ভূমিকাঃ আমার ইচ্ছা পূরণের গল্পে স্টোনহেন্জ এসেছিল গল্পের প্রয়োজনে। সেই গল্পে মন্তব্য করতে গিয়ে আমার দুই প্রিয় ব্লগার, করুণাধারা এবং জুন, বলেছিলেন স্টোনহেন্জ নিয়ে বিস্তারিত লিখতে। আমিও বলেছিলাম, লিখবো। লিখার এই ইচ্ছাটা নিয়েই দু’মাস পার করলাম এবং অবশেষে লিখতে পারলাম। আমার মতো অভাজনের লেখা পড়ার জন্য ওনাদের আগ্রহের কারনেই এটা সম্ভব হলো। সেজন্যে কৃতজ্ঞতা। আর সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই এই পোষ্টটা উনাদের দু’জনকে উৎসর্গ করলাম।
আরেকটা কথা। ঘটনাক্রমে এটা সামুতে আমার পন্চাশতম পোষ্ট। দেখতে দেখতে হাফ সেন্চুরী করে ফেললাম! সময় কিভাবে চলে যায়, তাই না!!!
গ্রেট বৃটেন বা ইউনাইটেড কিংডমের অন্তর্ভুক্ত চারটা রাজ্যের একটা হলো ইংল্যান্ড। এই ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ার কাউন্টির এ্যামেসব্যারী শহরের কাছেই স্টোনহেন্জ এর অবস্থান। এটা একটা প্রি-হিসটোরিক মনুমেন্ট। পুরাতত্ববিদদের বিচার-বিশ্লেষণ এবং রেডিও-কার্বন ডেটিং অনুযায়ী বলা যায়, মনুমেন্টটা যীশুখৃষ্টের জন্মেরও আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে স্থাপন করা হয়েছিল।
১৫৭৩ সালে লুকাস ডি হেরের জলরং এ আকা। এটাই এখন পর্যন্ত পাওয়া স্টোনহেন্জের সবচাইতে পুরানো ছবি।
এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সময়কার মানুষ কেন এই মনুমেন্টটা তৈরী করেছিল? সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতে যাওয়ার আগে চলুন এর খুটিনাটি একটু সংক্ষেপে জেনে নেই।
মনুমেন্টটার তৈরী শুরু হয় যীশুখৃষ্টের জন্মেরও আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে, আর শেষ হয় যীশুখৃষ্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগে; অর্থাৎ এর নির্মান ব্যাপ্তি প্রায় দেড় হাজার বছর। এটি তিনটি ধাপে তৈরী করা হয় যার তৃতীয় ধাপটি আবার পাচ ভাগে বিভক্ত। বৃত্তাকার এই মনুমেন্টটা অনেকগুলো আনুভুমিক এবং লম্বালম্বি পাথরের সমন্বয়ে তৈরী, যার একেকটির ওজন এমনকি ২৫ টনেরও বেশী। প্রতিটা পাথরই প্রায় ১৩ ফুট উচু, আর ৭ ফুট চওড়া যা মূলতঃ দুর থেকে দৃশ্যমান। এ ছাড়াও আরো তুলনামূলক ছোট আর কম ওজনের পাথরও ব্যবহার করা হয়েছে এর নির্মানকাজে। স্টোনহেন্জ নির্মানে প্রধানতঃ দুই ধরনের পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। বড় পাথরগুলো স্যান্ডস্টোন, যা স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য। আর তুলনামূলক ছোট পাথরগুলো হলো ব্লুস্টোন, যেগুলো ১৪০ মাইল দুরে ওয়েলস থেকে নিয়ে আসা হয়। এই ব্লুস্টোনের একটা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য আছে, একটু পরে বলছি। স্টোনহেন্জকে ব্রিটিশ কালচারাল আইকন হিসাবে দেখা হয়। ইউনেস্কো ১৯৮৬ সালে এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রাথমিকভাবে স্টোনহেন্জকে একটা কবরস্থান হিসাবেই কল্পনা করা হয়। এখানে খননকাজ চলাকালীন সময়ে মানুষের যেসব হাড়-গোড় পাওয়া গিয়েছে, রেডিও-কার্বন ডেটিং অনুযায়ী সেগুলো যীশুখৃষ্টের জন্মেরও আনুমানিক তিন হাজার বছর আগের। অর্থাৎ স্টোনহেন্জ এর বয়স আর হাড়-গোড়ের বয়স সমসাময়িক। হতে পারে এগুলো তৈরীকালীন সময়ে যে সকল শ্রমিক মারা গিয়েছিল তাদের দেহাবশেষ অথবা আনুষ্ঠানিকভাবে সমাহিতদের দেহাবশেষ।
আরেকটা প্রচলিত ধারনা হচ্ছে, এটা জ্যোতির্বিদ্যা কাজে ব্যবহৃত একটা মান মন্দির জাতীয় কিছু। এই ধারনার কারন হলো এর কেন্দ্রে পাচটি দৈত্যাকৃতি পাথরের সমাহার, যা কিনা একটি ঘোড়ার ক্ষুর (হর্স স্যু) এর আকৃতি দিয়েছে। এই ক্ষুরের এক বাহু শীতকালের সবচেয়ে বড় রাত আর অন্য বাহু গ্রীষ্মের সবচেয়ে বড় দিনকে নির্দেশ করে। এছাড়া এর কাঠামোকে মহাকাশ ও গ্রহানু পর্যবেক্ষণ, চন্দ্র-সূর্য গ্রহনসহ অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞান কাজের সাথে সম্পর্কিত করা যায়।
কোন কোন বিশেষজ্ঞ অবশ্য এটাকে নিছক একটি উপাসনাস্থল হিসাবে দেখতে চান।
বর্তমানকালের দুই খ্যাতনামা বৃটিশ অধ্যাপকের মতে স্টোনহেন্জ ছিল একটা রোগ নিরাময় বা উপশম কেন্দ্রবিশেষ। সোজা কথায় ক্লিনিক বা হাসপাতাল। তারা এর সপক্ষে কিছু যুক্তি ও প্রমানও হাজির করেছেন। যেমন, আশেপাশের বেশকিছু কবরে ট্রমা ডিফরমিটি বা আঘাত বা দুর্ঘটনাজনিত কারনে হাড়ের যে বিকৃতি ঘটে তার নমুনা মিলেছে। তাছাড়া, আইসোটপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইনারা দেখিয়েছেন যে ওখানে দুর-দুরান্ত থেকে যেমন জার্মানী, ফ্রান্স এমনকি ভু-মধ্যসাগরীয় অন্চল থেকে আগত মানুষের দেহাবশেষ মিলেছে। উনারা উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, চিকিৎসার জন্যই তারা সম্ভবতঃ এখানে এসেছিল।
এবার আসি ব্লুস্টোনের বৈশিষ্ট্যে। লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টের গবেষকরা প্রমান করেছেন যে, এই ব্লুস্টোনে আঘাত করা হলে এরা এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ বা সুর তৈরী করে। 'লিথোফোন' হচ্ছে পাথরের তৈরী এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র বিশেষ, মজার ব্যাপার হলো ব্লুস্টোন সে ধরনেরই এক পাথর। অনেক প্রাচীন সভ্যতাতেই এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, সঙ্গীত রোগ নিরাময় বা উপশমে ভূমিকা রাখে। এখান থেকেই বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা আর্কিওলজিস্ট টিমোথি ডারভিলের ধারনা স্টোনহেন্জ সম্ভবতঃ রোগ নিরাময় বা উপশম কেন্দ্র হিসাবেও ব্যবহৃত হতো।
কম্পিউটার সিমুলেশানে আকা সম্পূর্ণ স্টোনহেন্জ
সবশেষে আরেক বিশেষজ্ঞ, ভুয়া মফিজের মতামত হচ্ছে, উপরের সবগুলো হাইপোথিসিসই সঠিক। কারন, প্রাচীন সব স্থাপনাই কম-বেশী ধর্মীয় কাজ অর্থাৎ দেব-দেবীর আরাধনার সাথেই সম্পর্কিত। কাজেই এটা একটা ধর্মীয় স্থাপনা; নয়তো কার বা কাদের এতো ঠ্যাকা পড়েছে যে হাজার বছর ধরে এটা তৈরী করবে!! দেব-দেবীদের আবাসস্থল যেহেতু উর্ধাকাশে, কাজেই এখান থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা যেতেই পারে। ধর্মীয় স্থাপনাকে দুস্থ-অসুস্থ-পীড়িত মানব সেবার কেন্দ্র হিসাবে কল্পনা করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না। আর অসুস্থ মানুষ মারা গেলে তাকে দুরে নেয়ার চাইতে আশেপাশেই কবর দেয়া কি যুক্তিযুক্ত না? হাজার বছর ধরে, এতো কষ্ট করে যা তৈরী করা হলো তাকে যদি একটা মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স হিসাবে কল্পনা করি তাহলেই তো কেল্লাফতে! সবাই ঠিক, সবাই খুশি। একেবারে উইন উইন সিচ্যুয়েশান...কি বলেন?
স্টোনহেন্জ কিভাবে তৈরী করা হয়েছিল, সেদিকে আর না যাই। এ ধরনের যতোগুলো প্রাচীন স্থাপনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তার সবগুলোর সাথেই জড়িয়ে আছে অনেক অনেক মিথ, অনুমান আর বিভিন্ন রকমের 'উপসংহারে না আসতে পারা' বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা; যার মধ্যে অবধারিতভাবেই চলে আসে ভিণ গ্রহের মানুষ কিংবা অতি-প্রাকৃতিক শক্তি কিংবা দেবতাদের অবদানের কথা। স্টোনহেন্জও এর বাইরে যেতে পারেনি।
রেপ্লিকা দিয়ে যদি কোন প্রাচীণ দর্শণীয় স্থাপনার জনপ্রিয়তা যাচাই করা যায় তাহলে বলতেই হয়, সম্ভবতঃ স্টোনহেন্জ বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় প্রাচীন স্থাপনা। বর্তমানে বিশ্বের ২৬টি দেশে স্টোনহেন্জের ৯৩টি স্থায়ী রেপ্লিকা রয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি তৈরীর পথে। আর অস্থায়ী রেপ্লিকাগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। এই রেপ্লিকাগুলোকে সাধারনভাবে ক্লোনহেন্জ বলে। কয়েকটার ছবি দেখুন,
আমেরিকার কানেকটিকাটে স্থাপিত। সূদুর নরওয়ে থেকে গ্রানাইট পাথর এনে এটি তৈরী করা হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে Circle of Life
জাপানের হোক্কাইডোতে পাথরের তৈরী স্টোনহেন্জ রেপ্লিকা
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পাথরের তৈরী স্টোনহেন্জ রেপ্লিকা
বিভিন্ন দেশে বেড়ানো এবং বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা দেখার আর জানার সুবাদে আমার মনে হয়েছে প্রাচীন মানুষ জাগতিক চিন্তা যতোটা করতো, তার চেয়েও বেশী পরকালের জীবন নিয়ে চিন্তা করতো। এর নমুনা আপনারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই দেখবেন। তাদের চিন্তা-ভাবনার বেশীরভাগ জুড়েই থাকতো দেব-দেবীকে তুষ্ট করার বিভিন্ন কলা-কৌশল যাতে করে পরের জন্মে দেবতাদের করুণা লাভ করা যায়, কিংবা মৃতদের আত্মারা একটু শান্তিতে থাকতে পারে। স্টোনহেন্জও এর বাইরের কিছু না, অন্ততঃ বিশেষজ্ঞরা ইনিয়ে বিনিয়ে তাই বলার চেষ্টা করছে।
প্রাচীনকালের প্রতিটা স্থাপনাই একেকটা রহস্য। আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই তখনকার মানুষেরা যেসব নিখুত স্থাপনা নির্মান করেছিল, যেসব বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সেসব স্থাপনাতে সংযোজন করেছিল, তা এখনকার আধুনিক যন্ত্রসভ্যতাকেও হার মানায়। বর্তমানের পন্ডিত ব্যক্তিরা হয়রান হয়ে যান ভাবতে ভাবতে যে কিভাবে তারা পারতো! কিভাবে তারা অসম্ভবকে সম্ভব করতো যা করে দেখানো এখনও, এই অত্যাধুনিক যুগেও অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একেকজন একেক তত্ব, সূত্র আর সম্ভাবনার কথা বলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি কোন নিরেট সমাধান দিতে পারেন? আদতে রহস্য শেষ পর্যন্ত রহস্যই থেকে যায়।
আমার চাওয়া হচ্ছে, এসব রহস্য পর্দার অন্তরালেই থাকুক; তা না হলে আমরা এসব নিয়ে উথাল-পাথাল চিন্তা করে রোমান্চিত হবো কিভাবে?
তথ্য ও ছবিসূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Stonehenge
https://clonehenge.com/the-63-large-permanent-replicas/
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৫২