তখন চাকরিতে জয়েন করেছি মাএ কয়েক মাস হয়। নতুন কাজ বুঝতে প্রচুর খাটা-খাটুনি করছি, এদেশে নতুন তাই ভাষা সমস্যাও প্রকট। এরই মধ্যে রিচার্ড (আমার বস) জানালো, পরশুদিন অটোমোবাইল ট্রেডিং এর উপর একটা সেমিনার এবং ওয়ার্কশপ আছে অক্সফোর্ডশায়ারের গ্রোভ শহরে, সকাল ৮:৩০ এর মধ্যে পৌছাতে হবে। দুই-আড়াই ঘন্টার জার্নি, আমি যেন ভোর ৬টার সময় তৈরি থাকি, বলেই সবগুলো দাঁত বের করে শয়তানি হাসি দিল। ব্যাটা বদমাশ এরই মধ্যে জেনে গেছে অত সকালে এই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে উঠতে আমার কতটা কষ্ট হবে। তারপর চোখ টিপে বললো, ভেন্যু হচ্ছে উইলিয়ামস ফর্মুলা ওয়ান এর কনফারেন্স সেন্টার। শুনে খুশিতে আমার বুকের ভিতরে গুড় গুড় করে উঠলো। সেই যখন থেকে আমি কার রেসিংএর ভক্ত, তখন থেকেই স্বপ্ন ফর্মুলা ওয়ান এর কমপ্লেক্স আর মিউজিয়ামটা দেখার। তবে খুশি গোপণ করে ব্যাজার মুখে বললাম, যেখানেই হোক যেতে তো হবেই, তাইনা?
সারাটা দিন স্বপ্নের মতোই কাটলো। ফেরার পথে রিচার্ড বললো, আমরা এবার অন্য পথে যাবো। তুমি তো নদীর দেশের মানুষ, চলো, তোমাকে আমাদের একটা নদী দেখাই। আমি বিলাতি নদী দেখার আগ্রহে টান টান হয়ে বসে রইলাম। একসময় রিচার্ড বললো, নদী কেমন দেখলা? আমি আকাশ থেকে পড়লাম,
- কই নদী?
- এই যে এইমাএ পার হয়ে আসলাম, দেখো নাই?
- নাতো!
- বলো কি! বলেই গাড়ী ঘোরাতে শুরু করলো।
একটা ছোটমতো কারপার্কে গাড়ী পার্ক করলো। একটু সামনে এগিয়ে দেখলাম ড্রেনের চেয়ে একটু বড় একটা ছড়া মতো, সেটাকে নিয়েই যত আয়োজন। খুব বেশি হলে গোড়ালি-ডোবা পানি। ডান পাশে কায়দা করে একটা ব্রীজ বানানো যার উপর দিয়েই একটু আগে আমরা এসেছি। আমি চরম হতাশ গলায় বললাম, এইটা নদী? রিচার্ড বললো, কেনো, পছন্দ হয়নি? আমি বললাম, না, তা না, সুন্দর। একটু ঘোরাঘুরি করলাম। ব্যাটা এত শখ করে নিয়ে এলো, না হলে মনে দুঃখ পাবে।
ড্রেনমার্কা নদী দেখে মুগ্ধ হলাম না, হওয়ার কথাও না। তবে মুগ্ধ হলাম ওদের উপস্থাপনার সৌন্দর্যে। একটা সাধারন জিনিস কে এত অসাধারন ভাবে উপস্থাপনা এবং maintain করা আসলেই শেখার মতো। প্রচুর মানুষ বেড়াতে এসেছে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এসেছে অনেকে। কেউ একটা গাছের পাতাও ছিড়ছে না, একটা কাগজের টুকরাও পড়ে নেই কোথাও । সবকিছু ছবির মতোই সাজানো-গোছানো। আমাদের এত সুন্দর সুন্দর নদী, এবং তাদের দুরঅবস্থ্া মনে করে নিজের অজান্তেই বড় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে এলো বুক চিড়ে। আমাদের নেতা-নেএীরা এত আগ্রহ নিয়ে বিদেশে যায়, এত ঘোরাঘুরি করে, এত দেখে, কিন্তু শেখে না কিছুই, কেনো?
আমাকে চুপচাপ দেখে রিচার্ড বললো, এত ছোট নদী দেখে মন খারাপ? একদিন সময় করে লন্ডন গিয়ে থেমস নদীটা দেখে এসো, ভালো লাগবে। ওকে বললাম, নদী দেখে মন খারাপ হয়নি, হঠাৎ দেশের কথা মনে পড়লো! ফেরার পথে আর তেমন কথা হলো না।
একটা সুন্দর দিন পার করেও প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:৩০