এই ব্লগে মাঝে মধ্যেই কিছু পোস্ট দেখা যায় : সুদূর অতীতের পার্শিয়ান -আরবদের কিছু গৌরব গাথায় কিছু অধুনা বাঙালী মুসলমানরা অতীব পুলক বোধ করেন। আমাদের মুসলমান জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছিলো ---ইত্যাদি ইত্যাদি !! আমি বুঝে উঠতে পারিনা মুসলিম জাতিটা কি জিনিস? এটা খায় না মাথায় মাখে ? একজন আরবী অথবা পার্শিয়ানএর সাথে একজন বাঙালী মুসলমান কি অর্থে এক জাতি ? জেনেটিক্যালি , কালচারালি ,ভাষা ,খাদ্য --কি সুবাদে ?
শুধুমাত্র ধর্ম এক হলে পৃথিবীর দু-প্রান্তে দু জন মানুষ এক জাতি হয়ে যায় ? হাস্যকর !
আজ থেকে মোটমুটি ৯০০-১২০০ বছর আগে কিছু কিছু পার্শিয়ান-আরব ব্যক্তি সাইন্স ,ম্যাথমেটিক্স ,জ্যোতির্বিজ্ঞান ,জিওগ্রাফি ,পোয়েট্রি ইত্যাদিতে জবরদস্ত অবদান রেখেছিলেন। ঘটনা চক্রে তাঁরা মুসলমান ছিলেন। জ্ঞানচর্চার জন্য অনেকেই তাঁদের জীবদ্দশায় কাফের ইত্যাদি উপাধি পেয়েছিলেন , বন্দী ছিলেন।
ওমর খৈয়াম (জন্ম ১০৪৮ খ্রীষ্টাব্দ ) তৎকালীন পারস্য ,অধুনা ইরানে জন্মে ছিলেন। পার্শিয়ান ছিলেন। তিনি একাধারে প্রথিতযশা ম্যাথমেটিশিয়ান , জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কবি ছিলেন।আরবের ইসলাম তখন হুহু করে পারস্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানকার পার্সিদের মধ্যে যারা ধর্ম পরিবর্তন করতে চায় নি তাদেরকে হত্যা অথবা বিতাড়িত করা হয়েছিল। পার্সিদের অধিকাংশ ভারতে চলে আসে , যারা আসে নি তাদের ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল। ওমর খৈয়ামএর পিতা পার্সি ছিলেন ,ভয়ে হোক ,ভক্তিতে হোক ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ওমর খৈয়াম ছোট থেকে মেধাবী ছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন গ্রীক ম্যাথমেটিশিয়ান ইউক্লিড ,এপেলোনিয়াস প্রভৃতি বিজ্ঞানীর কাজকর্ম জানার সুযোগ পেয়েছিলেন। অঙ্কশাস্ত্রে এনার অবদান স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে।
এনার ধর্মীয় এবং দার্শনিক মতবাদ কি ছিল ? বিখ্যাত ইজিপ্টিয়ান আরব স্কলার এবং লেখক আল জিফিটি (Al -Gifity --১১৭২-১২৪৮ খ্রীষ্টাব্দ ) তাঁর বিখ্যাত বই The History of Learned Men এ লিখেছেন : খৈয়াম আন্টি-রিলিজিয়াস, সংশয়বাদী এবং নাস্তিক (Atheist ) ছিলেন।
আল-বিরুনী ( জন্ম : ৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দ ) আর এক প্রখ্যাত অঙ্কশাত্রবিদ , জ্যোতির্বিজ্ঞানী ,ভূগোল ,ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিদ ছিলেন। ইনিও পার্শিয়ান। ধর্মের দিক থেকে শিয়া মুসলিম। দশম শতাব্দীর শেষদিকে ইসলামিক গৃহযুদ্ধের কারণে তাঁকে দীর্ঘ সময় পালিয়ে অথবা আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। পরের দিকে তিনি গজনীর সুলতান মাহমুদের হাতে তিনি প্রায় এক রকম বন্দি হন। মামুদের রাজসভায় তাঁকে বাদশা সম্পর্কে ভাল ভাল কথা (sooth sayer ) বলার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। মামুদের ভারত আক্রমণের সময় তাঁকেও ভারতে নিয়ে আসা হয়। এখানে আসার পর তিনি সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। মামুদ যদিও তাঁকে পরের দিকে জ্ঞানচর্চায় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কিন্তু মামুদের জীবদ্দশায় তিনি পুরোপুরি স্বাধীনতা পান নি।
ইবনে সিনা ( জন্ম :৯৮০ খ্রীষ্টাব্দ ) আর এক বিখ্যাত পার্শিয়ান। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর অবদান অসাধারণ। তৎকালীন মোল্লারা তাঁকে কাফের ডাকতো --মেটা ফিজিক্স এ তাঁর আগ্রহের কারণে।
আল-খোয়ারিজমি ( জন্ম :৭৮০ খ্রীষ্টাব্দ ) --এনাকে আধুনিক বীজগণিতের জনক বলা হয়। ইনিও পার্শিয়ান। জীবনের প্রথম দিকে জোরাস্ট্রিয়ান অথবা পার্সি ধর্মাবলম্বী ছিলেন ,পরের দিকে ধর্মান্তরিত হন।
আল -ফারাবী ( জন্ম :৯৮০ খ্রীষ্টাব্দ ) ইনি পার্শিয়ান মতান্তরে তুর্কী ছিলেন। ইনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ,দার্শনিক ,যুক্তিবিদ এবং সুরকার ছিলেন।
জাবির ইবনে হাইয়ান ( জন্ম: ৭২২ খ্রীষ্টাব্দ ) পার্শিয়ান , ইসমাইলি শিয়া মুসলিম , কেউ কেউ তাকে আরবও বলেন। ছিলেন একধারে বিখ্যাত রসায়নবিদ , পদার্থবিদ ,চিকিৎসক ইত্যাদি।
ওপরে বর্ণিত বিখ্যাত ব্যক্তিগণ ছাড়াও আরও কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সেই সময়ে মধ্যপ্রাচে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিলেন। এদের অধিকাংশ পার্শিয়ান ছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে এনারা অথবা এনাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন জোরাস্ট্রিয়ান অথবা পার্সি। বাকীরা ছিলেন আরব অথবা তুর্কি। অতীতের ইতিহাস যদি দেখা যায় তা হলে দেখবেন প্রাচীন ভারত , গ্রিস এবং পারস্য জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস ছিল।
আমার হাসি পায় যখন দেখি কিছু বাঙালী মুসলমানেরা ওই সকল পার্শিয়ান -আরবি-তুর্কী বিজ্ঞানীদের গর্বে গর্বিত হয়ে শুরু করে : আমরা মুসলমানরা এই ছিলাম। ..ওই ছিলাম। ..আমাদের মুসলমান জাতির গর্বের ইতিহাস ইত্যাদি ইত্যাদি .....!
ঘটনা হচ্ছে আজকের বাঙালী মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা কেউই সেই সময় মুসলমান ছিলেন না। বাংলায় ইসলামের প্রচার শুরু হয় হযরত শাহ জালালের হাত ধরে মোটামুটি ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের পরে। ১৩০৩ সালে তাঁর সিলেটে আগমন। তাঁর প্রভাবে ধীরে ধীরে ইসলাম ছড়াতে থাকে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল। পরবর্তী প্রায় ৫০০ বছরে ইসলাম বাংলায় ছড়িয়েছে। এর নানা কারণ ছিল। হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেম , জমিদারদের নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার , মুসলমানদের মধ্যে অধিক জন্মহার ইত্যাদি ইত্যাদি। আগে যেটা লিখলাম- এই হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া একদিনে হয় নি --এটা অনেক কারণে এবং ধীরে ধীরে হয়েছে। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা জানাচ্ছে ১৮৭৫ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অথবা অধুনা বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান ছিল না। ১৮৯০ এর পর থেকে মুসলিমরা সংখ্যায় হিন্দুদের ছাড়িয়ে যায়।
যাইহোক , আমার কথা হল আজকের বাঙালী মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা জেনেটিক্যালি, কালচারালি ভারতীয় ছিল যেমন ওমর খৈয়াম ,ইবনে সিনা পার্শিয়ান ছিল।
আজকের ইরানীরা ,আরবরা , তুর্কীরা ওনাদের গর্বে গর্বিত হতে পরে কিন্তু আমাদের বাঙালী মুসলমানরা গর্বিত --কিভাবে এবং কেন ?
একবার টিভি টক্ শোয়ে এক আরবী মুসলমানকে এক পাকিস্তানীকে দাবড়ে দিতে দেখেছিলাম। পাকিস্তানীটা বলেছিলো : আমরা মুসলমানরা স্পেন জয় করেছিলাম !!
আরবী বললো : ইউ স্টুপিড , আমরা আরবরা স্পেন জয় করেছিলাম।
মোদ্দা কথা হলো একই ধর্মের অনুসারী হলেই কেউ এক জাতি হয়ে যায় না। একজন রোমের খ্রিস্টান এবং বাংলাদেশের খ্রিস্টান এক জাতি নয়। একজন ভারতীয় হিন্দু এবং একজন ইন্দোনেশিয়ার হিন্দু এক জাতি নয়। একজন বাংলাদেশী মুসলমান এবং এক আরবী /পার্শিয়ান মুসলমান এক জাতি নয় , কারণ জেনেটিক্যালি ,কালচারালী , ভাষায় কোনো সাদৃশ্যই নেই। ধর্ম যদি এক জাতি তৈরি করতো তাহলে ভারত নেপাল একদেশ -একজাতি হত , বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে হতো না , মধ্যপ্রাচ্যের ওই অতগুলো দেশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ইরানি/আরবী /তুর্কীতে ভাগ হয়ে একে অন্যের গর্দান কাটাকাটি করতো না।
আরও উদাহরণ দেব??
একজন বাঙালী মুসলমান যুবক মধ্যপ্রাচের কোন মুসলিম দেশে --তা আরব /ইরান যাই হোক , ৩০ বছর কাজ করার পরেও সেখানকার নাগরিকত্ব পেতে পারে না , সেখানে জায়গা জমি/ঘর বাড়ী কিনতে পারে না , সেখানকার মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি নেই ,কোনো রাজনৈতিক কাজকর্ম করার অধিকার নেই। মুসলিম -মুসলিম ভাই বিরাদরীর এবং জাতির কি অবস্থা! এই সামান্য জিনিসগুলোতেই যদি না অধিকার থাকে তাহলে তাদের সুদূর অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে ধুয়ে খাবেন !
আবার দেখুন ওই একই মুসলমান যুবক কাফির -নাসারা -নাস্তিকদের দেশ আমেরিকা ,কানাডা , ইউরোপ , অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে বৈধ /অবৈধ ভাবে গিয়ে সেখানকার নাগরিকত্ব পেতে পারে , সেখানকার মেয়েদের ধর্মান্তরিত করে বিয়ে অথবা বিয়ে করে ধর্মান্তর --দুটোই করতে পারে। আল্লার ওয়াস্তে একাধিক বাচ্ছা পয়দা করে সেখানকার ট্যাক্স-দাতাদের অর্থে সোশ্যাল -সিকিউরিটি বেনিফিট নিতে পারে এবং ভবিষ্যতে কোনো একদিন জনসংখ্যা বাড়িয়ে ওগুলোকে ইসলামিক মুলুক বানিয়ে শরিয়া আইন চালু করার খোয়াব দেখতে পারে।সেখানকার কাফির সরকার এবং জনগণ ডাইভার্সিটি /প্লুরালিজম /সেক্যুলারিজম এর নামে এই সবকিছুই বরদাস্ত করে।
কয়েকমাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প টেরোরিজম এর কারণে কিছু মুসলিম দেশগুলিকে সাময়িক ভাবে ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছিল। সমস্ত মুসলিম বিশ্ব এর প্রতিবাদ করেছিলো ---এদের থেকেও বেশি করেছিলো খোদ আমেরিকানরা। আবার উল্টোদিকে দেখুন প্রায় একই সময়ে মধ্যপ্রাচের ধনী আরবদেশ কুয়েত আট টা মুসলিম দেশকে পার্মানেন্টলি ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের কোন প্রতিবাদ দেখেছেন?? মুসলিম বিশ্বের কোনো প্রতিবাদ ? মুসলিম- মুসলিম এক জাতি হওয়ার কি জ্বালা ! সামান্য প্রতিবাদ টুকুও নেই !
যাইহোক , মুসলমান জাতি ইত্যাদি ধুয়ে জল এবং রঙ্গীন পানি-- দুটোই পান করা বন্ধ করুন !!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩১