বর্তমান আওয়ামী লীগ বাকশালের রাজনৈতিক ভাবধারাতেই রয়েছে উল্লেখ করে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, বাকশালের ‘কৃষক-শ্রমিক’ শব্দ দুটি বর্তমান আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত করার কোনো চিন্তা-ভাবনা আমাদের নেই।
তবে, বাকশালের চিন্তা-চেতনা ও দর্শনকে আমরা এখনো ধারণ করি। সব দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে চাই।
গতকাল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে লিখিত বক্তৃতায় তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর সামরিক জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশনের সময় গায়ের জোরে কৃষক-শ্রমিক শব্দ দুটি বাদ দেন। জেনারেল জিয়া এটি করেছিলেন, কারণ কৃষক-শ্রমিককে তারা গোড়া থেকেই শত্রু মনে করেন। কৃষক-শ্রমিক শব্দটি নতুন করে আওয়ামী লীগে যুক্ত করা হবে কী না, এ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে হানিফ বলেন, নতুন করে এটা যুক্ত করার চিন্তা-ভাবনা দলের নেই। তবে, বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান। এ সময় বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে হানিফ বলেন, জাতির জনক ১৯৭৪ সালে বাকশাল গঠন করে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নতুন কর্মসূচি দিয়েছিলেন। তিনি সরকারের বিকেন্দ্রীকরণসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। তার ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সারা দেশে সমভাবে উন্নয়ন হতো। প্রশাসন কেন্দ্রীকরণের জন্য আজ ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে। অপরদিকে পল্লী অঞ্চল অবহেলিত রয়ে গেছে। এসব বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আজ প্রমাণিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করেন, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে যেসব বড় বড় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিটির পেছনে হাওয়া ভবন ও তারেক জিয়ার হাত ছিল।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তারেক জিয়াকে ভয় পায়’ বলে বিএনপি মহাসচিব যে কথা বলেছেন তা একেবারে মিথ্যে নয়। যে ব্যক্তি (তারেক) তার পিতার মতোই ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করতে পারেন, ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু সেই ব্যক্তিকে তো জনগণের ভয় পাওয়ারই কথা। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলাসহ অসংখ্য সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। এহেন একজন ভয়ঙ্কর ব্যক্তি দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুন, তিনি যে চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আবারও নতুন করে পরিকল্পনা করবেন না বা করছেন না একথা কেউই হলফ করে বলতে পারবে না।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় পায় না, তবে হত্যাকাণ্ডের নায়ক বা পরিকল্পনাকারীদের জনগণ কিঞ্চিত্ ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখবে এটাই স্বাভাবিক।
মাহাবুব-উল আলম হানিফ অভিযোগ করেন, বেশ কয়েকদিন ধরে বিএনপির নেতারা অসত্য, অশোভন, বিষোদগার ও মনগড়া বক্তব্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ অপচেষ্টা চালানোর পাঁয়তারা করছেন। এ ধরনের বক্তব্য বিএনপি নেতৃত্বের চরম হতাশা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই প্রমাণ বহন করছে।
তিনি অভিযোগ করেন, জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের কথা এদেশের মানুষ কখনও ভুলবে না। জনশ্রুতি রয়েছে, বিশ্বের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের মেয়ের বিয়েতে বহুমূল্যের ডায়মন্ড উপহার দিয়ে তারেক রহমান তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। অস্ত্র চোরাচালানির একটি ডিলের কথাও প্রচারিত রয়েছে।
দুর্নীতির মাধ্যমে বেগম জিয়ার পরিবার শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের এই সীমাহীন দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের তথ্য যখন বেরিয়ে আসতে থাকে, তখন তারেক এ থেকে বাঁচার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে মুচলেকা-দাসখত দিয়ে রাজনীতি করবেন না মর্মে স্বীকারোক্তি দিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ও তার দুর্নীতিবাজ পুত্রদ্বয়কে রক্ষার জন্য বিএনপিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ খুঁজছে। তারা বলছেন, আরাফাত রহমান কোকো ব্যাংককে চিকিত্সাধীন রয়েছে। অথচ আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে যে কোকো প্যারোলের অপব্যবহারের মাধ্যমে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিবের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন দাবির আগে বিএনপিতে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় বছরের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জনমত যাচাই করে ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় একটি জনমত জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগে ও ২০ শতাংশ বিএনপিকে ভোট দেবেন। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য যখন-তখন নির্বাচনের প্রশ্ন তোলা অগণতান্ত্রিক মনোভাবের লক্ষণ অভিযোগ করে তিনি বলেন, জনগণের সমর্থনেই বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনা করছে। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মতো তথাকথিত জাতীয়তাবাদী নেতার মনে বিভিন্ন সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের খেয়াল চাপতে পারে। তাই বলে যখন-তখন নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচনকে ছেলের হাতের মোয়া ভেবে তা অপব্যবহারের আবদার কখনও গণতন্ত্রসম্মত নয়।
হানিফ বলেন, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন গং খালেদাপুত্র তারেক-কোকোদের পক্ষে এত বেশি সাফাই কেন গেয়ে চলেছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বেগম খালেদা জিয়ার মনোতুষ্টি না থাকলে বিএনপি আঙ্গিনায় নাকানি-চুবানি খাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। বিএনপি নেতাদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মতো ‘একটি অপরাধপ্রবণ পরিবারের’ নির্লজ্জ গুণকীর্তন বাদ দিয়ে নিজেদের এই পরিণতি কেন হচ্ছে তা মূল্যায়ন করে দেখুন।
জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা, রাজনীতিকদের চরিত্র হনন ও দল ভাঙা-গড়ার অপকৌশল এবং অসুস্থ প্রক্রিয়ায় বিএনপি নামক দলটির জন্ম হয়। সেনাছাউনি থেকে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, তার পক্ষে আওয়ামী লীগের মতো দেশ-জনতার প্রাণের দলের পুনরুজ্জীবন কতটুকু সম্ভব? এ ধরনের বালখিল্য উক্তির মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রমাণ মেলে।
বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়ে হানিফ বলেন, খালেদা জিয়া পরিবারের ডজনখানেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে রক্ষা করতে গিয়ে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না। সাধারণ মানুষকে আর কষ্ট দেবেন না। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে তারেক-কোকোসহ দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর অপচেষ্টা করবেন না। দেশ ও জাতিদ্রোহী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকুন। স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতার শত্রু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। সাংঘর্ষিক রাজনীতির ভ্রান্ত পথ ছেড়ে গণতন্ত্রের পথে পথ চলুন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা এদেশের জনগণ আপন ইচ্ছায় রুখে দাঁড়াবে।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিএম মোজাম্মেল হক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, উপ-দফতর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ, কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, আমিনুল ইসলাম আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।