somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - প্রথম পর্ব

০৯ ই মে, ২০১৮ দুপুর ২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ছোটবেলায় ’লিচুচোর’ কবিতার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে আমার পরিচয়। তারপর আস্তে আস্তে কবির অন্যান্য কবিতা পড়া শুরু করলাম। তখন ’কামাল পাশা’ কবিতাটা পড়ার সময় রক্তে এক ধরনের উন্মাদনা অনুভব করতাম! পরবর্তীতে কবিতার নায়ক কামাল পাশা সম্পর্কে জানলাম। তখন থেকেই ইচ্ছা, যদি কখনও সম্ভব হয়, তাহলে একবার তুরস্কে যাবো। মাথার মধ্যে ’তুরস্ক’ নিয়েই জীবনের এতগুলো বছর পার করলাম! কোনভাবেই সময়-সুযোগ হয় না। এবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, সাথে সাথে চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। দেশে-বিদেশে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাকে বিভিন্ন রকমের ভয় দেখানো শুরু করলো! সবাইকে বললাম, সিদ্ধান্ত ফাইনাল। বদলানোর কোন চান্স নাই। তাছাড়া, দুনিয়াতে এখন কোন জায়গাই আর নিরাপদ নাই। আর আমার মরন যদি আল্লাহ তুরস্কেই লিখে রাখেন, তাহলে তাই সই!!

কাজেই ওয়ান ফাইন মর্নিং ’বল বীর, চির উন্নত মম শির’ বলে বৃটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে চেপে বসলাম এবং আল্লাহর নাম নিতে নিতে ইস্তান্বুলে পৌছেও গেলাম! এরই মধ্যে বিমানের একটা ছোট্ট ঘটনা না বলে পারছি না। আমি সাধারনতঃ প্লেনের আসনে বসেই সীটবেল্ট লাগিয়ে সীটে রাখা কম্বলটা পায়ের উপর দিয়ে রাখি। সেদিন সম্ভবতঃ সেটা একটু বেশী উপরে উঠায় সীটবেল্ট দেখা যাচ্ছিল না। তো, টেইক অফের আগে বিমানবালা রুটিন চেকআপে এসে বেল্ট দেখতে না পেয়ে আমি সীটবেল্ট লাগিয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম, উত্তর দেয়ার জন্য বিমানবালার দিকে তাকিয়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কালোদের মধ্যে এতো সুন্দর মুখ আমি জীবনেও দেখি নাই। যেন, ''আবলুশ কাঠে খোদাই করা দেবী আফ্রোদিতের মুখ'' ঠিক এই উপমাটাই সেদিন আমার মাথায় এসেছিল!

সম্ভবতঃ একটু বেশী সময়ই বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলাম, ঝকঝকে সাদা দাতে মুক্তো ঝরিয়ে সুন্দরী বললো, তোমার কি কিছু লাগবে? নিতান্তই পেশাগত প্রশ্ন কিন্তু তাতেই আমি ধন্য হয়ে গেলাম! মাথা নেড়ে কোনমতে বললাম, গলা শুকিয়ে গিয়েছে। আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। বললো, এখনতো টেইক অফের সময়! একটু পরে দিচ্ছি। পাশে বসা যাত্রীর মনে হলো, আমি ভয় পাচ্ছি। অভয় দিয়ে বললো, চিন্তা কোরো না, আমরা ঠিক-ঠাক মতোই ইস্তান্বুল পৌছাবো, তুমি কি ভয় পাচ্ছো? তাকে একটা বিভ্রান্তিমূলক হাসি দিলাম যার মানে হ্যা অথবা না, যে কোনটাই হতে পারে। একটু পরে দেখি পানির বদলে আপেলের জুস নিয়ে এসেছে! এরপর যতোবার আমার পাশ দিয়ে গিয়েছে, আমার মাথা রাডারের মতো ওকে অনুসরণ করেছে। মাথাকে বুঝিয়েছি, আরে গাধা, এভাবে দেখা ঠিক না। কে শোনে কার কথা! ওটা যেন কিছু সময় আমার মাথাই ছিল না!! নামার সময় মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, আবার দেখা হবে। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, হয়তো!

তুর্কী সময় দুপুর দুইটায় ইস্তান্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে আমাদের বিমান খানা ল্যান্ড করলো। কিছু পাউন্ডকে তুর্কী লিরায় রুপান্তর করে আর ঘড়ির সময় ঠিক করে বিমানবন্দরের বাইরে এসে দাড়ালাম! আহ, শেষ পর্যন্ত আমি তুরস্কের মাটিতে!!! ফোন করে জানলাম হোটেলের গাড়ী আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে যাবে। এই ফাকে ইস্তান্বুলের ইতিহাস আপনাদেরকে একটু জানাই, অতি সংক্ষেপে।

ইস্তান্বুলের গোড়াপত্তন ঠিক কবে হয় সেটা বলা মুশকিল। এই নগরীর সবচেয়ে প্রাচীণ যে নাম পাওয়া যায়, তা হলো ’লাইগোস’, এটা যীশুখৃষ্টের জন্মেরও ১৩০০ বছর আগের কথা। ৬৫৭ খৃষ্টপূর্বাব্দে গ্রীকরা এখানে বসতি স্থাপন করে এর নাম দেয় ’বাইজেন্টিয়াম’। খৃষ্টাব্দের তৃতীয় শতকে রোমান সম্রাট সেপ্টিমিনাস সেভেরাস তার ছেলে এন্টোনিনাস এর নামে এই শহরের নামকরন করেন 'অগাষ্টা এন্টোনিনা'। কিন্তু এই নাম বেশীদিন টিকে নাই। ওই ডাইনেস্টির পতনের পর এটি আবার পুরানো নাম, বাইজেন্টিয়াম এ ফিরে যায়।

৩৩০ খৃষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সটেনটাইন-১ নিজের নামানুসারে এর নামকরন করেন কন্সটেন্টিনোপলিস এবং রাজধানী রোম থেকে এখানে স্থানান্তরিত করেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর এটি কন্সটেন্টিনোপল হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ১৪৫৩ সালের ২রা মে অটোম্যান সুলতান মেহমেত-২ তিপ্পান্ন দিনের অবরোধের পর এটি দখল করেন। অটোম্যান সম্রাটরাও এই নগরীকে রাজধানী হিসেবেই ব্যবহার করতেন। ১৯৩০ সালে তৎকালীন তুর্কী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরন করেন ইস্তান্বুল। তুরস্কের বর্তমান রাজধানী আঙ্কারা হলেও এটি এখনও তুরস্কের সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল নগরী।

গাড়ী চলে এসেছে, আপাততঃ হোটেলে যাই। ইস্তান্বুলের ইতিহাস আসলে এতোই বিশাল আর বিস্তৃত যে, এত অল্প কথায় বলা যায় না। সামনের পর্বগুলোতে বারে বারেই এর ইতিহাসপ্রসঙ্গ সামনে আসবে। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল ২০ মিনিটের ড্রাইভ। ড্রাইভার সাহেব তুর্কি ভাষায় বক বক করতে করতে এমনভাবে গাড়ী ছোটালো, যেন আজই তার শেষ দিন। সাপের মতো একেবেকে ঝড়ের গতিতে একে-তাকে এমনভাবে ওভারটেইক করা শুরু করলো যে আমি আক্ষরিক অর্থেই শক্ত হয়ে গেলাম! সাথে সমানে চলছে হর্ণ আর তার মুখ। তুর্কি ভাষা জানিনা। তাই নিরর্থক জেনেও মিন মিন করে ইংলিশেই বললাম, ভাই, কথা কম বলো আর একটু আস্তে চালাও। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ব্যাটা স্পীড আরও বাড়িয়ে দিলো!

ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত গতি আর হর্ণহীন পরিবেশ থেকে এসে ওর ড্রাইভিংএর কারনে যখন আমি পুরোপুরি বিদ্ধস্ত তখন হোটেলের সামনে এসে সে ঘ্যাচ করে ব্রেক করে দাড় করালো। ঘড়ি দেখলাম ২০ মিনিটের রাস্তা আসতে ১০ মিনিট নিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে দাত বের করে বললো, ওয়েলকাম টু ইস্তান্বুল! আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, তুমি ইংলীশ জানো? জবাব দিল, অবশ্যই জানি। তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যই না জানার ভান করেছি, আর তোমার চেহারা দেখে খুব মজাও পেয়েছি! পরে হোটেলের রিসিপশনিস্টের কাছে শুনেছি, ইওরোপ আর আমেরিকা থেকে আসা টুরিস্ট পেলে প্রায়ই সে এই কাজ করে কারন তারা এইরকম বেপরোয়া স্পীড আর হর্ণে অভ্যস্ত না। ফাজিল আর কাকে বলে!! কতো বিচিত্র মানুষই না এই দুনিয়াতে আছে!

হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করে একটু রেস্ট নিয়ে বিকালে এলোমেলোভাবে ঘুরতে বের হলাম। এলোমেলো বললাম এই কারনে যে, আজকের দিনটা আমার ট্যুর-প্ল্যানের বাইরে, জাস্ট কিছুটা অলস সময় কাটানো।

হোটেল থেকে হাটা দুরত্বেই সুলতান আহমেত চত্বর যার আশেপাশে অনেক দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে। বিকাল এবং সন্ধ্যাটা এখানেই কাটালাম। পুরোটা চত্বর ট্যুরিস্টে গিজগিজ করছিল। কয়েকটা এলোমেলো ছবি দিলাম। পরের পর্বগুলোতে ডিটেইলসে যাবো।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিউলিপ ফুলের কার্পেট



১৭২৯ সালে স্থাপিত আহমেত-৩ এর ঝর্ণা, পিছনে টপক্যাপি প্রাসাদের প্রধান তোরণ



বিখ্যাত সুলতান আহমেত মসজিদ বা ’ব্লু মস্ক’ এর বিকাল এবং সন্ধ্যার কয়েকটা ছবি








চত্বরে স্থাপিত ইস্তান্বুলের একমাত্র মিশরীয় ওবেলিস্ক



শেষে দু’টা বিশেষ টার্কিশ খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।

মাস্তিক গাম চিকেন


আয়রান ড্রিংক (টক দই আর হার্ব দিয়ে তৈরী পানীয়)




ছবি - আমার ক্যামেরা, তথ্য - গুগল।

ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - দ্বিতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৩৭
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×