লন্ডনে খুব একটা আসা হয় না পলাশের। বাংলাদেশ এম্বেসীতে একটা কাজ থাকায় আসতে হলো। কাজ শেষ করে সাউথ কেনসিংটন থেকে পিকাডিলি লাইন ধরে কিংস ক্রস স্টেশানে এসে নামে পলাশ। স্টেস্টশানের বিশাল ডিসপ্লেতে দেখলো ওর শহরের ট্রেনটা এইমাত্র ছেড়ে গিয়েছে। পরের ট্রেন এক ঘন্টা পর। তাড়াহুড়া করে দৌড়াতে দৌড়াতে এসেও ট্রেনটা ধরতে পারলো না! আর এখন হাতে অঢেল সময়। "অঢেল সময়" কথাটা চিন্তা করতেই সিগারেটের তৃষ্না পেয়ে বসলো ওকে। বাইরে এসে সিগারেটটা ধরিয়ে মাথা সোজা করতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো পলাশের। একটু সামনে পাথরের বেন্চীতে শীলা বসে আছে। সোজা ওর দিকেই তাকিয়ে, যেন ভূত দেখেছে! একলাফে সাত বছর পিছনে ফিরে গেলো ও।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে পড়তো ওরা। পলাশ যখন ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র, তখন শীলা ভর্তি হয়। নবীনবরন অনুষ্ঠানে প্রথম পরিচয়। পলাশের পাশের বাড়ীর মেয়ে অনুর বান্ধবী শীলা। অনুই পরিচয় করিয়ে দেয় ওর সাথে। অনুও ভর্তি হয়েছে, তবে ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। বান্ধবীর সাথে এসেছে অনুষ্ঠান দেখতে। একই ডিপার্টমেন্টের হওয়াতে প্রতিদিন দেখা, ভালোলাগা, ভালোবাসা। দু’টা বছর যেন চোখের পলকে উড়ে গেল। এর মধ্যে পলাশ পাশ করে বের হলো, চাকুরী খুজতে শুরু করলো। দ্রুত একটা চাকুরী যোগাড় করতে হবে, তারপর শীলাকে বিয়ে করে সংসার শুরু করবে। অত্যন্ত সাধাসিধা পরিকল্পনা পলাশের। এরই মধ্যে একদিন অনুর এক ফোন ওকে এক ঝটকায় স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে আছড়ে ফেললো। ফোন ধরতেই অনু বললো,
- পলাশভাইয়া, শীলার খবর কি কিছু জানেন?
- কি খবর বলোতো? দু'দিন আগেই তো কথা হলো ওর সাথে।
- কেন, আপনাকে কিছু বলেনি?
- কি বলবে? তুমিতো আমাকে টেনশানে ফেলে দিলে! খুলে বলোতো কি হয়েছে?
- আগামীকাল তো শীলার বিয়ে!!!
প্রথমে মনে হলো অনু ফান করছে ওর সাথে, তবে মনের ভ্রম দূর হয়ে গেল খুব দ্রুত। অনু একটানা বলে গেলো, আর একটা কথাও না বলে ও শুধু শুনলো। শীলার আব্বার বন্ধুর ছেলে ইংল্যান্ডে থাকে, গত সপ্তাহে দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। আগে থেকেই নাকি মোটামুটি ঠিক করা ছিল! অনু বলেই চললো, ভাইয়া, আমিও জানতাম না এই ভিতরের খবর! শীলাকে আপনার কথা বলাতে ও বলেছে, আপনার ভবিষ্যতের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। কবে চাকুরী পাবেন তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। এরকম অনিশ্চিত জীবন পছন্দ না ওর। তাছাড়া, বিদেশে সেটল হওয়া ওর স্বপ্ন। অনু জিজ্ঞেস করেছিল, তাহলে পলাশ ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক করেছিলি কেন? শীলা বলেছে, শোন, স্বপ্ন আর বাস্তবে অনেক তফাৎ। পলাশকে আমার ভালো লাগে। ভেবেছিলাম, ওর সাথেই সংসার করবো কিন্তু আব্বা যখন চাপ দিলো, তখন আর না বলতে পারলাম না!
পৃথিবীটা এক ঝটকায় বিবর্ণ হয়ে গেলো পলাশের। ওদিকে অনু বলতেই থাকলো, ভাইয়া, ও আসলে আপনাকে নিয়ে খেলেছে। এখন সুবিধামতো কেটে পড়ছে!! আপনি মন খারাপ করবেন না.. .. ..আরও কি কি বললো যেন, পলাশের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। ফোন রেখে দিয়ে কোন রকমে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নির্ঘুম সারারাত আকাশ-পাতাল কতো কিছুই না চিন্তা করলো। দু’এক ফোটা জলও কি চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো? ও জানে না। সকালের সূর্যের আলোটা যখন ওর উপর পড়লো, ও বিছানা ছেড়ে উঠলো। স্বাভাবিক ভাবেই।
শাওয়ার নিলো। কাপড়-চোপড় পড়ে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হলো। সুইচড অফ ফোনটা পড়ে রইলো বিছানায়। এই বাসায় একটা রুম সাবলেট নিয়ে ও একাই থাকে। ও জানে এই খবর রাষ্ট্র হতে খুব একটা সময় লাগবে না। আর ওকে ফোনে না পেলে বন্ধুরা একে একে বাসায় এসে হাজির হবে। কারো সহানুভূতির ওর দরকার নেই এখন, এখন সময় নিজের সাথে বোঝাপড়া করার। হোটেল থেকে নাস্তা করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলো জীবনে প্রথমবারের মতো। তারপর একটা রিকসা নিয়ে সোজা রমনা পার্কে। একবার সোহরাওয়ার্দী পার্কের দিকে তাকালো, ভাবলো অত্যন্ত প্রিয় এই পার্কেই ঢোকে, সাথে সাথেই বাতিল করে দিল চিন্তাটা। ওর আর শীলার দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল এই পার্কটা, অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে!
সারাদিন পার্কে বসে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট ধ্বংস করলো। উদাস হয়ে শুয়ে-বসে কতো কি চিন্তা করলো! ছোট বেলায় প্রথমে বাবা, তার বছর দুয়েক পর মা মারা গেলেন। একটাই বোন, বড়। দুজনেই মামার কাছে মানুষ। না, মামা-মামী ওদের কোন অনাদর করেন নি। ওদের দু’জনকে পড়ালেখা করিয়েছেন। বোনটাকে ভালো বিয়ে দিয়েছেন। তারপরও মনে কেমন কেমন যেন একটা হাহাকার ছিলো। শীলাকে পাওয়ার পর ও অনেক সুস্থির ছিলো। মনে হচ্ছিল, না, বেচে থাকাটা খুবই আনন্দের। কিন্তু আজ? কোথা থেকে কি হয়ে গেল! আজ শীলার বিয়ে!!!
সন্ধায় পার্ক থেকে বের হলো এক ভিন্ন পলাশ। প্রত্যয়দীপ্ত দৃঢ় চিত্তের এক অন্য মানুষ!
এরপর ও একদিনের জন্যও আর শীলার নাম মুখে নেয়নি। বন্ধুদের কোন সহানুভূতির, উপদেশের বা এ সংত্রান্ত প্রশ্নেরও কোন উত্তর দেয়নি। সব কথার উত্তরে শুধু হেসেছে। দৃঢ়চিত্ত, ফোকাসড পলাশ একটা মুহুর্তও আর নষ্ট করেনি এরপর। পরবর্তী দু’টো বছর গিয়েছে ঝড়ের মতো। একটা চাকুরীতে জয়েন করলো। একদিকে চাকুরী, অন্যদিকে ইংল্যান্ডে আসার তোড়জোড়। তারপর স্টুডেন্ট ভিসা নিয়েই ইংল্যান্ডে এলো। নর্থ আমব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে চাকুরীতে জয়েন করলো। এই সময়ের মধ্যে একটিবারের জন্যও ওর মনে কোন কৌতুহল কিংবা চিন্তা আসেনি, জানতেও চায়নি, শীলা ইংল্যান্ডে কোথায় থাকে?
সেই শীলা কয়েক হাত সামনেই বসা! এক দৃষ্টিতে ওরই দিকে তাকিয়ে!!!
একগাল ধোয়া ছেড়ে, স্মিত হাসি দিয়ে পলাশ এগিয়ে গেল.. .. .. .. ..শীলার দিকে।
।।। আগামীপর্বে সমাপ্য ।।।
জীবন যখন যেমন (২য় এবং শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ সকাল ৯:৩০