রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের দোতলা থেকে ফেলে দিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের ৬ কর্মীকে চিহ্নিত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। চিহ্নিত ওই ছয়জনই শাহ মখদুম হলের আবাসিক ছাত্র এবং ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মী। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়নি। আজ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় অভিযুক্তদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
নাসিমের পরিবার ও বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়াসহ প্রক্টোরিয়াল বডির সদস্যদের অবহেলার কথা উল্লেখ করে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানালেও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রক্টোরিয়াল বডি ও প্রশাসনের দায়ভার কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘটনার দিন ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে প্রক্টোরিয়াল বডির কঠোর অবস্থান থাকলে এমন ঘটনা এত বড় আকার ধারণ করত না এবং নাসিমকে রক্ষা করা যেত বলে অনেকেই মনে করেন। তাছাড়া ঘটনার ৯ দিন পরও নাসিমের উন্নত চিকিত্সার জন্য প্রশাসন তাকে দেশের বাইরে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঘটনার পরও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশাসন ও প্রক্টোরিয়াল বডির অবহেলার বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় নাসিমের পরিবার ছাড়াও অনেকেই বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এটা শুধু একটি দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে প্রশাসনকে বাঁচানো হয়েছে বলে অনেকের অভিমত। তাছাড়া প্রতিবেদনে কাদের ইন্ধনে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল, প্রশাসন ও ছাত্রলীগের সেসব মূল হোতার ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট কোনো ইঙ্গিত করা হয়নি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ও তদন্ত কমিটি : গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ইফতারি ও বিশেষ খাবারের টোকেন ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মী নাসিমকে ব্যাপক মারধর ও ছুরিকাঘাত করার পর শাহ মখদুম হলের দোতলার ছাদ থেকে ফেলে দিলে নাসিম গুরুতর আহত হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় টানা ৯ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন থাকার পর গত ২৩ আগস্ট নাসিমের মৃত্যু হয়। কিন্তু ৯ দিন ঢামেকে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকলেও সরকারের কোনো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সেখানে নাসিমকে দেখতে যাননি। অথচ এর আগে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক নিহত হলে সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের আইজিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা রাজশাহীতে এসে সারাদেশে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে চিরুনি অভিযানের ঘোষণা দেন।
নাসিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৪র্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম অপু গ্রুপের কর্মী। সে শাহ মখদুম (এসএম) হলের ২৫৫ নম্বর কক্ষে থাকত। সে চাঁপাইনবাবঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চকনারন্দ গ্রামের মো. মোসলেম উদ্দিন ও জান্নাতুন নেসা দম্পতির সন্তান।
নাসিমকে দোতলা থেকে নিক্ষেপের ঘটনায় ওইদিন শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক ড. রুহুল আমিনকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন একই হলের আবাসিক শিক্ষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক উজ্জ্বল কুমার আচার্য, মো. বনি আদম ও রওশন জাহিদ। তদন্ত শেষে কমিটি গত ৩১ আগস্ট হল প্রাধ্যক্ষ প্রফেসর দুলাল চন্দ্র রায়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রাধ্যক্ষ ওই প্রতিবেদন গত বৃহস্পতিবার উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আবদুস সোবহানের কাছে প্রেরণ করেন।
প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের ৬ কর্মী চিহ্নিত : তদন্ত প্রতিবেদনে নাসিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৬ ছাত্রলীগ কর্মীকে চিহ্নিত করা হয়। এরা হলো : বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের ছাত্র জহুরুল ইসলাম, সমাজকর্ম বিভাগের ২০০৪-০৫ সেশনের জাহিদুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের ২০০৭-০৮ সেশনের তৌফিকুল ইসলাম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০০৩-০৪ সেশনের লুত্ফর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের রুহুল আমিন এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৪-০৫ সেশনের মশিউর রহমান। এরা সবাই শাহ মখদুম হলের আবাসিক ছাত্র এবং ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মী। চিহ্নিতরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এর আগে নাসিমকে মারধর করে ফেলে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৫ আগস্ট ছাত্রলীগ কর্মী রুহুল আমিন ও সাঈদ আক্তারকে ওই হল থেকে পুলিশ আটক করে। পরে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী ও পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আজম আলী বাদী হয়ে সভাপতি গ্রুপের ১০ নেতাকর্মীর নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করে মতিহার থানায় একটি মামলা করে। মামলার আসামিরা হলো—জাহিদুল ইসলাম (সমাজকর্ম), জহুরুল ইসলাম (মনোবিজ্ঞান), মশিউর রহমান (একই বিভাগ), তৌফিকুল ইসলাম (বাংলা), রুহুল আমিন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), খালেদ হাসান (ব্যবস্থাপনা), ইমতিয়াজ জামান রকি (ভূগোল), সাইদ আক্তার (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) এবং আরিফ (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা )।
তদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয় : তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এসএম হলের আবাসিক ছাত্র মো. জহুরুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলাম ইফতারির কুপন সংগ্রহের জন্য ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট একই হলের কর্মচারী সিদ্দিক হোসেনের কার্যালয়ে যায়। তারা অতিরিক্ত কুপন চাইলে সেখানে আগে থেকে অবস্থানরতদের সঙ্গে নাসিমের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে জহুরুল নাসিমের মাথায় বিশটি গুলি করার ভয় দেখিয়ে কার্যালয় থেকে বের হয়ে যায়। ভয় পেয়ে নাসিম হলের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তার নিজ কক্ষে (নং-২৫৫) যাওয়ার আগেই ২৫৭ নম্বর কক্ষের সামনে জাহিদুল ইসলাম রড দিয়ে নাসিমের বাম চোয়ালে আঘাত করে এবং লুত্ফর হাতুড়ি দিয়ে পেটায়। এসময় জহুরুল ইট দিয়ে পেছন থেকে নাসিমের মাথায় আঘাত করে। তৌফিকুল ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং রুহুল আমিন কিল-ঘুষি মেরে তাকে ধরাশায়ী করে।
এসময় নাসিমের বন্ধু ও সহপাঠী প্রবীর দাশ তাকে উদ্ধার করতে এলে তারা লাথি মেরে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। পরে তারা সবাই একত্রে ধরে গুরুতর আহত নাসিমকে দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়।
প্রশাসনের অবহেলার বিষয়টি উল্লেখ নেই প্রতিবেদনে : এদিকে নাসিমকে মারধর, দোতলা থেকে ফেলে দেয়া এবং ঘটনার ৯ দিন পর ঢামেক হাসপাতালে তার মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসন ও প্রক্টোরিয়াল বডির অবহেলার বিষয়টি সব মহলে গুরুত্ব পেলেও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশাসন ও প্রক্টোরিয়াল বডিকে কোনোভাবেই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়নি। নিহতের পরিবার, বিভাগের শিক্ষক ও সহপাঠীদের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য প্রশাসনের অবহেলার কথা জোরালোভাবে বলা হলেও কৌশলে তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে। তৈরিকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশাসন বিশেষ করে প্রক্টোরিয়াল বডির কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় অনেকেই বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এটা শুধু একটি দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে প্রশাসনকে বাঁচানো হয়েছে বলে অনেকের অভিমত। তাছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়নি।
আজ বিকালে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বৈঠকে নাসিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চিহ্নিত এবং সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খলা, মারামারি ও গোলাগুলির ঘটনায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ হতে পারে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর যে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছি, তা প্রাধ্যক্ষ বরাবর দাখিল করা হয়েছে। তবে ওই প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সুপারিশ করা হলো না কেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আসলে এর আগে এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে। সেখানে অভিযুক্তদের ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
নাসিমের বাবা মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে হত্যাকারী নিষ্ঠুর নরপিশাচদের যদি ছাত্রত্ব বাতিল না করা হয়, তাহলে এটা আমার বেঁচে থাকার জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সুপারিশ নেই—এটা খুবই বেদনাদায়ক।