বর্তমান আফগানিস্তানের মহাকাব্যিক ইতিহাস শুরু হয় যখন এটা প্রাচীন ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল অথবা মহাজনপদ গান্ধার নামে পরিচিত ছিল।
প্রাচীন গান্ধারই আজকের আফগানিস্তানের কান্দাহার এবং পাকিস্তানের পেশোয়ার ,সোয়াট পাখতুনখোয়া অঞ্চল।
প্রায় ২৫০০ বছর আগে গান্ধার ছিল শিক্ষায় ,কলায় এবং ব্যবসায় বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সেন্ট্রাল এশিয়া ,পারস্য এবং প্রাচীন ভারতের সাথে যোগাযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডরুট।
পাহাড়ে ঘেরা গান্ধারের আনাচে কানাচে, পেশায়ারে, কাবুলের কাছে বেগরাম এবং হাভ শহরে, বর্তমান কাশ্মীরের হারোয়ানে এবং পাঞ্জাবের তক্ষশীলায় আজও বহু গান্ধার শিল্পের উদাহরণ খুজেঁ পাওয়া যায়। গান্ধারের মূল শহরগুলো ছিল পুরুষপুর (যা আজকের পেশোয়ার) ,তক্ষশীলা এবং পুষ্কলবতী।
প্রথমদিকে পুষ্কলবর্তী ছিল গান্ধারের রাজধানী যা পরবর্তীকালে পেশোয়ারে সরিয়ে নেয়া হয়। কাবুল নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল পুষ্কলবর্তী।
গান্ধারের প্রধান শহর বা রাজধানী ছিল তক্ষশীলা যা দেশভাগের পর আজকের পাকিস্তানে।
মাইথোলজিতে গান্ধার :
গান্ধার রাজকুমারী গান্ধারি কে আমরা দেখতে পাই মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী এবং কুরু বংশের শতপুত্রের জননী হিসাবে। মহাভারতের আরেক চরিত্র শকুনি এনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।
মাইথোলজি অনুযায়ী রামের পুত্র লব থেকে আজকের পাকিস্তানের লাহোর এবং রাজা ভরতের পুত্র তক্ষক থেকে তক্ষশিলার নামকরণ।
আবার তক্ষশীলা নামটি রামায়ণে পাওয়া যায় এভাবে- ভরতের দুইপুত্র তক্ষ ও পুষ্কল এই গান্ধারে এসে দুটি নগরী পত্তন করেছিলেন, যাদের নামানুসারে তক্ষশীলা ও পুষ্কলবতী।
মহাভারতের পান্ডব কৌরবদের মধ্যে লড়াই হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে যা এখন উত্তর পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত। হিন্দুরা বিশ্বাস করে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন গীতা নাজিল হয়েছিল। আজকের দিল্লী তখন পরিচিত ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ হিসাবে।
যাইহোক , মাইথোলজি ছেড়ে এখন প্রাচীন ইতিহাসে প্রবেশ করা যাক। বিদেশী শক্তি হিসাবে গান্ধার প্রথম আক্রমণ করে আলেকজান্ডার খ্রিস্ট পূর্ব ৩২৯ এ। অনুমান করা হয় এরও কয়েক শো বছর আগে মহাভারত লেখা হয়। রামায়ণ লেখা হয় আরো আগে।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ প্রমাণিত ঐতিহাসিক ঘটনা। আলেকজান্ডারের পর গান্ধার দখলে আসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের। সময়টা তখন খ্রিস্ট পূর্ব ৩০৫ । চন্দ্রগুপ্তের প্রধান পরামর্শদাতা ছিল চাণক্য।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য :
ভারতের বর্তমান আয়তনের থেকেও বিস্তৃত ছিল মৌর্য সাম্রাজ্য।
একে অবশ্য আরো বিস্তার দেয় তার পৌত্র অশোক। বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। চন্দ্রগুপ্ত থেকে অশোক হয়ে কণিষ্কের সময় পর্যন্ত গান্ধার শিক্ষায় , শিল্পকলায় ,নৃত্যশিল্পে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে যে উন্নতির শিখরে আরোহন করে তার পতন ঘটে পঞ্চম থেকে নবম /দশম শতকের মধ্যে। কারণ পরে উল্লেখ করছি।
বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশীলা
খ্রিষ্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে স্থাপিত তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতির শিখরে ওঠে মৌর্যদের আমলে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান পরামর্শ দাতা চাণক্য এক সময় তক্ষশীলার আচার্য্য ছিল। ছাত্রর সংখ্যা ছিল দশ হাজারের ওপরে।
ভারতের অন্যানো অঞ্চল ছাড়াও ছাত্ররা আসতো ব্যাবিলন ,গ্রীস ,পারস্য এবং চীন দেশ থেকে। পড়ানো হতো ভাষা ,গ্রামার , দর্শন, চিকিৎসা শাস্ত্র ,সার্জারী ,রাজনীতি ,অ্যাস্ট্রোনমি ,বাণিজ্য ,অঙ্কশাস্ত্র এবং সংগীত বিদ্যা ইত্যাদি।
বিভিন্ন সময়ে সেখানে পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন অর্থশাস্ত্র এবং কূটনীতির জনক চাণক্য ,পঞ্চতন্ত্রের রচয়িতা বিষ্ণুশর্মা , আয়ুৰ্বেদ চিকিৎসার জনক চড়ক ,যোগসূত্র বা যোগার প্রতিষ্ঠাতা পতঞ্জলি , ব্যাকরণ বা গ্রামারএর উদ্ভাবক পাণিনি।
চাণক্য :
পঞ্চতন্ত্রের রচয়িতা বিষ্ণুশর্মা
আয়ুৰ্বেদ চিকিৎসার জনক চড়ক
যোগসূত্র বা যোগার প্রতিষ্ঠাতা পতঞ্জলি :
ব্যাকরণ বা গ্রামারএর উদ্ভাবক পাণিনি:
পঞ্চম শতাব্দীতে সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আগত হুনদের আক্রমণে পঙ্গু হয়ে যায় হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে পরিচালিত বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এর কফিনে শেষ পেড়েক ঠুকে দেয় অষ্টম থেকে নবম শতকে আগত ডেজার্ট ব্লক ইনভেডাররা।
(বিভিন্ন গান্ধার স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য )
প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ :
গান্ধার হয় কোয়েন্দাহার ( কোরান থেকে কোয়েন্দাহার ) পরে অপভ্ৰংশএ কান্দাহার। পতন হয় এক উজ্জ্বল সময় এবং সভ্যতার ।
গান্ধারের স্থাপত্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য একসময় একে বলা হতো উত্তরের উদ্যান। ১১৫১ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরের কবি কলহন যখন ‘রাজতরঙ্গিনী’ লিখেছেন তাতেও গান্ধারের অনেক পুরোনো শিল্প ও স্থাপত্যের উল্লেখ আছে। মূলত তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় কীভাবে একটি সুন্দর নগরী বহিরাগত মুসলিম ইনভেডারদের দ্বারা ধূলিসাৎ হয়েছিল।
অতীতের সমৃদ্ধশালী গান্ধারে মানে এখনকার কান্দাহার ,পেশোয়ার , সোয়াট উপত্যকায় মাতম চালায় পাণিনির উত্তরপুরুষ তালিবানরা।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ পাণিনি জন্মেছিলেন সোয়াট ভ্যালি তে যা আজকের পাকিস্তানে। পাণিনির ব্যাকরণ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীল ভাষাবিজ্ঞানের প্রাচীনতম গ্রন্থ । তাঁর রচিত অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতম ব্যাকরণগুলির অন্যতম ।
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী :
বাংলা , হিন্দি , ওড়িয়া ,অহমীয়া ,মারাঠি ,গুজরাটি --বর্তমানের প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষার জননী সংস্কৃত।
সোয়াট ভারতের কাশ্মীর থেকে ঠিক ১০০ মাইল -as the crow flies -পশ্চিমে অবস্থিত। সোয়াটএর নাম কয়েক বছর অবশ্য খুব বিখ্যাত হয়েছিল --মোল্লা রেডিও -তালিবান নেতা ফজলুললার কারণে।
এই অঞ্চলে তালিবানরা অবশ্য একা নয় , দোসর আছে আল-কায়দা , আইসিস এবং আরো অনেক ইসলামিক সন্ত্রাসী সংগঠন। তালিবানদের অনেক ভাগ --আফগান তালিবান ,পাকিস্তানী তালিবান বা TTP ইত্যাদি ইত্যাদি।
যেখানে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল আজ সেখানে ছাত্ররা যায় মাদ্রাসায় । আরেকটু বড় হওয়ার পর এদের হাতে ওঠে কালাশনিকভ। পূর্ণ বয়সে ----
কান্দাহারের তালিবানদের সুসাইড এসল্ট টিম:
নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসে তালিবানরা।বিশ্বের দুটোমাত্র দেশ --পাকিস্তান এবং UAE তাদের স্বীকৃতি দেয়।
ইসলামে মূর্তি নাকি হারাম। ক্ষমতায় এসে প্রথমেই তারা ধংস করে বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি। ২০০০ হাজার বেশী পুরোনো এই অনন্য ভাস্কর্য মূর্তি ধংস না করতে তাদের অনুরোধ জানায় ইউনেস্কো থেকে শুরু করে সারা বিশ্ব কিন্তু....
বোম্বিং করে ধংস করা হচ্ছে বামিয়ান বুদ্ধ :
ধংসস্তূপ :
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লীগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে কান্দাহারে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের দাবী জম্মুর জেলে বন্দী তাদের কিছু সাথীর মুক্তি। ভারত সরকার যাতে কমান্ডো নামিয়ে যাত্রী ভর্তি বিমানটিকে মুক্ত করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেয় তালিবানরা। বিমানের ভেতর নববিবাহিত ,হনিমুন প্রত্যাগত এক যুবককে তার স্ত্রীর সামনেই হত্যা করে। আরো মৃত্যু রুখতে ভারত সরকার বাধ্য হয় জেলবন্দী সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিয়ে নিরীহ যাত্রী পূর্ণ বিমানটিকে মুক্ত করতে। রকেট লঞ্চার নিয়ে বিমানটাকে পাহারা দিচ্ছে তালিবানরা
এই তালিবানদের সবচেয়ে বড় মদত দাতা পাকিস্তান সহ কিছু আরব দেশ। অর্থ, অস্ত্র সবকিছুই দেয় তারা। কিন্তু সাপ সাপ ই। সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় মদতদাতা আর্মি এবং ISI এর পাকিস্তানেই আজ সবথেকে বেশী সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়। ডিসেম্বর ২০১৪ সালে পেশোয়ারে পাকিস্তানের আর্মি স্কুলে তালিবান হামলা। ১৪৮ জন ছোট ছোট স্কুলের বাচ্ছাকে হত্যা করে তালিবানরা।
পাণিনি ,চড়ক ,চাণক্য ,পতঞ্জলির উত্তরপুরুষরা আজ ধর্মের আফিম পান করে ব্যস্ত মারায় এবং মরায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৪