বার ঈদের কাপড়ের বাজারের ৭০ ভাগই দখল করে নিয়েছে বিদেশি পোশাক। এর মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে আছে ভারত। বিদেশি শাড়ি ও থ্রিপিসের প্রায় সবই ভারতের। আর কিছু থ্রিপিস আসে পাকিস্তান থেকে। অন্যদিকে গেঞ্জি, টি-শার্ট ও জুতোর বাজার দখল করে আছে চীন। এছাড়া থাইল্যান্ড ও দুবাই থেকে কিছু কাপড় এসেছে। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব মার্কেট, শপিংমলে এসব কাপড়ই বিক্রি হচ্ছে। বড় বড় শপিংমল, ওয়ানস্টপ মল ও অভিজাত এলাকার বুটিক শপগুলোতে দেশি কাপড় প্রায় নেই বললেই চলে। সরেজমিন ঘুরে এবারের ঈদবাজারের এসব তথ্য জানা যায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর ঈদের অর্ধেক দেশি ও অর্ধেক বিদেশি কাপড় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার গতবারের চেয়ে শতকরা ২৫ ভাগ বেশি কাপড় আমদানি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিদেশি কাপড়ের বিক্রি গত ঈদের চেয়ে শতকরা ১৫ ভাগ বেশি বেড়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিভিন্ন ব্যাংকের কম সুদে উত্সব লোন সুবিধা, শুল্ক না বাড়া ইত্যাদি কারণে কাপড় বেশি আমদানি করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া চোরাই পথেও আসছে অনেক ভারতীয় কাপড়। যদিও কুমিল্লাসহ দেশের সীমান্ত এলাকাগুলো থেকে সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিস উদ্ধার করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানাভাবে ভারতীয় কাপড় দেশে ঢুকছে।
ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মো. হেলালউদ্দিন বলেন, এবার ঈদের কাপড়ের শতকরা ৭০ ভাগই বিদেশি। বিশেষ করে শাড়ি-থ্রিপিসসহ মেয়েদের কাপড়ের অধিকাংশই ভারতের। এসব কাপড়ের চাহিদাও সর্বাধিক। আর ছেলেদের গেঞ্জি ও জুতোর প্রায় সবই চীনের। যেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টের কাপড় ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ পরছে, পোশাকখাত থেকে জাতীয় রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ আসে। সেখানে এ দেশের ঈদের কাপড়ের বাজার দখল করে আছে ভারত। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. হেলালউদ্দিন বলেন, আমাদের গার্মেন্ট শিল্প থেকে যে সাইজের ও মানের কাপড় রফতানি করা হয় সেগুলো এ দেশের মানুষের উপযোগী নয়। কারণ ইউরোপীয় মানুষের শারীরিক গঠন অনুযায়ী গার্মেন্টে কাপড় তৈরি করা হয়। এ দেশের মানুষের জন্য যেসব গার্মেন্ট কারখানা কাপড় তৈরি করে সেগুলো পুরো চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
এছাড়া সুতি কাপড়ের মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন মাঝামাঝি অবস্থানে আছে। কিন্তু জর্জেটের মতো সিনথেটিক কাপড়ের মান এখন পর্যন্ত ভালো করতে পারেনি। এদিকে ঈদে সবাই সিনথেটিক ও জমকালো কাজের কাপড় বেশি পছন্দ করে। যার কারণে বিদেশি কাপড়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের। তাছাড়া এ দেশের মানুষের মধ্যে বিদেশপ্রীতি রয়েছে। এ দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় সবাই বিদেশি কাপড় পরেন। তাদেরই অনুসরণ করে সবাই। এছাড়া ভারতীয় চলচ্চিত্র ও বিভিন্ন সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা যেটা পরেন সেটাই কিনতে চান এ দেশের মানুষ।
এলসির মাধ্যমে আমদানি করে এনে সারাদেশে বিদেশি কাপড় সরবরাহের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে গাজী ভবন শপিং সেন্টার ও পলওয়েল মার্কেট। পাইকারি বাজার হলেও খুচরা ক্রেতারও কমতি নেই এখানে। এ দু’টি মার্কেটে গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বিদেশি কাপড় কিনতে অসংখ্য ক্রেতা ভিড় জমিয়েছেন। কাপড়ের স্তূপ ও ক্রেতার ভিড়ে মার্কেট দু’টির ভেতর চলাচল করাই কষ্টদায়ক। বেশিরভাগ দোকানেই ঢোকার উপায় নেই। ভিড়ের কারণে বাইরে দাঁড়িয়েই কাপড় পছন্দ করছেন। বিক্রেতাদেরও দম ফেলার ফুরসত নেই। ক্রেতাদের চাপেই খুচরা বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এভাবে পাইকারি ও খুচরা সমান তালে বিক্রি চলবে বলে জানান তারা।
প্রায় ২০ বছর ধরে কাপড় ব্যবসার সঙ্গে জড়িত গাজী ভবন শপিং সেন্টারের জেএস এন্টারপ্রাইজ ও বুশরা এন্টারপ্রাইজের মালিক আহমেদুল কবির জাকির বলেন, এ বছর অন্যবারের চেয়ে বিদেশি কাপড়ের চাহিদা অনেক বেড়েছে। তাই এর পাইকারি বিক্রিও শুরু হয়েছে আগেভাগে। শবেবরাত থেকেই এখানে ঈদের কাপড় বিক্রি শুরু হয়েছে। বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, ইস্টার্ন প্লাজা, মাসকট প্লাজাসহ রাজধানীর সব বড় বড় মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কাপড় কিনে নিয়ে গেছেন। চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়া, খুলনাসহ দেশের সব অঞ্চলের বড় ব্যবসায়ী এসেও কাপড় কিনে নিয়ে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজী ভবনে ১৫০টি ও পলওয়েল মার্কেটে প্রায় ৫০০টি দোকান রয়েছে। এই মার্কেটের সব ব্যবসায়ীই ভারত, পাকিস্তান, চীন, দুবাই ও থাইল্যান্ড থেকে কাপড়, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি এলসির মাধ্যমে আমদানি করে আনেন। পরে এখান থেকে রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পাইকারিভাবে কাপড় কিনে নিয়ে যান। এ দু’টি মার্কেটের অনেক ব্যবসায়ীই আবার কেরানীগঞ্জে আলাদা শোরুম করেছেন। আমদানি করা কিছু কাপড় তারা সেখানে নিয়ে যান। সেখান থেকেই পাইকারিভাবে বিক্রি করেন। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত শতকরা ৬০ ভাগ বিক্রি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২০ রোজার মধ্যে বাকিটা সম্পন্ন হওয়ার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে স্বল্প বিনিয়োগের ব্যবসায়ীরা ঈদের দু’দিন আগ পর্যন্ত পাইকারিভাবে কাপড় নিয়ে যান।
এছাড়া বিভিন্ন শপিংমলের বড় কাপড় ব্যবসায়ীরা নিজেরাও এলসি খুলে কাপড় আমদানি করেন। গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ড, বাসাবী, জারা, নাবিলা ইত্যাদি বড় বড় ওয়ানস্টপ মলের মালিকরাও বিভিন্ন দেশে গিয়ে পছন্দ করে মানসম্পন্ন কাপড় আমদানি করেন। যার কারণে তাদের আনা কাপড়ের দাম অনেক বেশি। এসব শোরুমে দেশি কোনো কাপড় থাকে না।
গাজী ভবন ও পলওয়েল মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ীরা এত বেশি কাপড় আনেন যে, মান, নকশা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করার সুযোগ থাকে না। গড়ে পণ্য কিনে আনেন। এগুলোর পাইকারি দামও তুলনামূলকভাবে অনেক কম থাকে। পাইকারিভাবে কাপড়ের দাম ৪৮০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা এই কাপড়গুলোই ক্রেতা বুঝে এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত লাভে বিক্রি করেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশি কাপড়ের চাহিদা বেশি হলেও মানের দিক দিয়ে এখন বাংলাদেশের কাপড় অনেক ভালো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি কাপড়ের মান অনেক খারাপ থাকে। তারপরও শুধু বিদেশি হওয়ার কারণেই ক্রেতারা সেটা কিনে নেন।
দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর সংগঠন ফ্যাশন উদ্যোগের সদস্য ও বুটিক হাউস অঞ্জনসের প্রধান নির্বাহী শাহীন আহম্মেদ বলেন, বাংলাদেশে এখন এত বেশি কাপড় তৈরি হচ্ছে যে বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন নেই। ক্রেতাদের বিদেশি কাপড় পরার প্রতি আগ্রহের কারণেই মূলত এখন ব্যবসায়ীরা আমদানি করেন। এ আমদানি করা কাপড়গুলো ভারত বা অন্য যে কোনো দেশের হোক না কেন সেগুলো সেখানকার পাইকারিভাবে তৈরি করা। এগুলোর দাম খুব বেশি না হলেও বিক্রেতারা ধনী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে আসল দামের চেয়ে বহুগুণ বাড়িয়ে বিক্রি করেন। বিদেশের ডিজাইনারদের তৈরি কাপড় সাধারণত আমদানি করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ফ্যাশন হাউসগুলোতে যেসব কাপড় বিক্রি হয় সেগুলো সবই ডিজাইনারদের তৈরি। তারপরও ডিজাইনারদের ও পাইকারিভাবে তৈরি কাপড়ের দামের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ১০০ টাকার বেশি পার্থক্য হয় না। ঈদের কাপড়ের শতভাগ যেন দেশের হয় সেই চিন্তা করেই ফ্যাশন হাউসগুলো স্থানীয় পাইকারি বাজারের চেয়ে খুব বেশি দাম নির্ধারণ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের আশপাশেরসহ বিশ্বের সব উন্নত দেশেই ডিজাইনারদের কাপড়ের দাম পাইকারিভাবে তৈরি পণ্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।