভাবে করি?
তাই বলি, আমার মতো এমন একজন অভাগার প্রয়োজন কি? প্রিয় কবি ভাই ও বোনেরা, আপনারা এগিয়ে যান। আমি সাথে না থাকলেও আমার দোয়া এবং আশির্বাদ আপনাদের সাথে আছে।
ছবিঃ নেট থেকে ধার করা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:২৫