somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - পন্চম পর্ব

২০ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - চতুর্থ পর্ব

আমার হোটেলের রিসিপশানে রাতে যেই ছেলেটা ডিউটি করতো তার সাথে ঐ কয়েকটা দিনে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। এইমেন আহমেত ওর নাম। সমস্তদিন ঘোরাঘুরির পর হোটেলে এসে একটা শাওয়ার নিয়ে আমি নীচে চলে আসতাম। ওর সাথে বসে বসে বেশ কিছুক্ষণ আকাশ-বাতাস গল্প চলতো। আমি টার্কিশ জীবন-যাত্রা, সমাজের হাল-চাল বোঝার চেষ্টা করতাম, ওর আবার ইংল্যান্ড সম্পর্কে খুব আগ্রহ ছিল, অনেক প্রশ্ন করতো। ভাষা খুব একটা সমস্যা হয়নি। ইংলীশটা ও মোটামুটি বললেও আটকে গেলে দুজনেই গুগল ট্রানস্লেটরের সাহায্য নিতাম। বেশুমার গল্পের সাথে চলতো চা-কফি-সিগারেট। সারাদিন কি করলাম, আগামীকালের প্ল্যান কি এসব খুব মন দিয়ে শুনতো; প্রয়োজনীয় তথ্য, সাজেশান দিতো। তো সেদিন রাতে ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন আর গুলহানে পার্কের অভিজ্ঞতা ওকে বললাম। আরো বললাম যে, আগামীকাল আমি এশিয়ান সাইডে যাবো। শুনে এইমেন বললো, 'এশিয়ান সাইডে আমাদের এক নবী, হযরত ইয়ুশা (আঃ) এর মাজার আছে, তুমি কি জানো?'

আমার ঠিকমতো জানা ছিল না। ওর কথা শুনে আমি আমার প্রোগ্রামে কিছু রদ-বদল করলাম। পরদিন সকালে বের হলাম আমার প্রথম গন্তব্য বসফোরাসের তীরে গোল্ডেন হর্ণের ঠিক উত্তরে অবস্থিত গালাটা টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। একটা ছোটখাটো পাহাড়ের উপরে পাথরের তৈরী মেডিয়াভ্যাল যুগের এই ৬৭ মিটার উচু টাওয়ারটার কাছে গিয়ে যারপরনাই হতাশ হলাম, টাওয়ারে উঠার লাইনের দৈর্ঘ্য দেখে। একটু ফাকা জায়গা দেখে বসলাম। উদ্দেশ্য, শ্রান্ত দেহটাকে একটু বিশ্রাম দেয়া আর একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া। এই টাওয়ারে যদি আমাকে উঠতে হয়, তাহলে কমপক্ষে ২/৩ ঘন্টার ধাক্কা। তাতে করে আমার আজকের টাইট শিডিউলে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা ১৪ আনা। আর যদি না উঠি, তাহলে কতোটুকু লোকসান হবে! হিসাব-নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নিলাম গালাটা টাওয়ার বাদ! বাইরে থেকেই কয়েকটা ফটোক খিচলাম। তারপর দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে গালাটাকে বিদায় জানিয়ে হাটা দিলাম ফেরীঘাটের দিকে!

গালাটা টাওয়ার



এমিনন্যু থেকে ফেরী ছাড়লো, গন্তব্য উসকুদার (এশিয়ান সাইডে)। বরং বলা চলে বসফোরাসের বুক চিড়ে ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে যাত্রা করলাম। কেমন যেন একটা অদ্ভুদ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হলাম। আমাদের বাংলাদেশ তো এশিয়াতেই, হোক না তা অনেক দুরে! তাতে কি? আমার জন্মভূমির মহাদেশে তো যাচ্ছি!

উসকুদার ফেরীঘাটের ঠিক উল্টাপাশেই বিখ্যাত তুর্কী আর্কিটেক্ট মিমার সিনানের করা ডিজাইনে মার্বেল আর গ্রানাইট পাথরে তৈরী মিহরিমাহ সুলতান মসজিদ। ১৫৬২ - ১৫৬৫ খৃষ্টাব্দে এই মসজিদটি ইতিহাস-খ্যাত সুলতান সুলেইমান - ১ এর কন্যা রাজকুমারী মিহরিমাহ-র নামে করা।

মিহরিমাহ সুলতান মসজিদের প্রধান গম্বুজের ভিতরের কারুকাজ



মসজিদের মিম্বর ও নামাযীদের স্থান




মসজিদ দেখে বাসে করে রওয়ানা দিলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য, ১৮৬০ সালে নির্মীত সুলতানদের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল বেইলারবেয়ী প্রাসাদের উদ্দেশ্যে। এবং আবারও ধরা, যদিও কারনটা ভিন্ন। সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার, আর মঙ্গলবারেই ওটা দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকে! যথেষ্ট হোম ওয়র্ক না করার ফল হাতে নাতে পেলাম।

আবার বাস, এবার যাত্রা হযরত ইয়ুশা (আঃ) এর মাজার অভিমুখে। এই মাজার যশুয়া’স হিল নামে একটা পাহাড় চুড়ায় অবস্থিত। দুই বার বাস পরিবর্তন করে প্রায় দেড় ঘন্টার জার্নি করে যেখানে এসে নামলাম, তা একেবারেই নির্জন একটা জায়গা, শহর থেকে অনেকটা বাইরে, পাহাড়ের উপর। বাস স্ট্যান্ডে দু’জন লোক বসেছিল। তাদের কাছ থেকে জানলাম, পাহাড়ে আরো প্রায় ১৫ মিনিটের চড়াই-এর পর মাজারের দেখা মিলবে।

মাজারের প্রধান গেইট এবং নামফলক




হযরত ইয়ুশা (আঃ) এর কবরটি অনেক লম্বা




উনার সঙ্গীসাথীদের কবরস্থান



মাজার কমপ্লেক্সের পিছনে



মাজার কমপ্লেক্সের থেকে দেখা, দুরে বসফোরাস



তৃষ্নার্তদের জন্য পানিপানের ব্যবস্থা




একটা ব্যাপার আমার একটু আশ্চর্যই লাগলো। যতোটুকু জানি আমাদের ধর্মে কুকুরকে অপবিত্র মনে করা হয়। সেখানে উনার ঠিক কবরের পাশে এই কুকুরটা শুয়ে ছিল। আমি সেখানে প্রায় ঘন্টাখানেক ছিলাম, এর মধ্যে ওটা ওখান থেকে নড়ে নাই। শুধু শোয়ার স্টাইল পরিবর্তন করেছে কয়েকবার। কেউ কিছু বলেও নাই।



আরো একটা বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট। বাসায় ফিরে আমি হযরত ইয়ুশা (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য নেটে অনেক ঘাটাঘাটি করলাম। যা জানলাম তাতে আমি পুরাপুরি বিভ্রান্ত! উনার পুরা নাম ছিল হযরত ইয়ুশা বিন নুন বিন আফ্রাইম বিন ইউসুফ (আঃ)। বাইবেলে উনাকে যশোয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কোরান শরীফে ইনার নাম সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও দুই জায়গায় উনার রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য এবং ভিডিওতে উনার কবর তুরস্ক (যেখানে আমি গিয়েছিলাম), জর্ডান এবং লেবাননে বলা হয়েছে। তথ্যেও ভিন্নতা রয়েছে। সংক্ষেপে আপনাদেরকে জানালাম, কেউ যদি সঠিক তথ্য জানেন তাহলে আমাকে লিংক দিলে বাধিত হবো।

যাইহোক, মাজার থেকে বের হয়ে শহরে আসতে আসতে ক্ষুধায় এমন কাতর হয়ে পরলাম যে মনে হলো গোটা দুনিয়াটাই খেয়ে ফেলতে পারি! বাস থেকে নেমেই ঝটপট একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকে পরলাম। মূল ভোজনপর্ব সেরে ভাবলাম একটা টার্কিশ ডেজার্ট খাই। মেন্যুতে দেখলাম একটা আইটেম 'কুনেফে'। বেশ আগে কাতারে একবার 'কুনাফা' খেয়েছিলাম, ভালোই ছিল। দেখলাম চেহারাও প্রায় একই রকমের, তো ভাবলাম খেয়ে দেখি। দেখলাম আইটেম মোটামুটি একই!



উসকুদার ফেরীঘাটে ফিরে এলাম আবার। বিকাল হয়ে এসেছে। আমার লিষ্টে আরেকটা জায়গা বাকী ছিল। জামলিজে টেপেসি। তুর্কী ভাষায় টেপেসি মানে হলো পাহাড়। 'ট্রিপ এ্যাডভাইজার' এর রিভিউতে পড়েছিলাম, এই পাহাড় চুড়া থেকে নাকি চমৎকার সুর্যাস্ত দেখা যায়। কিন্তু সেখানে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। দোনো-মোনো করতে করতে শেষে ফেরীঘাটের পাশে ইনফরমেশান সেন্টারে গেলাম। ওরা জানালো, না গেলে বিরাট মিস হবে! আর অভয় দিয়ে জানালো, নিরাপত্তা নিয়ে কোন আশংকা নাই। কাজেই আল্লাহ্-র নামে রওয়ানা দিলাম। মেট্রোর (আন্ডার গ্রাউন্ড রেল)তিন স্টেশান পরে নেমে হাটতে হাটতে অনেক কষ্টে পাহাড়ের চুড়ায় উঠলাম। নাহ্, না এলে মিসই করতাম। সুন্দর করে সাজানো একটা পার্ক। পার্ক আর চমৎকার সুর্যাস্ত দেখে মনটা পুরাপুরিই ভালো হয়ে গেল।





ফেরীঘাটে আবার যখন ফিরে এলাম, তখন চারদিক আধার হয়ে এসেছে।

মিহরিমাহ সুলতান মসজিদ এর রাতের ছবি



আবার বসফোরাস পাড়ি দিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়া। ফেরী থেকে এশিয়ান সাইডের রাতের দৃশ্য। আর শেষের ছবিটাতে দুরে বসফোরাসের একটি ব্রীজের আলোকসজ্জা




আরেকটা দিন শেষ হলো সাধের ইস্তান্বুলে!


ছবিঃ প্রথমটা নেট থেকে, বাকিসব আমার ক্যামেরা ও ফোন থেকে।
তথ্যঃ বিবিধ।

ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - ষষ্ঠ (শেষ) পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৪৫
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×