১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন বিভিন্ন সেক্টরে পুরোদমে চলছে। সে সময়ে মুজিবনগর সরকার বিভিন্ন স্থানে ফিল্ড পোষ্ট অফিস স্থাপন করে, মুক্তান্চলের তৎকালীন পোষ্ট অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে এবং এগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করে পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের উপর। সে সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কোন নিজস্ব ডাকটিকেট ছিল না। পাকিস্তানের বিভিন্ন ডাকটিকেটের উপর ইংরেজি ও বাংলায় 'বাংলাদেশ' সিল মেরে কাজ চালানো হচ্ছিল।
এই পটভূমিকায় বৃটিশ সাংসদ এবং সাবেক পোস্ট মাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউজ শরনার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখা এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন আলোচনার জন্য কয়েকবার মুজিবনগরে আসেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন বৃটিশ রাজনীতিবিদদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সেসময়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করছে পুরোপুরিভাবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথে বিভিন্ন আলোচনার একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের ডাকটিকেট বের করার। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব-জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ এবং তহবিল সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। আলোচনার সিদ্ধান্ত মোতাবেক, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মি. স্টোনহাউজের সহায়তা কামনা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি জুন মাসে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় ডাকটিকেট ডিজাইনার বিমান মল্লিককে ড. এনামুল হকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ড. হক যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের কালচারাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন এবং তিনি মুজিবনগর সরকারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিয়াজো রক্ষা করতেন।
দায়িত্ব পেয়ে বিমানবাবু ৮টি ডাকটিকেটের ডিজাইন করেন এবং সেই জুনেই তা ড. হকের মাধ্যমে মুজিবনগরে প্রেরন করেন অনুমোদনের জন্য। ওদিকে মি. স্টোনহাউজ লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসকে রাজি করান ডাকটিকেটগুলো তাদের খরচে প্রিন্ট করানোর জন্য। ঠিক হয়, প্রিন্টিং প্রেস ডাকটিকেটগুলো প্রিন্ট, ডিস্ট্রিবিউট এবং বিক্রয় করবে এবং যাবতীয় হিসাব মুজিবনগর সরকারের কাছে পেশ করবে। আর মি. স্টোনহাউজ দায়িত্ব নেন ডাকটিকেটগুলো সংগ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয় করার, বিশেষ করে ইউরোপে।
অবশেষে ১৯৭১ এর ২৯শে জুলাই সেই মাহেন্দ্রক্ষন এলো। মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশের জন্য সেটা ছিল একটা বিশেষ দিন। ৮টি ডাকটিকেট একযোগে কোলকাতা এবং লন্ডনের বাংলাদেশ মিশন থেকে অবমুক্ত করা হয়। একইসঙ্গে দু’জায়গা থেকেই একই ডিজাইনের কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রং এর দু’টি অফিসিয়াল First Day Cover ও অবমুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব হোসেন আলী কোলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে ডাকটিকেটগুলো অবমুক্ত করেন। অন্যদিকে লন্ডনে বৃটিশ সংসদের হাউজ অফ কমন্সের হারকোর্ট রুমে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে সাংসদ জন স্টোনহাউজ, সাংসদ পিটার শোর, মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বৃটিশ সংসদের একটি ভবনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল একটা নজীরবিহীন ঘটনা, কারন, একটি দেশের স্বাধীনতার সমর্থনে এমন বেসরকারী সভা বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবনে অতীতে আর কখনও হয়নি। পরবর্তীতে সাংসদ জন স্টোনহাউজের কার্যকর সহযোগিতায় লন্ডনে এই ডাকটিকেটগুলোর নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এই ডাকটিকেটগুলো বাংলাদেশ বিষয়ক প্রচারণায় অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাহায্য করে বাংলাদেশকে চিনতে।
লক্ষ্যনীয় যে, এই ৮টি ডাকটিকেটে বাংলাদেশকে 'বাংলা' এবং 'দেশ' এই দু’টি আলাদা শব্দে লিখা হয়। এগুলোর মুদ্রামান ছিল রুপি। এগুলোই বাংলাদেশের প্রথম ডেফিনিটিভ ডাকটিকেট। সে সময়ে বৃটিশ জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এই খবর গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয়। টাইমস এবং মিররে ছাপা হওয়া নীচের ছবি দু’টি বিমান মল্লিক বাবুর ওয়েবসাইট থেকে দিলাম।
বিজয় অর্জনের পর ১৯৭১ এর ২০শে ডিসেম্বর এই ৮টি ডাকটিকেটকে আবার ঢাকা জিপিও থেকে অবমুক্ত করা হয়। এগুলোতে ইংরেজি এবং বাংলায় ওভারপ্রিন্ট করা হয়, 'Bangladesh Liberated' এবং 'বাংলাদেশের মুক্তি'। কিন্তু জিপিও বিক্রির জন্য শুধুমাত্র ৩টি মুল্যমানের ডাকটিকেটের সরবরাহ পায় (Rs.10, Rs.5 এবং 10p)। ফলে এই ৩টি ডাকটিকেটই হলো বাংলাদেশের প্রথম commemorative stamp বা স্মারক ডাকটিকেট। বাকী ৫টিকে পরবর্তীতে নন-ইস্যু হিসাবে গন্য করা হয়।
পরবর্তীতে ইওরোপ এবং আমেরিকার ফিলাটেলিক মার্কেটে আরও ১৫টি ডাকটিকেটের (পূর্ববর্তী ৮টি ডিজাইনের ৩টি, বিভিন্ন মুল্যমানের) বিক্রয় শুরু হয়। বাংলাদেশের ডাকবিভাগ এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে এবং এগুলোও নন-ইস্যু হিসাবে গন্য হয়। এই ডাকটিকেটগুলোতে 'বাংলা' এবং 'দেশ' এই দু’টি আলাদা শব্দে না লিখে বর্তমানের মতো একসাথে লিখা হয়, আর মুদ্রামান ছিল রুপির বদলে টাকা; তবে সেটা Tk. না লিখে শুধু T লিখা হয়।
প্রচলিত ধারনা এই যে, এগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডেফিনিটিভ ডাকটিকেট হিসাবে ১৯৭২ এর ১লা ফেব্রুয়ারী অবমুক্ত করার কথা ছিল, কিন্তু অজানা কারনে তা আর হয়ে উঠেনি। এটাও ধারনা করা হয় যে, এই অজানা কারনের পিছনের কারন ছিল বৃটিশ সাংসদ জন স্টোনহাউজ, যিনি পরবর্তীতে একজন প্রচন্ড বিতর্কিত ব্যক্তিত্বে পরিনত হন; সেটা আরেক কাহিনী।
বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব ডাকটিকেট থাকার পরও অবশ্য সরকার ১৯৭৩ এর এপ্রিল পর্যন্ত 'বাংলাদেশ' সিল দেয়া পাকিস্তানী ডাকটিকেটের ব্যবহারও অব্যাহত রাখে। ২৯শে এপ্রিল এক আদেশের মাধ্যমে এর ব্যবহার বন্ধ করা হয়।
এ পর্যায়ে আপনাদেরকে দু’টা ইন্টারেস্টিং তথ্য দেই।
প্রথমতঃ ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান যেসব ডাকটিকেট ছাপায় সেগুলোতে 'পাকিস্তান' শুধুমাত্র উর্দু এবং ইংরেজীতে লিখা হতো। ১৯৫৬ সালের ১৫ই আগষ্ট প্রথম বাংলায় 'পাকিস্তান' লিখা ডাকটিকেট বের করে। অনুমান করি, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ফলে তারা এটা করতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরও ১৯৭২ এর নভেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় এক বৎসরকাল তারা তাদের ডাকটিকেটে বাংলায় 'পাকিস্তান' লিখা অব্যাহত রাখে। কেন? তৎকালীন পাকি শাসকদের কি আশা ছিল যে বাংলাদেশ আবার তাদের সাথে একীভূত হবে? স্টোনহেন্জের মতো এটাও একটা অমিমাংসিত রহস্য। আপনাদের কি মনে হয়? নীচের ডাকটিকেটটা ১৯৭২ এর ২৮শে নভেম্বর অবমুক্ত করা হয়। এটাই বাংলায় 'পাকিস্তান' লিখা পাকিদের শেষ ডাকটিকেট। এরপর হতাশ হয়েই সম্ভবতঃ তারা বাংলায় পাকিস্তান লিখা বন্ধ করে!
১৯৭১ এর ২৯শে জুলাই এই ডাকটিকেটগুলোর অবমুক্তির দিনকে স্মরনীয় করে রাখতে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৯শে জুলাইকে 'ডাকটিকেট দিবস' হিসাবে পালন করা হয়। এই দিনে নতুন ডাকটিকেট, First Day Cover এবং স্যুভেনির শীট অবমুক্ত করা হয়। ২০০৮ সালে এমনিভাবে অবমুক্ত করা একটি স্যুভেনির শীট দেখুন।
সবশেষে আবার ফিরে আসি প্রথম ডাকটিকেটগুলোর প্রসঙ্গে। এই ডাকটিকেটগুলোর একটা বিশাল রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ছিল। উদাহরন স্বরুপ উল্লেখ করা যায়, নিউইয়র্ক টাইমসের সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় এই ডাকটিকেটগুলো এবং বাংলাদেশ নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখা হয়। এমনিভাবে এই ৮টি ছোট্ট রঙ্গীন কাগজের টুকরোর মাধ্যমে বিশ্ব-মন্চে এই বার্তা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটা নবীন রাস্ট্রের অভ্যুদ্য় হয়েছে এবং তা একটা যথাযথ সরকার দ্বারা কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এই বার্তা পরবর্তীতে নবীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভেও বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
শেষকথা: এই লেখাটা আমার ব্লগ জীবনের একেবারে প্রথম দিককার লেখা। বহুদিন পর গত সপ্তাহে হঠাৎ করে পড়লাম। পড়ে খুব একটা মনপূতঃ হলো না। মনে হলো, এটাকে আরও তথ্য দিয়ে আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। তাই অনেক ঘষামাজা করে, অনেকটা নতুনের মতো করে আবার পোষ্ট করলাম। কতোটুকু কি হলো জানিনা।
মাসটা আমাদের প্রাণের মাস, বিজয়ের মাস। যাদের ত্যাগের মাধ্যমে আমরা এই বিজয় পেয়েছি, যাদের কারনে আমরা একটা স্বাধীন দেশে নিঃশ্বাস নিতে পারি, যাদের কারনে আমরা বিদেশে মাথা উচু করে বলতে পারি.. .. ..আমরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক; সেই মহান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আমার এই ক্ষুদ্র অর্ঘ্য নিবেদন করলাম, উৎসর্গ করলাম। জানি, সেই বিশাল ত্যাগের তুলনায় এটা একেবারেই নগন্য, তবু এতোটুকুই পারলাম। অতি নগন্য একজন আমি’র যে এতোটুকুই ক্ষমতা!!!
সকল মুক্তিযোদ্ধাকে এই মহান বিজয় দিবসে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।
তথ্যসূত্র: Click This Link বিমান মল্লিক বাবুর ওয়েবসাইট এবং বিবিধ ওয়েবসাইট।
ছবিসূত্র: বিমান মল্লিক বাবুর ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট এবং আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:১৫