ফুটবলের ভালো গোলরক্ষক হিসেবে এলাকায় ব্যাপক সুনাম ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী নাসিরুল্লাহ নাসিমের। খেলায় বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের অসংখ্য গোল ঠেকিয়ে নিজ দলকে অনায়াসে জেতালেও জীবনযুদ্ধে তিনি আর নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় আহত নাসিম ৯ দিন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সোমবার মারা যান। আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের বুকফাটা আহাজারি এবং শত শত মানুষের অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় গতকাল সকালে নাসিমকে দাফন করা হয় তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চকনরেন্দ্র গ্রামে। আর এর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল একটি স্বপ্নের। নিজের প্রিয় সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় নিহত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই শেষ হয়ে গেল তার। গতকাল সকাল ১০টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চককৃত্তি ইউনিয়নের চকনরেন্দ্র ফুটবল মাঠে নাসিমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় রাবির শিক্ষক, ছাত্রসহ নাসিমের নিজ এলাকার অসংখ্য মানুষ অংশ নেয়। এখানে রাবির ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. চিত্তরঞ্জন মিশ্র, একই বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল কাশেম ও নাসিমের বাবা মোসলেম উদ্দিন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তার বাবা মোসলেম উদ্দিন বলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদই তার ছেলের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি দুর্বৃত্তপনা ও সন্ত্রাসের ছাত্র রাজনীতি প্রতিহত করার জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার ছেলে কী এমন অপরাধ করেছিল? যার জন্য তাকে এত নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো। পরে তিনি নিজেই ছেলের জানাজার ইমামতি করেন। জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয় তাকে। এর আগে রাতে নাসিমের লাশ তার গ্রামের বাড়ি চকনরেন্দ্রপুরে আনা হলে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। মা-বাবা, স্বজনসহ রাজশাহী থেকে আসা সহপাঠীদের কান্নায় পুরো এলাকা ভারী হয়ে ওঠে। এ সময় এলাকাবাসী নাসিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে। গতকাল দাফন শেষ হওয়ার পর নাসিমের বাড়িতে আরেক দফা হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রিয় বন্ধুকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার পর কিছুতেই যেন কান্না ধরে রাখতে পারছিল না রাবির ইতিহাস বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্রছাত্রীরা। সেখানেই কথা হয় নাসিমের সহপাঠী আবু রেজওয়ানের সঙ্গে। তিনি জানান, মাত্র ৩ মাস আগে নাসিম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সবার সঙ্গেই ছেলেটি খুব সহজেই মিশতে পারতেন। অথচ প্রতিপক্ষ অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন নয়, তার দলের ক্যাডারদের হাতেই আজ তাকে প্রাণ দিতে হলো। একই ক্লাসের ছাত্রী শোভনীয় খাতুনের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করতেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শুধু এটুকুই বললেন, এভাবে অপরাজনীতির বলি হয়ে আমরা আর কোনো বন্ধুকে হারাতে চাই না। তবে শোকের মধ্যেই বন্ধুর খুনিদের বিচার করার দাবির কথাটি কিন্তু বলতে ভুলেননি তিনি। তিনি বলেন, যারা নাসিমকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে, আমরা তাদেরও পৃথিবীতে দেখতে চাই না। এসএম হলের ২৫৫ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র নাসিমের রুমমেট মিঠু হাওলাদারও কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এ মৃত্যু। তিনি জানান, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা নাসিমকে পিটিয়ে দোতলার ছাদ থেকে ফেলে দেয়। এমন অপরাজনীতির অবসান চান তারা। তিনি রাবি প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, এভাবে একের পর এক ছাত্র লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলে বাবা-মারা কার ভরসায় সন্তানদের লেখাপড়া করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন?
রাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা জানান, গত এক বছরে ৩ ছাত্র নিহত হলেও প্রশাসন নীরব। নাসিমকে হলের ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার পর ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করায় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা তাদের হুমকি দিচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে নির্বাক হয়ে পড়েছেন স্কুলশিক্ষক বাবা মোসলেম উদ্দিন ও মা জান্নাতুন নেসা। জান্নাতুন নেসা বলেন, ১৫ আগস্ট ঘটনার আগের দিন মোবাইলে শেষ কথা হয় নাসিমের সঙ্গে। বলেছিল ৫/৭ দিন পরই বাড়ি আসবে। এসেছেও তাই, কিন্তু লাশ হয়ে। তিনি বলেন, ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। আর বছরখানেক বাদেই লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢোকার কথা ছিল নাসিমের। কিন্তু আমাদের সবই তো শেষ হয়ে গেল।
উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ইফতার পার্টির টোকেন বিতরণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি জয় গ্রুপের ক্যাডাররা রড দিয়ে পেটানোর পর শাহ মখদুম হলের দোতলা থেকে নাসিমকে ফেলে দেয়। ৯ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সোমবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান নাসিম।