রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ঘটনায় মারাত্মক আহত ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমের জীবন প্রদীপ অবশেষে নিভে গেল। ঘটনার ৮ দিন পর চিকিত্সাধীন অবস্থায় গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। সন্ধ্যায় ঢামেক কর্তৃপক্ষ নাসিমের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। গত ১৫ আগস্ট শোক দিবসে ইফতারির টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি আওয়াল কবির জয় গ্রুপের কর্মীরা মারধর ও ছুরিকাঘাতের পর শাহ মখদুম (এসএম) হলের দোতলার ছাদ থেকে নাসিমকে ফেলে দিলে সে মারাত্মক আহত হয়। ঘটনার দিনই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সর্বশেষ তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল। গতকাল বেলা ২টার দিকে নাসিমের মৃত্যুর খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাসিমের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে।
নাসিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম অপু গ্রুপের কর্মী। সে শাহ মখদুম (এসএম) হলের ২৫৫ নম্বর কক্ষে থাকত। সে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চরকীর্তি গ্রামের মোসলেম উদ্দিন ও জান্নাতুন নেসা দম্পতির সন্তান।
এদিকে নাসিমের মৃত্যুর খবরে দুপুর থেকেই রাবি ক্যাম্পাসে উত্তেজনা শুরু হয়। দুপুরে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতি গ্রুপের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করে আত্মগোপন করতে শুরু করে। সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের নেতাকর্মীরা আবাসিক হলসহ পুরো ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে দুপুরের পর থেকে ক্যাম্পাসের প্রবেশপথ, সব আবাসিক হলের প্রধান গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্যাম্পাসে বহিরাগত সব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ঘটনার দিন যা ঘটেছিল : ১৫ আগস্ট শোক দিবস উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশে অন্যান্য আবাসিক হলের মতো এসএম হলেও ইফতারি ও বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। ইফতার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য ওইদিন সকাল থেকে হল প্রশাসনের উদ্যোগে বিশেষ টোকেন বিতরণ করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রলীগের সভাপতি আওয়াল কবির জয় গ্রুপের রুহুল আমিন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষ), সাঈদ আক্তারকে (রাষ্ট্রবিজ্ঞান চতুর্থ বর্ষ), জাহিদ হোসেন (সমাজকর্ম শেষ বর্ষ), জহুরুল ইসলাম (লোকপ্রশাসন মাস্টার্স), মশিউর রহমান (মনোবিজ্ঞান মাস্টার্স) ও তৌফিকসহ ১০-১২ জন নেতাকর্মী হলের সেকশন অফিসার সিদ্দিকুর রহমানের কাছে ১০-১২টি টোকেন দাবি করে। এ সময় সেখানে অবস্থান করছিল নাসিম। সেকশন অফিসার ইফতারির টোকেন নিতে হল প্রাধ্যক্ষের অনুমতি লাগবে জানালে নাসিম তাতে সমর্থন করে। এতে সভাপতি গ্রুপের কর্মীদের সঙ্গে নাসিমের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তারা নাসিমকে হলের দোতলায় নিয়ে ব্যাপক মারধর ও ছুরিকাঘাতের পর দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। এতে নাসিমের মাথা ফেটে যায় এবং বুক, পেট ও মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাত পায়। পরে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
ওইদিনই এসএম হলে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ রুুহুল আমিন ও সাঈদ আক্তারকে আটক করে। পরে সাধারণ সম্পাদক গ্রুুপের ছাত্রলীগ কর্মী ও পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আজম আলী বাদী হয়ে সভাপতি গ্রুপের ১০ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে মতিহার থানায় একটি মামলা করে।
মুমূর্ষু অবস্থায় ৮ দিন : ১৫ আগস্ট নাসিমকে মুমূর্ষু অবস্থায় রামেক হাসপাতালে ভর্তি করে সিটিস্ক্যান করার পর কর্তব্যরত ডাক্তার জানান, নাসিমের মাথায় মারাত্মক আঘাতের ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এতে মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। পরে সেখান থেকে তাকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে প্রথমাবস্থায় চিকিত্সার পর নাসিমের অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও ঘটনার ৫ দিন পর গত শনিবার থেকে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নাসিমের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। চিকিত্সার প্রাথমিক দিকে জমাট বাঁধা রক্ত ভাঙতে থাকে। কিন্তু পরে রক্ত ভাঙার বদলে নতুন করে জমাট বাঁধতে শুরু করে; যা রোগীর জন্য নেগেটিভ। ক্রমেই অবস্থার অবনতি হলে শনিবার মাথায় অপারেশন করার পরেও নাসিমের শরীরের কোনো অংশই সঠিকভাবে কাজ না করলে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়। সর্বশেষ গতকাল আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেয় নাসিম।
দায় এড়াতে পারে না রাবি প্রশাসন : নাসিমের সহপাঠীদের অভিযোগ, নাসিমের এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘটনার দিন টোকেন বিতরণ নিয়ে হল প্রশাসনের অবহেলা, টোকেন বিতরণের দায়িত্ব ছাত্রলীগের হাতে দেয়া এবং টোকেন নিয়ে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি প্রশাসন কঠোর হাতে দমন করেনি। তাছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারেও প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নাসিমের সহপাঠী ও ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে কয়েক দফা মানববন্ধন, সমাবেশ ও ভিসিকে স্মারকলিপি দিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও মুমূর্ষু নাসিমের সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করার দাবি জানালেও প্রশাসন সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নাসিমের সহপাঠী জসিম উদ্দিন, আবুযর গিফারী, সেতু, ফারুকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র বলেন, প্রশাসন নাসিমের সুচিকিত্সার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে হয়তোবা তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো। বারবার প্রশাসনকে সে ব্যাপারে অবহিত করার পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে তাদের অভিযোগ। তারা অবিলম্বে নাসিমের হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া বলেন, যারা নাসিমকে দোতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে তারা মানুষ হতে পারে না। তারা অমানুষ। জড়িতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নাসিমের চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হয়নি বলে ছাত্ররা যে অভিযোগ করেছে তা সত্য নয় বলে তিনি দাবি করেন।