ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - পন্চম পর্ব
আজ মনটা বেশ খারাপ। আগামীকাল ঘোরাঘুরি করে পরশু ভোরে ইস্তান্বুলকে বিদায় জানাবো। সকাল ৮:৩০ এ ফ্লাইট, ভোর ৪:৩০ এ হোটেল থেকে বের হতে হবে। কাজেই এক অর্থে আগামীকালই শেষ দিন! দেখলাম, এইমেনের মনটাও কিন্চিত খারাপ। আসলে এই কয়টা দিন ওর সাথে এতো আড্ডা হয়েছে যে, মনে হয়েছে আমরা দীর্ঘদিনের পরিচিত। রাতে ওকে দুঃখ করে বললাম, 'তোমাদের ব্লু মস্কের ভিতরটা দেখতে পারলাম না। এই দুঃখ নিয়েই ফেরত যেতে হচ্ছে!' তখন ও আমাকে যে ইনফরমেশানটা দিল তাতে মনের ভিতর থেকে একটা অপ্রাপ্তি দূর হয়ে গেলো। ও জানালো যে, ভিতরটা পর্যটকদের জন্য বন্ধ, কিন্ত নামায পড়ার জন্য ঢোকা যায়। ঠিক করলাম, আগামীকাল মাগরিবের নামায ওখানেই পড়বো।
আরেকটা বিষয় নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। কাক-ডাকা ভোরে নিশ্চিতভাবেই রাস্তা-ঘাট ফাকা থাকবে। আসার সময় ভিড়ের মধ্যেই ড্রাইভার যে ভেল্কিবাজী আমাকে দেখিয়েছিল, ফাকা রাস্তায় না জানি কি করবে। এইমেনকে বললাম,
- ভাই, আমার এই শেষ উপকারটুকু করো, তোমাদের ঐ ড্রাইভার সাহেব যেন আমাকে নিতে না আসে!
- ও কিন্তু খুবই ভালো ড্রাইভার। এখন পর্যন্ত কোন দুর্ঘটনা ঘটায় নাই। এইমেন হাসতে হাসতে বললো।
- আমাকে দিয়েই যে শুরু করবে না, তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে! আমি ওড়ার আগেই উড়তে চাই না, তুমি ভাই প্লিজ ওকে বদলাও!
ওদের নিয়ম হচ্ছে, যে পিক আপ করে, সেই ড্রপ আউটও করে। যাইহোক, এইমেন আশ্বাস দিল ওকে বদলে দেবার, আর আমিও জানে পানি পেলাম!
শেষদিন সকালে যথারীতি তৈরী হয়ে নাস্তা করে বের হলাম। আমার প্রথম গন্তব্য দোলমাবাহচে প্রাসাদ। দ্বিতীয় পর্বে এর সম্পর্কে একটু বলেছিলাম। তাই আর রিপিট করলাম না। শুধু বলি, বসফোরাসের একেবারে তীর ঘেষে অবস্থিত এই প্রাসাদ আয়তনে বলেন আর সৌন্দর্য্য এবং জাকজমকে বলেন টপক্যাপির থেকে কয়েকধাপ উপরে। শুধু এটুকুই বলি যে, এর সিলিং এর স্বর্ণালী কারুকাজের জন্যই ব্যবহার করা হয়েছিল ১৪ টন সোনা!
এটা ছিল সর্বশেষ ছয়জন সুলতানের বাসভবন। পরবর্তীতে কামাল আতাতুর্ক এটাকে প্রেসিডেন্ট এর গ্রীষ্মকালীন বাসভবন হিসাবে ব্যবহার করেন এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার পর শেষের বছরগুলো এখানেই অতিবাহিত করেন। সবশেষে উনি মারাও যান এই প্রাসাদেই। উনার মৃত্যুসময় ছিল সকাল ৯:০৫, তাই যেই রুমে উনি মারা যান সেখানের ঘড়িগুলোকে ৯:০৫ -এই বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
আরেকটা বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখি, প্রাসাদের ভিতরে ক্যামেরার ব্যবহার পুরাপুরি নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ মানে নিষিদ্ধ, প্রচুর পাহারা আর কোন ঢিলামীও নাই। তারপরেও কি আর চোরা পর্যটকদের থামিয়ে রাখা যায়? রক্ষীরা একদিকে তেড়ে গেলে অন্যদিকে ক্যামেরা চালু হয়ে যায়! আমিও সেভাবেই তুলেছি, তাই ছবি অনেক কম তুলতে পেরেছি। আর কিসের ছবি তুলছি তা মনে রাখার জন্য আমি সবসময় সাথে সাথে ইনফরমেশান বোর্ডের ছবিও তুলি, যেটা স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে করতে পারি নাই। যা তুলেছি, তাই দিয়ে দিলাম। সংখ্যার স্বল্পতার জন্য বাছাবাছি করার কোন সুযোগ নাই আর কোন ছবি কোন রুমের তাও মনে নাই!
প্রথমেই মূল প্রাসাদের বাইরের কিছু ছবি,
প্রাসাদের ভিতরের বিলাসিতা,
এই ছবিটা বেশ মজার এক ঘটনার। ছবির ঐ বড় সাইজের মাছটা যেদিকে যাচ্ছিল, ত্যাদড় হাসটাও কেন জানি ওকে অনুসরন করছিল (ঠিক যেন ইয়াবা ব্যবসায়ীর পিছনে র্যাব)। বেশ কিছুক্ষন এদিক-ওদিক চেষ্টা করেও মাছটা যখন ওকে খসাতে পারে নাই, তখন ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে এই নাছোড়-বান্দা হাসের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মুহুর্তেই হাসের বিকট প্যাক প্যাক রবে বাচাও বাচাও চিৎকারে পাড়ের সবগুলো হাস ভাইকে (কিংবা বোন!?) বাচাতে একযোগে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য!
প্রাসাদের ভিতরে একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানা মতো আছে। এর মধ্যে ময়ুরগুলোই আকর্ষনীয়,
এটা প্রাসাদের ক্লক মিউজিয়াম। ভিতরে তুলতে পারি নাই, তাই বাইরের একটা ছবি দিলাম। ঘড়িটা কিন্তু চলছে,
প্রাসাদের আর্ট গ্যালারী। বিভিন্ন বিখ্যাত চিত্রকরের আকা ২০২ খানা চিত্র এখানে স্থান পেয়েছে। প্রথমটা সুলতান সুলেয়মান, তার যুদ্ধযাত্রা, পরের ছবিখানা কার তাতো সুপ্রিয় ব্লগারদের আর বলে দিতে হবে না, আর শেষেরটা আর্ট গ্যালারীর সিলিং এর কারুকাজ!
অবশেষে শেষ হলো আমার দীর্ঘসময় ধরে চলা দোলমাবাহচে প্রাসাদ ভ্রমন। এতোক্ষন প্রাসাদের চাকচিক্য দেখতে দেখতে চোখ ধাধিয়ে গিয়েছিল। ধাধানো চোখকে আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য প্রাসাদের ঘাস আর গাছপালায় ঘেরা বাগানে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন বুঝলাম সবকিছু স্বাভাবিক, তখন বেরিয়ে এলাম পরবর্তী গন্তব্য, গ্র্যান্ড বাজারের উদ্দেশ্যে।
১৪৬১ সালে চালু হওয়া গ্র্যান্ড বাজারকে পৃথিবীর প্রথম শপিং মলগুলোর অন্যতম ধরা হয়। ৬১টা কাভার্ড স্ট্রীট আর ৪,০০০ এর উপরে দোকান নিয়ে গড়া এই বাজার পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম পাকা ছাউনি দেয়া বাজার। কি নেই সেখানে! একজন ভোজন রসিক হিসাবে আমার নজর অবশ্য শুধুমাত্র খাবারের দোকানগুলোর দিকেই ছিল। আমি ঘন্টাখানেক ছিলাম ওখানে, তবে মেয়েরা গেলে ওখান থেকে আর বেরুতে চাইবে না বলেই আমার ধারনা! তাছাড়া প্রচুর দামাদামি করতে হয়, এটাও মেয়েদের খুবই পছন্দের বিষয়।
গ্র্যান্ড বাজারের একটা প্রবেশদ্বার, একটা প্রধান স্ট্রীট আর পার্শ্ববর্তী একটা মসজিদের ভিতরের ছবি,
আমার ধারনা ছিল আমার হোটেল থেকে মর্মর সাগর বেশ খানিকটা দুরে, হেটে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু এইমেন গতরাতে একটা শর্টকাট রাস্তা বাৎলে দিয়েছিল যেটা ধরে গেলে ১০ মিনিটেই হেটে সাগরপাড়ে যাওয়া যায়। শেষ বিকালটা সাগরপাড়ে বসে আর হাটাহাটি করেই কাটিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যার আগে আগে হোটেলে ফিরে তৈরী হলাম ব্লু মস্কে মাগরিবের নামায আদায় করার জন্য। কয়েকটা ছবি দিলাম, তবে বেশীরভাগ জায়গাই সংস্কার কাজের জন্য ঢাকা থাকায় ছবিগুলো যুৎসই হয় নাই।
এরপর অবশ্য আপনাদেরকে বলার মতো তেমন কোন কিছু নাই। ডিনার, গোছগাছ, এইমেনের সাথে একটা সংক্ষিপ্ত আড্ডা, ঘুম এবং ভোরে উঠে এয়ারপোর্ট যাওয়া। সকালে এইমেন থাকবে না। তাই রাতেই ওর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিদায়কালে জড়িয়ে ধরে বললো, ব্রাদার, তোমার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না, তবে তোমার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। আমি বললাম, হয়তো দেখা হবেনা। তবে যেখানেই থাকো যেভাবেই থাকো, ভালো থেকো।
আর কোন রকমের ঘটনা ছাড়াই সকালে ইস্তান্বুলকে বিদায় জানিয়ে উড়াল দিলাম লন্ডনের উদ্দেশ্যে। আর হ্যা, একটা কথা না বললেই না। ইস্তান্বুলের ৩০ ডিগ্রির গরম থেকে হিথ্রোতে এসে যখন নামলাম তখন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি, সেইসাথে প্রচন্ড বাতাস। ঠান্ডায় কাপতে কাপতে কোন রকমে বাসায় ফিরলাম।
শেষ হলো আমার স্বপ্নপূরনের আরেকটা পর্যায়, আর শুরু পরবর্তী পর্যায়ের জন্য অপেক্ষার!
ছবিঃ আমার ক্যামেরা ও ফোন থেকে।
তথ্যঃ বিবিধ।
প্রথম পর্বের লিংকঃ ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - প্রথম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৪৭