স্বপ্নযাত্রা: ইটালী - ৬
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। আজ কোলোসিয়াম, রোমান ফোরাম আর সংলগ্ন স্থাপনাগুলো যতোটুকু পারি দেখবো। খবর নিয়ে জেনেছি দু’দুটা লম্বা লাইনের মুখোমুখি হতে হবে আজ। একটা টিকেটের, আরেকটা ঢোকার। মূল ভিড় হয় কোলোসিয়ামে ঢোকার জন্য। হোটেল থেকে বাসে করে কাছের সাবওয়ে কর্নেলিয়া, তারপর দুইবার ট্রেন চেন্জ করে সকাল সাড়ে ১০টায় যখন কোলোসিয়ামের টিকেটের লাইনের কাছে আসলাম, আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো! লাইনের আগা আর মাথার মধ্যে বিরাট তফাৎ! কি আর করা, লাইনে দাড়ালাম। একটু পর দেখি কিছু লোক ’স্কীপ দ্য লাইন’, ’স্কীপ দ্য লাইন’ বলে ডাকাডাকি করছে।
ঘটনা জানার জন্য দেশী চেহারার একজনকে ডাকলাম, ব্যাটা দেখি ইন্ডিয়ান। ঘটনা হলো, কিছু টাকার বিনিময়ে গাইড এবং টিকেটের ব্যাবস্থা করে দেয় এরা। লাইনের ভাব-সাব দেখে ’স্কীপ দ্য লাইন’ এর সাহায্য নেয়াই মনস্থির করলাম। এবার এক দেশী ভাইকে দেখে বললাম, আমার গাইডের দরকার নাই, টিকেটের ব্যাবস্থা করেন। কিন্তু সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়। সে বললো, প্রথমে যার সাথে কথা বলেছি তার সাথেই দরদাম করতে হবে, এটাই ওদের নিয়ম। আমি বললাম, নিয়মের খ্যাতা পুড়ি! আমার টাকা আমি দেশী কাউকেই দিবো, ভিনদেশী কাউকে না। নয়তো লাইনে দাড়িয়েই টিকেট কাটবো! তো দুইজন দুরে গিয়ে ফুসুর-ফাসুর করে আমাকে এসে বললো, দ্যান টাকা। আমি বললাম, ওকে ম্যানেজ করলেন কিভাবে? বলে, বলেছি, ভাই উনি ত্যাড়া টাইপের মানুষ, বেশী বাড়াবাড়ি করলে পুলিশ ডাকার হুমকি দিয়েছে। আর আশে-পাশে যেহেতু পুলিশের অভাব নাই, তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। দেশীর বুদ্ধি দেখেন, আমাকে না জিজ্ঞেস করেই ত্যাড়া বানিয়ে দিয়েছে!!
টিকেট নিয়ে আরও ঘন্টাখানেক ঢোকার লাইনে দাড়িয়ে থেকে অবশেষে কোলোসিয়ামের ভিতরে ঢুকলাম। কোলোসিয়ামের ব্যাপারটা আপনাদের একটু সংক্ষেপে বলি। প্রায় আশি হাজার দর্শক-ধারনক্ষমতা সম্পন্ন এই কোলোসিয়াম বা এম্ফিথিয়েটারটির নির্মানকাজ শুরু হয় ৭২ খৃষ্টাব্দে এবং শেষ হয় ৮০ খৃষ্টাব্দে। এখানে প্রায় প্রতিদিনই মূলতঃ গ্লাডিয়েটরদের রক্তাক্ত যুদ্ধ, নাটক আর অন্যান্য অনুষ্ঠনাদি সম্পন্ন হতো। বাকীটা ছবির সাথে সাথে বলছি।
কোলোসিয়ামে ঢোকার অপেক্ষায়
কোলোসিয়ামের ভিতরে মার্বেল পাথরের মেঝে, খুব বেশী বর্তমানে অবশিষ্ট নাই
দর্শকদের বসার জন্য ছিল এমন মার্বেল পাথরের গ্যালারী, এটাও খুব বেশী অবশিষ্ট নাই
প্রথম তলা থেকে নেয়া। এরেনা বা মূল ফ্লোর যেখানে যুদ্ধ বা অন্যান্য অনুষ্ঠান হতো তার খুবই সামান্য অবশিষ্ট আছে। এটি কাঠের তৈরী ছিল, উপরে বালি দেয়া থাকতো। এরেনার নীচে এই টানেল এবং ঘরগুলো হলো কোলোসিয়ামের হাইপোজিয়াম বা আন্ডারগ্রাউন্ড। টানেলগুলো বাইরের এবং আশেপাশের অন্যান্য ভবনের সাথে সংযুক্ত ছিল। এই টানেল দিয়ে গ্লাডিয়েটর, যুদ্ধে ব্যবহৃত পশু এবং শিল্পীরা যাতায়াত করতো। আবার এখান দিয়েই নিহত গ্লাডিয়েটর এবং পশুদের মৃতদেহ সরানো হতো। টানেল লেভেল থেকে এরেনা লেভেলে উঠা-নামার জন্য ক্রীতদাস-চালিত লিফটের ব্যাবস্থাও ছিল!
পুরো কোলোসিয়ামকেই আগের রুপে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে বছরের পর বছর। ভিতরে এমন স্যান্ডস্টোন এবং মার্বেলস্টোনের কারুকাজ করা প্রচুর পিলার ছিল যা বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প বা অন্যান্য কারনে ভেঙ্গে পড়েছিলো। সেগুলোকে যথাস্থানে এনে রাখা হয়েছে আবার খাড়া করার জন্য। আপাততঃ দর্শনার্থীদের পাওয়ার ন্যাপের জন্য ব্যাবহৃত হচ্ছে!!
গ্যালারীতে যাওয়ার পথ
গ্যালারীর একাংশ
কোলোসিয়ামের উপরের তলা থেকে দেখা রোমান ফোরাম। ছবিতে গ্রীলের দরজাওয়ালা যেসব ঘরের মতো দেখছেন এগুলোই কোলোসিয়ামের আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলগুলোর সাথে সংযুক্ত ছিল।
উপর তলা থেকে এরেনা এবং হাইপোজিয়াম।
এরকম ভেঙ্গে পরা পিলার, মুর্তি বিভিন্ন জায়গায় রাখা আছে। এগুলোকে আবার স্ব-স্থানে প্রতিস্থাপন করা হবে।
কোলোসিয়ামের ভিতরেই মিউজিয়াম আছে। সেখানে রাখা কলোসিয়ামের প্রোটোটাইপ।
প্রাচীন শিল্পীর চোখে গ্লাডিয়েটদের লড়াই। মিউজিয়াম থেকে।
এভাবে কোলোসিয়ামকে আবার নতুন রুপ দেয়া হচ্ছে। তফাৎটা খুবই পরিস্কার!
দ্য আর্চ অফ কন্সট্যান্টাইন। কোলোসিয়াম এবং প্যালেন্টাইন পাহাড়ের মধ্যিখানে অবস্থিত। ৩১২ খৃষ্টাব্দে কন্সট্যান্টাইন-১ মিলভিয়ানের যুদ্ধে ম্যাক্সেনটিয়াসের বিরুদ্ধে জয়ী হন। সেই জয়ের স্মরনে রোমান সিনেট এটা ৩১২ খৃষ্টাব্দেই তৈরী শুরু করে। ৩১৫ খৃষ্টাব্দে এর কাজ সমাপ্ত হয়।
কোলোসিয়ামের (কোলোসিয়ামের টিকেট দিয়েই ঢোকা যায়) পাশেই ফোরো রোমানো বা রোমান ফোরাম। এটা ছিল নগরীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে সিনেট হাউজ, কোর্ট-কাচারী, সরকারী দপ্তর, বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্দির ছিল। শয়তানের মন্দির বা টেম্পল অফ স্যাটার্ন এখানেই প্রথম দেখলাম। কোন যুদ্ধে জয়ী হলে সেনাদল এখানে প্যারেড করতো। নিয়মিত বাজারও বসতো এখানে। বিভিন্ন গন-জমায়েত থেকে শুরু করে বক্তৃতা-বিবৃতির স্থান ছিল এটি। আমাদের বঙ্গবন্ধু এভিনিউও অনেকটা এই ধাচের, কি বলেন!!!
নীচের সবগুলো ছবিই ফোরামের।
তথ্য কিছু গুগলের, কিছু ওখানকার পরিচিতিমূলক পুস্তিকা এবং বোর্ডের, ছবি প্রথমটা নেট থেকে, বাকিগুলো আমার ক্যামেরা এবং ফোনের।
চলবে (তবে আগামী পর্বই শেষ পর্ব).........
স্বপ্নযাত্রা: ইটালী - ৮ (শেষপর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২০ রাত ৯:৪৫